ইপেপার । আজ সোমবার, ২৪ মার্চ ২০২৫

ডিজিটাল দেশ গড়ার নামে হাজার কোটি লুটপাট

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৪:০৩:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • / ২৯ বার পড়া হয়েছে

CREATOR: gd-jpeg v1.0 (using IJG JPEG v80), default quality

ছাত্র-জনতার বিপ্লবে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক বয়ান (পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ) ছিল ‘ডিজিটাল বংলাদেশ’ রূপকল্প। গত প্রায় ১৫ বছরে এই শব্দটি মানুষের অস্থি ও মজ্জায় মিশ্রিত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নেয়া হয়েছে আকাশচুম্বী প্রকল্প। অথচ ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর ও তার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেনি সাধারণ মানুষ। বরং বাস্তবে কম্পিউটারের ব্যবহারই জানে না দেশের সিংহভাগ মানুষ। ফলে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করা হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। একবিংশ শতাব্দীতে তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে আইটি বেজড দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্প ঘোষণা করেছিল সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর দিন বদলের এই স্লোগান দেওয়া হলেও ২০২৪ সালে এসে দেশের ৯০ দশমিক ৮০ ভাগ পরিবারই জানে না কম্পিউটারের ব্যবহার। এমনকি সকলের হাতে হাতে মোবাইল থাকলেও ইন্টারনেটের ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে একেবারেই ধারণা নেই দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষের। সরকারি হিসাবেই তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশে প্রতি একশ’ পরিবারের মধ্যে কম্পিউটার ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে জানে মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ ৯০ দশমিক ৮ ভাগ পরিবারই কম্পিউটারের ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে জানে না। কম্পিউটার সম্পর্কে না জানার সংখ্যাটা গ্রামে ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশ হলেও শহরে এই হার ৭৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে না জানার হার ছিল ৯১ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ছিল ৯১ দশমিক ৩ শতাংশ। সাধারণ মানুষ কম্পিউটার ব্যবহারে অজ্ঞ হলেও মানুষকে বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদানের নামে গত ১৪ বছরে প্রায় ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাবেক স্বৈরাচারী সরকার।
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি এম.ই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৫০৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপন প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালের শেষের দিকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ [ইউপিএস] ডিভাইসসহ ৫টি ডেস্কটপ কম্পিউটার লাভ করে। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কম্পিউটারগুলো সেটআপ দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ উপযোগী করা যায়নি। ল্যাব স্থাপনে উপযুক্ত কক্ষ, নিরাপত্তা ও সংরক্ষণে বরাদ্দ না থাকায় সরকারি এই মূল্যবান সামগ্রী এখন গলার কাটা হয়ে দেখা দিয়েছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জান্নাতুন নাঈম রুবির। স্কুল চলাকালে প্রধান শিক্ষকের কক্ষের আলমারিতে কম্পিউটারগুলো তালাবদ্ধ করে রাখা হলেও দীর্ঘ ছুটির সময়ে নিরাপত্তার কারণে নিজ গৃহে স্থানান্তরিত করতে হয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের আওতায় ২০১৫ সালে দেশব্যাপী ২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব ও ক্লাসরুম স্থাপনে প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পে মেয়াদ ও আওতা বৃদ্ধি করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ১৮৬টি ডিজিটাল ল্যাব ও ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়। এর জন্য বরাদ্দ হয় প্রায় ৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শত কোটি টাকা বরাদ্দের এই প্রকল্পের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিই এখন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের তথ্যমতে, শেষ ৩ অর্থবছরে প্রশিক্ষণের জন্য ল্যাব স্থাপন খাতে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ১৫৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে ১ হাজার ৯১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৬৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ হাজার ৮৭২ কোটি ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সংস্থাটি এর আগের অর্থবছরের কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
