জীবননগর বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদে কৃষকদের জৈব সার নিয়ে অনিয়ম, নীরব প্রশাসন
গাড়িভর্তি ১২২ বস্তা সার সরানোর সময় জনতার হাতে আটক
অভিযোগের তীর বিএনপি নেতা বাশার ও খোকনের দিকে, আজ বিএনপির সংবাদ সম্মেলেন
- আপলোড টাইম : ০৮:৫০:২৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / ৪১ বার পড়া হয়েছে
জীবননগর উপজেলার বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের টিনশেড ঘরে সারি সারি করে রাখা হয়েছে ‘সুরক্ষা’ নামে এগ্রো ডায়মন্ড কোম্পানির উৎপাদিত জৈব সার। তবে বস্তা খুলে দেখা গেছে, সারের চেয়ে মাটির পরিমাণ বেশি। গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিনে ইউনিয়ন পরিষদে গেলে এ অনিয়মের বিষয়টি সামনে আসে। এদিকে, সন্ধ্যায় সেখান থেকে পাওয়ার টিলারে করে ১২২ বস্তা সার নিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় জনতা সেটি আটক করে। পরে সার জীবননগর থানা হেফাজতে নেওয়া হয়। এসব ঘটনায় বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার ও সহসভাপতি খাদেমুল খোকন জড়িত বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে, এই ঘটনায় আজ বুধবার বেলা ১১টায় সংবাদ সম্মেলেন ডেকেছে উপজেলা বিএনপি।
সার আটকের পর বাঁকা ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক রাজা মালিথা ফেসবুকে লেখেন, ‘বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির সেক্রেটারি মো. আবুল বাশার ও সহসভাপতি মো. খাদেমুল ইসলাম খোকন ভুয়া প্রকল্প করে মাটিভর্তি সার বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের নিয়ে আসেন। বিষয়টি মিডিয়ায় প্রচার হওয়ায় আজ ৪/২/২৫ইং (মঙ্গলবার) রাত আনুমানিক ৮ ঘটিকার সময় সার পাওয়ার টিলার ভর্তি করে পাচার করার সময় জনতা ধাওয়া খেয়ে গাড়িসহ ধরা খায়। এই চোরের দায়দায়িত্ব বিএনপি দল নেবে না। এই দুইজন বিএনপি নেতার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।’
বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির নেতা আবুল কাশেম বলেন, ‘বিএনপি কোনো চোরের দল না। বাশারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, যদি ঘটনা সত্য হয়, আমরা তার শাস্তি চাই।’
বাঁকা ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মাওলানা মফিজুর রহমান বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ১২২ বস্তা সার চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় আটক করা হয়েছে। গাড়ির চালক এ ঘটনায় দুজনের নাম বলেছেন। আমাদের দাবি তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।’
এ বিষয়ে বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল বাঁশার বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। আমি ইউনিয়ন পরিষদেরও কেউ নই। চেয়ারম্যান বরখাস্ত হওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তিনিই সারের অনুমোদন করেছিলেন। আমাকে জড়িয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হলে তা মিথ্যা হবে।’
এ বিষয়ে জীবননগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মামুন হোসেন বিশ^াস বলেন, ‘পাওয়ার টিলারে করে সার নিয়ে যাচ্ছিল, এসময় স্থানীয় লোকজন আটক করেছে। আমরা জিডিমূলে সারগুলো থানা হেফাজতে রেখেছি। এই সারের উৎস কী, কোথা থেকে আসছে, সেটি জানার জন্য প্রশাসনের কয়েকজনকে ফোন দিয়েছিলাম, তবে তারা কিছু বলতে পারেননি।’
তবে বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের একাধিক ইউপি সদস্য অভিযোগ করেন, প্রতি বছর এডিপির উন্নয়ন তহবিল থেকে পিআইসির মাধ্যমে প্রান্তিক কৃষকদের বিনামূল্যে জৈব সার বিতরণ করা হয়। কিন্তু এ বছর যে সার আনা হয়েছে, তাতে মাটির ভাগ বেশি। এছাড়া কে এই সার এনেছেন, সে বিষয়েও পরিষদের বেশিরভাগ সদস্য কিছুই জানেন না। তবে ইউনিয়ন উন্নয়ন বাস্তবায়ন কমিটির সভায় জৈব সার বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য মর্জিনা বেগমকে।
তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের প্রধান ও সংরক্ষিত নারী সদস্য মর্জিনা বেগমকে পিআইসি করে ৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে চেয়ারম্যান বরখাস্ত হওয়ার পর বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল বাঁশার চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করে মর্জিনা বেগমকে না জানিয়েই দুটি পিআইসি করে এগ্রো ডায়মন্ড কোম্পানির কাছ থেকে ৪০০ টাকা দরে ৬৫২ বস্তা জৈব সার কেনেন। যার মোট মূল্য ২ লাখ ৬০ হাজার ৮০০ টাকা। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদে রাখা হয়েছে ৬১২ বস্তা, আর বাকি ৪০ বস্তার হদিস নেই।
বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. আসাদুর রহমান বলেন, ‘আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি। কে জৈব সার এনেছে, তা আমি জানি না। আমার আসার আগেই এখানে সার রাখা হয়েছে।’
ইউপি সদস্য ও পিআইসি মর্জিনা বেগম বলেন, ‘জৈব সার বিতরণের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমাকে কে পিআইসি করেছে, তাও জানি না। গত সোমবার শুনলাম আমার নামে জৈব সার কেনা হয়েছে। কে এনেছে, কীভাবে এনেছে, কত টাকা বরাদ্দ, এসব বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই।’
এগ্রো ডায়মন্ড কোম্পানির মালিক মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল বাঁশারের মাধ্যমে এ বছর ৪০০ টাকা দরে ৬৫২ বস্তা সার দিয়েছি। কিন্তু পরে জানতে পারি সার নিয়ে সমস্যা হয়েছে। হঠাৎ আবুল বাশার আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদে যাও, সাংবাদিকরা এসেছে। পারলে সার সরিয়ে নিয়ে যাও।’ আমি তো ব্যবসা করি, কোনো চোর নই। সার সরিয়ে নিতে হলে আমার বাড়তি খরচ হবে। তা ছাড়া এখনো সার বিক্রির টাকা পাইনি।’
জীবননগর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘বাঁকা ইউনিয়নে জৈব সার নিয়ে বিএনপির কিছু নেতা আমাকে ফোন করেছিলেন। তবে এটি ইউনিয়ন পরিষদের বিষয়, আমাদের নয়।’
বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল খালেক বলেন, ‘বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদে আনা জৈব সার নিয়ে কৃষকদের অভিযোগের পর আমি ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি, সারের মধ্যে মাটির পরিমাণ বেশি। পরে ডিলারের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, দলের কয়েকজন নেতা তার মাধ্যমে এটি নিয়েছেন। তবে কীভাবে নিয়েছে, তা আমি জানি না। যদি কেউ দলের পদ-পদবি ব্যবহার করে ভেজাল সার সরবরাহ করে, তবে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জীবননগর উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ও বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসক মো. জুয়েল শেখ বলেন, ‘বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদে জৈব সার রাখা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে কে রেখেছে, কীভাবে এসেছে, তা জানি না। গত ২৭ জানুয়ারি থেকে আমি দায়িত্ব নিয়েছি। পিআইসির মাধ্যমে কিছু কাজ করা হবে, যার মধ্যে সার বিতরণও রয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আল আমিন বলেন, ‘জৈব সারের বিষয়ে শুনেছি। ইউনিয়ন পরিষদে নিয়োজিত প্রশাসককে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেছি।’