জীবননগর মনোহরপুরে ভারতীয় নাগরিকের হাতে বাংলাদেশের ভুয়া জন্ম নিবন্ধন ও নাগরিক সনদ
ভোটার হওয়ার সময় ধরা, কৌশলে সরিয়ে দিলেন ইউপি সচিব শাহীন মোল্লা
- আপলোড টাইম : ০৮:৪২:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / ৬৮ বার পড়া হয়েছে
ভুয়া জন্মসনদ হাতে পেয়েও ছেড়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব শাহীন মোল্লার বিরুদ্ধে। ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় এক ভারতীয় নাগরিক মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রদত্ত একটি জন্ম সনদ আনলে সেটি ধরা পড়ে। তবে নির্বাচন অফিসের ভোটার তালিকা হালনাগাদের লোকজন বিষয়টি ইউপি সচিবের নিকট জানালেও ইউপি সচিব শাহীন মোল্লা কোনো ব্যবস্থা না নিয়েই ওই ভারতীয় নাগরিককে সরিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, বিষয়টি জানাননি নিজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। জানেন না পরিষদের প্রশাসকও। জীবননগর উপজেলা নির্বাচন অফিসার বলছেন, আবেদনটি গ্রহণ করা হয়নি। বিস্তারিত ইউনিয়ন পরিষদের সচিব বলতে পারবেন। তবে ইউপি সচিব শাহীন মোল্লা বলছেন, ‘হাওয়া, মতি-গতি, কিছুই আমি বলতে পারব না।’ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যদি বৈবাহিক সূত্রে কেউ নাগরিক হতে চায়, তার নির্ধারিত প্রক্রিয়া আছে। তবে জন্মনিবন্ধন পাবেন না।
জানা যায়, গত ৫ ফেব্রুয়ারি জীবনননগর উপজেলার মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কার্যক্রম চলছিল। ওই সময় একজন ভারতীয় নারী মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদের জন্মসনদ ও নাগরিক সনদ নিয়ে ভোটার হতে হাজির হন। তবে সেখানে স্থানীয় এবং ভোটার তালিকা হালনাগাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নজরে আসলে, তার ভোটার হওয়ার কার্যক্রম স্থগিত করা হয়। ভোটার তালিকা হালনাগাদের কর্মকর্তারা বিষয়টি ইউনিয়ন পরিষদের সচিব শাহীন মোল্লাকে জানান। তবে শাহীন মোল্লা ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। তাৎক্ষণিকভাবে সব কাগজপত্র সরিয়ে ফেলে ওই নারীকেও সেখান থেকে সরিয়ে দেন। তবে বিষয়টি স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এলাকাজুড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যে নারী ভারতের নাগরিক, ওই নারীর বিবাহ হয়েছে জীবননগর উপজেলার পেয়ারাতলা গ্রামে। গোলাম নামের এক ব্যক্তির ছেলের সাথে ওই নারীর বিবাহ হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, তিনি মিথ্যা তথ্য দিয়ে মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাল জন্মসনদ নিয়েছেন। এবং জন্মসূত্রে বাংলাদেশী ভোটার হওয়ার পায়তারা করছেন।
জীবনননগর উপজেলা নির্বাচন অফিসার কামরুল হাসান বলেন, ‘আমি আসলে ওই সময় ছিলাম না। আমাকে একজন বলল, একটা সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। আমি সচিবের সাথে কথা বলেছিলাম, সচিব যাচাই-বাছাই করুক। এটা নিয়ে পরিষদই বলতে পারবে। এর বাইরে আমার নলেজে নেই। আমার অফিসেও আমি খোঁজ নিয়েছি, এটা সম্পর্কে ইউনিয়ন পরিষদ বলতে পারবে।’
জীবননগর উপজেলা আইসিটি কর্মকর্তা ও মহোরপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘আমার নলেজে এটা নেই। বিষয়টি আমি জানি না। আমাকে জানানো হয়নি। আমি বিষয়টি নিয়ে খোঁজ নেব।’
মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব শাহীন মোল্লা প্রথমে বলেন, ‘আমি পুরো ফাইলটি নির্বাচন অফিসারকে দিয়েছি। নাম ঠিকানা মনে নেই। জন্ম নিবন্ধন কার্ডটি মনোহরপুর ইউনিয়নের। জন্মনিবন্ধনের সব তথ্য ভুল। ভুল তথ্য এন্ট্রি করা হয়েছে। নিচে সাবেক সচিব লিয়াকত আলী ও সাবেক প্রশাসকের স্বাক্ষর ছিল। আমি শিয়র না, এরকম একটা কিছু। কোনো ডকুমেন্ট আমাদের কাছে নেই। আমি এখানকার প্রধান নির্বাহী না। আমি কয়দিন এখানে জয়েন করেছি। এখানের হাওয়া, মতি-গতি, কিছুই আমি বলতে পারব না-’ বলে তিনি মুঠোফোন কেটে দেন।
জেলা নির্বাচন অফিসার আহমেদ আলী বলেন, ‘ডিটেইলস বলতে পারবে আমার উপজেলা নির্বাচন অফিসার। আমি মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়েছিলাম। তাদের সন্দেহ হয়েছিল, এটা ভারতীয় নাগরিক। এই বিষয়ে সন্দেহ থাকায় তার হালনাগাদ আমরা করিনি। আপনার কাছে সুনিদিষ্ট নাম-ঠিকানা থাকলে আমি ওইটা বের করে দেয়ার চেষ্টা করব।’ তিনি আরও বলেন, ‘জন্ম নিবন্ধনের বিষয়ে আমি বলতে পারব না। ডিডিএলজি, ইউএনও ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অথরিটি। আমরা যদি ভোটার করতাম, সে বিষয়ে বলতে পারতাম। আমরা তার হালনাগাদ করিনি।’
এ বিষয়ে বক্তব্য নেয়ার জন্য জীবনননগর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে (ইউএনও) একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় সরকারের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক শারমিন আক্তার বলেন, ‘বিষয়টি আমি খোঁজ নেব। তদন্তপূর্বক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈবাহিকসূত্রে এসে এ দেশে জন্ম সনদ পাবার সুযোগ নেই। বৈবাহিক সূত্রে নাগরিক হওয়ার নির্ধারিত প্রক্রিয়া ও আইন আছে। সেটিকেই অনুসরণ করতে হবে। সর্বশেষ ২০২৪ সালের মে মাসে প্রবাসীদের এনআইডি সেবা দিতে মাঠ কর্মকর্তাদের ৮টি নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশনের অধীন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ (এনআইডি)। পরিপত্রে দেওয়া নির্দেশনার ৩ নম্বরে সংস্থাটি জানায়, দ্য বাংলাদেশ সিটিজেনশিপ (টেমপোরারি প্রভিশন) রুলস, ১৯৭৮ এর রুল ৪ এর বিধান অনুযায়ী বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অর্জনকারী বিদেশি নাগরিকের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন ও ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য সুরক্ষা সেবা বিভাগ হতে ইস্যুকৃত নাগরিক সনদ, বিবাহের প্রমাণপত্র ও স্বামী/স্ত্রীর জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করতে হবে।
এদিকে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে, ওই ভুয়া জন্ম সনদ তৈরির পেছনে কাদের হাত আছে? আর নির্ধারিত পথ অনুসরণ না করার পেছনে কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন, যদি বৈবাহিক সূত্রে এ দেশে আসেন ওই নারী, তাহলে তার পাসপোর্ট আছে কি না। এ বিষয়ে তদন্তে প্রশাসনের দৃষ্টি আর্কষণ করছেন সংশ্লিষ্টরা।