এমনকি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের [আইএমইডি] কাছেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের আগের কোনো তথ্য নেই। সংস্থাটির কাছে সংরক্ষিত তথ্যানুসারে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৯ বছরে কম্পিউটার ও আইটি প্রশিক্ষণ বাবদ ৪ হাজার ৪৩২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে- বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর [ব্যানবেইস] মাধ্যমে ১৬০ উপজেলায় আইসিটি ট্রেনিংয়ে বরাদ্দ হয় ২ হাজার ১০৩ কোটি ৬২ লাখ, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারে ৯০৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনের [২য় পর্যায়] জন্য ৬০৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে ৪৫৯ কোটি টাকা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারাদেশে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপনে ৯৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে ‘হার পাওয়ার’ প্রকল্পে ৮৬ কোটি টাকা, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মহিলা সংস্থার অধীনে ৬৪ জেলায় জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্পে ৬৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৫০৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপন প্রকল্পে ৫৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুব ও ক্রীড়া অধিদপ্তরের আওতায় ৬৪ জেলায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ৫২ কোটি ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
আইএমইডির এই তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কম্পিউটার প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রমে সবচেয়ে কম ব্যয় করা হয়েছে। এর পরেই প্রশিক্ষণের নামে এই খাতের ব্যয় বাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষের দেওয়া ভ্যাট-ট্যাক্সের অর্থে প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ ও ব্যয় হলেও বাস্তবে এখান থেকে জনগণের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাপ্তি নেই। সরকারি কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও এখন পর্যন্ত দেশের প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছাতে পারেনি। অথচ সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বিভিন্ন সময়ে বক্তব্যে জানিয়েছেন, এই খাতের রপ্তানি আয় দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি। তাই এখন রপ্তানি ৫ বিলিয়নে উন্নীত করতে কাজ করছেন। কিন্তু বাস্তবে এই তথ্যের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর [ইপিবি] তথ্যমতে, দেশের আইটি খাতের রপ্তানি আয় এখন পর্যন্ত এক বিলিয়ন [এক শ’ কোটি] ডলারের ঘরেই পৌঁছতে পারেনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আইটি খাতের রপ্তানি আয় হয়েছে ৬৭২ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন বা ৬৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৬৬৪ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন বা ৬৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।
আইসিটি খাতে আয়ের তথ্য নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে যেমন বাস্তবতার মিল পাওয়া যায়নি, তেমনি দেশে ফ্রিল্যান্সারদের সঠিক সংখ্যারও কোনো হিসাব নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের একজন শীর্ষ ফ্রিল্যান্সার জানিয়েছেন, বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার সংখ্যা ছয় থেকে সাত লাখ। কিন্তু মূলত কাজ করে দেড় লাখের মতো। তাই এই এ খাতে রপ্তানির পরিমাণ ও আয়ের তথ্য কেউ সঠিকভাবে দিতে পারবে না। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের ফ্রিল্যান্সারদের আনুমানিক রপ্তানি ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার। ফ্রিল্যান্সারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) সভাপতি তানজীবা রহমান জানান, এই সংখ্যা ৩০০ মিলিয়ন ডলার। তার মতে, ভবিষ্যতে হয়তো আইসিটি খাতের রপ্তানি দুই বিলিয়ন ডলার হবে।
বেসিসের সাবেক সভাপতি ও বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর আইসিটি খাতের রপ্তানি নিয়ে বলেন, টিভি-ফ্রিজের মতো ইলেট্রনিক পণ্যকেও আইসিটি পণ্য হিসেবে ধরা হয়, যা সঠিক নয়। তার মতে, আইসিটি খাতে রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারের কম হবে। তিনি বলেন, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আইসিটি খাতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তবে সেটার প্রভাব খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। তবে বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, আইসিটি খাতের রপ্তানি প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো। তার মতে, খাতের অনেকেরই তথ্য যুক্ত হয় না। তবে গত দুই বছরে এই খাতের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি হয়নি এটা তিনি স্বীকার করেন।
আইসিটি খাতে প্রশিক্ষণে এমন বিপুল বরাদ্দের পরও ৯০ শতাংশের বেশি পরিবারের কম্পিউটার ব্যবহারে অজ্ঞতার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ মোস্তাফা কে. মুজেরি বলেন, কম্পিউটার যেহেতু নতুন টেকনোলজি তাই এটার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে সেটা কার্যকর হয়নি। তা হলে গলদটা লুকিয়ে আছে প্রশিক্ষনের মধ্যেই। প্রশিক্ষণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়েছে কিনা, এটাই সবচেয়ে মুখ্য বিষয়। আমরা যতটুকু দেখেছি, এইসব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আসলে অর্থের নয়-ছয় করা হয়। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে এ ধরনের লুটপাট বন্ধের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, যারা এই ধরনের প্রজেক্ট বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে তাদের জবাবদিহিতার জায়গাটি নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প শেষে তাদের নিশ্চিত করতে হবে আসলেই কারা, কতটুক উপকারভোগী হয়েছে। শুধু কাগজে-কলমের তথ্য দিয়ে অ্যাকাউন্টিবিলিটি নিশ্চিত হয় না। পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন না থাকলে লুটপাটের সুযোগ পায় এবং এটা একটি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে করা উচিত। তৃতীয় পক্ষটি সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ না থেকে স্বাধীন থাকবে। ফলে তারা প্রকল্পটির যে উদ্দেশ্য, তার কতটুকু সফল হয়েছে সে সম্পর্কে একটি সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারবে। অর্থাৎ চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকতে হবে। এটা না থাকলে যারা সুযোগ সন্ধানী তারা সুযোগের অপব্যবহার করবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

ডিজিটাল দেশ গড়ার নামে হাজার কোটি লুটপাট

আপলোড টাইম : ০৪:০৩:২৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ছাত্র-জনতার বিপ্লবে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম রাজনৈতিক বয়ান (পলিটিক্যাল ন্যারেটিভ) ছিল ‘ডিজিটাল বংলাদেশ’ রূপকল্প। গত প্রায় ১৫ বছরে এই শব্দটি মানুষের অস্থি ও মজ্জায় মিশ্রিত হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নেয়া হয়েছে আকাশচুম্বী প্রকল্প। অথচ ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর ও তার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেনি সাধারণ মানুষ। বরং বাস্তবে কম্পিউটারের ব্যবহারই জানে না দেশের সিংহভাগ মানুষ। ফলে এসব প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করা হয়েছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। একবিংশ শতাব্দীতে তথ্য-প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে আইটি বেজড দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রূপকল্প ঘোষণা করেছিল সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর দিন বদলের এই স্লোগান দেওয়া হলেও ২০২৪ সালে এসে দেশের ৯০ দশমিক ৮০ ভাগ পরিবারই জানে না কম্পিউটারের ব্যবহার। এমনকি সকলের হাতে হাতে মোবাইল থাকলেও ইন্টারনেটের ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে একেবারেই ধারণা নেই দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষের। সরকারি হিসাবেই তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের এ তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক (জুলাই-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত দেশে প্রতি একশ’ পরিবারের মধ্যে কম্পিউটার ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে জানে মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ। অর্থাৎ ৯০ দশমিক ৮ ভাগ পরিবারই কম্পিউটারের ব্যবহার ও প্রয়োগ সম্পর্কে জানে না। কম্পিউটার সম্পর্কে না জানার সংখ্যাটা গ্রামে ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশ হলেও শহরে এই হার ৭৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে না জানার হার ছিল ৯১ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২০২২ সালে ছিল ৯১ দশমিক ৩ শতাংশ। সাধারণ মানুষ কম্পিউটার ব্যবহারে অজ্ঞ হলেও মানুষকে বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদানের নামে গত ১৪ বছরে প্রায় ৯ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাবেক স্বৈরাচারী সরকার।
নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি এম.ই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৫০৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপন প্রকল্পের আওতায় ২০২৩ সালের শেষের দিকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ [ইউপিএস] ডিভাইসসহ ৫টি ডেস্কটপ কম্পিউটার লাভ করে। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কম্পিউটারগুলো সেটআপ দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ উপযোগী করা যায়নি। ল্যাব স্থাপনে উপযুক্ত কক্ষ, নিরাপত্তা ও সংরক্ষণে বরাদ্দ না থাকায় সরকারি এই মূল্যবান সামগ্রী এখন গলার কাটা হয়ে দেখা দিয়েছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জান্নাতুন নাঈম রুবির। স্কুল চলাকালে প্রধান শিক্ষকের কক্ষের আলমারিতে কম্পিউটারগুলো তালাবদ্ধ করে রাখা হলেও দীর্ঘ ছুটির সময়ে নিরাপত্তার কারণে নিজ গৃহে স্থানান্তরিত করতে হয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের আওতায় ২০১৫ সালে দেশব্যাপী ২ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার ল্যাব ও ক্লাসরুম স্থাপনে প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পে মেয়াদ ও আওতা বৃদ্ধি করে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ১৮৬টি ডিজিটাল ল্যাব ও ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়। এর জন্য বরাদ্দ হয় প্রায় ৯৮ কোটি টাকা। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শত কোটি টাকা বরাদ্দের এই প্রকল্পের বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিই এখন রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের তথ্যমতে, শেষ ৩ অর্থবছরে প্রশিক্ষণের জন্য ল্যাব স্থাপন খাতে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ১৫৬ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগে ১ হাজার ৯১৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৩৬৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২ হাজার ৮৭২ কোটি ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সংস্থাটি এর আগের অর্থবছরের কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
এমনকি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের [আইএমইডি] কাছেও ২০১৬-১৭ অর্থবছরের আগের কোনো তথ্য নেই। সংস্থাটির কাছে সংরক্ষিত তথ্যানুসারে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত ৯ বছরে কম্পিউটার ও আইটি প্রশিক্ষণ বাবদ ৪ হাজার ৪৩২ কোটি ৮৬ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে- বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর [ব্যানবেইস] মাধ্যমে ১৬০ উপজেলায় আইসিটি ট্রেনিংয়ে বরাদ্দ হয় ২ হাজার ১০৩ কোটি ৬২ লাখ, হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারে ৯০৪ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপনের [২য় পর্যায়] জন্য ৬০৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে ৪৫৯ কোটি টাকা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারাদেশে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপনে ৯৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকা, প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নে ‘হার পাওয়ার’ প্রকল্পে ৮৬ কোটি টাকা, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় মহিলা সংস্থার অধীনে ৬৪ জেলায় জেলাভিত্তিক মহিলা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রকল্পে ৬৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৫০৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ল্যাব স্থাপন প্রকল্পে ৫৭ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের যুব ও ক্রীড়া অধিদপ্তরের আওতায় ৬৪ জেলায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ৫২ কোটি ২৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
আইএমইডির এই তথ্য থেকে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কম্পিউটার প্রশিক্ষণমূলক কার্যক্রমে সবচেয়ে কম ব্যয় করা হয়েছে। এর পরেই প্রশিক্ষণের নামে এই খাতের ব্যয় বাড়তে থাকে। সাধারণ মানুষের দেওয়া ভ্যাট-ট্যাক্সের অর্থে প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ ও ব্যয় হলেও বাস্তবে এখান থেকে জনগণের উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাপ্তি নেই। সরকারি কোষাগার থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করেও এখন পর্যন্ত দেশের প্রযুক্তি খাতে রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছাতে পারেনি। অথচ সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক বিভিন্ন সময়ে বক্তব্যে জানিয়েছেন, এই খাতের রপ্তানি আয় দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি। তাই এখন রপ্তানি ৫ বিলিয়নে উন্নীত করতে কাজ করছেন। কিন্তু বাস্তবে এই তথ্যের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর [ইপিবি] তথ্যমতে, দেশের আইটি খাতের রপ্তানি আয় এখন পর্যন্ত এক বিলিয়ন [এক শ’ কোটি] ডলারের ঘরেই পৌঁছতে পারেনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আইটি খাতের রপ্তানি আয় হয়েছে ৬৭২ দশমিক ৬৪ মিলিয়ন বা ৬৭ কোটি ২৬ লাখ ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাতে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৬৬৪ দশমিক ৪৯ মিলিয়ন বা ৬৬ কোটি ৪৪ লাখ ডলার।
আইসিটি খাতে আয়ের তথ্য নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে যেমন বাস্তবতার মিল পাওয়া যায়নি, তেমনি দেশে ফ্রিল্যান্সারদের সঠিক সংখ্যারও কোনো হিসাব নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের একজন শীর্ষ ফ্রিল্যান্সার জানিয়েছেন, বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার সংখ্যা ছয় থেকে সাত লাখ। কিন্তু মূলত কাজ করে দেড় লাখের মতো। তাই এই এ খাতে রপ্তানির পরিমাণ ও আয়ের তথ্য কেউ সঠিকভাবে দিতে পারবে না। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশের ফ্রিল্যান্সারদের আনুমানিক রপ্তানি ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার। ফ্রিল্যান্সারদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) সভাপতি তানজীবা রহমান জানান, এই সংখ্যা ৩০০ মিলিয়ন ডলার। তার মতে, ভবিষ্যতে হয়তো আইসিটি খাতের রপ্তানি দুই বিলিয়ন ডলার হবে।
বেসিসের সাবেক সভাপতি ও বিডিজবসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর আইসিটি খাতের রপ্তানি নিয়ে বলেন, টিভি-ফ্রিজের মতো ইলেট্রনিক পণ্যকেও আইসিটি পণ্য হিসেবে ধরা হয়, যা সঠিক নয়। তার মতে, আইসিটি খাতে রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারের কম হবে। তিনি বলেন, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আইসিটি খাতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, তবে সেটার প্রভাব খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। তবে বেসিস সভাপতি রাসেল টি আহমেদ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, আইসিটি খাতের রপ্তানি প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো। তার মতে, খাতের অনেকেরই তথ্য যুক্ত হয় না। তবে গত দুই বছরে এই খাতের প্রত্যাশিত প্রবৃদ্ধি হয়নি এটা তিনি স্বীকার করেন।
আইসিটি খাতে প্রশিক্ষণে এমন বিপুল বরাদ্দের পরও ৯০ শতাংশের বেশি পরিবারের কম্পিউটার ব্যবহারে অজ্ঞতার বিষয়ে অর্থনীতিবিদ মোস্তাফা কে. মুজেরি বলেন, কম্পিউটার যেহেতু নতুন টেকনোলজি তাই এটার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে সেটা কার্যকর হয়নি। তা হলে গলদটা লুকিয়ে আছে প্রশিক্ষনের মধ্যেই। প্রশিক্ষণের অর্থ সঠিকভাবে ব্যয় করা হয়েছে কিনা, এটাই সবচেয়ে মুখ্য বিষয়। আমরা যতটুকু দেখেছি, এইসব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আসলে অর্থের নয়-ছয় করা হয়। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে এ ধরনের লুটপাট বন্ধের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, যারা এই ধরনের প্রজেক্ট বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকবে তাদের জবাবদিহিতার জায়গাটি নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প শেষে তাদের নিশ্চিত করতে হবে আসলেই কারা, কতটুক উপকারভোগী হয়েছে। শুধু কাগজে-কলমের তথ্য দিয়ে অ্যাকাউন্টিবিলিটি নিশ্চিত হয় না। পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন না থাকলে লুটপাটের সুযোগ পায় এবং এটা একটি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে করা উচিত। তৃতীয় পক্ষটি সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কাছে দায়বদ্ধ না থেকে স্বাধীন থাকবে। ফলে তারা প্রকল্পটির যে উদ্দেশ্য, তার কতটুকু সফল হয়েছে সে সম্পর্কে একটি সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারবে। অর্থাৎ চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকতে হবে। এটা না থাকলে যারা সুযোগ সন্ধানী তারা সুযোগের অপব্যবহার করবে।