ছয় মাসেই বেহাত জুলাই বিপ্লব
- আপলোড টাইম : ০৮:৪১:৪৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / ৫৫ বার পড়া হয়েছে
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ছয় মাস পূর্ণ হলো আজ। গত বছরের ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মুখে টিকতে না পেরে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এর মধ্যে দিয়ে পতন ঘটে দীর্ঘ ১৫ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনের। এরপর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত ছয় মাসে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের বদলে নানা বিতর্কে জড়িয়েছে সরকার, অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এর মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের যে গণআকাক্সক্ষা তা ক্রমেই ফিকে হতে শুরু করেছে। দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চা ও ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের ঐক্যেও দিন দিন কমছে। রাজনৈতিক দল কিংবা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সবখানেই জুলাই গণঅভ্যুত্থানের চেতনা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। এছাড়া নতুন করে ভ্যাট বৃদ্ধিতে জনজীবনে ক্ষোভ বাড়ছে। সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। সর্বশেষ সরকারি গাড়ি ব্যবহার নিয়ে অনিয়ম করে বিতর্কে জড়িয়েছেন সরকারের বেশ কয়েকজন উপদেষ্টা। এছাড়া রাষ্ট্রের সমস্যা সমাধানের বদলে রাজনৈতিক দল গঠনেই বেশি মনযোগী শিক্ষার্থীরা। অনেকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, তদবির বাণিজ্যেরও অভিযোগ উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিপরীতে দখল বাণিজ্য ও ক্ষমতা চর্চাই বেশি মনযোগী হচ্ছে।
উপদেষ্টাদের গাড়ি বিলাস :
গতকাল মঙ্গলবার সরকারের উপদেষ্টাদের গাড়ি ব্যবহারের অনিয়ম নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিক। প্রতিবেদনে বলা হয়, সবকিছু আমূল বদলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা এখন সরকারি গাড়ি ব্যবহারের দিক থেকে ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের মন্ত্রীদের দেখানো পথে হাঁটছেন। সরকারি গাড়ি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো নিয়ম-নীতির ধার ধারছেন না সরকারের উপদেষ্টারা। বিধি অনুযায়ী, উপদেষ্টাদের একটি করে সরকারি গাড়ি পাওয়ার কথা। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোনো কোনো উপদেষ্টা নিজের ও দপ্তরের নামে তিন থেকে চারটি সরকারি গাড়ি দখলে রেখেছেন। সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টা পরিবারের সদস্যরা সেই গাড়িতে সওয়ার হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, উপদেষ্টার একান্ত সচিব (পিএস), সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস), জনসংযোগ কর্মকর্তারাও (পিআরও) কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেসব গাড়ি ব্যবহার করছেন।
গণমাধ্যমটির অনুসন্ধান বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ২২ উপদেষ্টার মধ্যে আটজন ছাড়া বাকি সবাই একাধিক সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। একমাত্র বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন সরকারি কোনো গাড়িতেই চড়েন না। সরকারি কাজে তিনি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনগণের স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকার নিয়মের চর্চা প্রতিষ্ঠা করবে, এটিই সবার প্রত্যাশা। উপদেষ্টারা যেভাবে গাড়ি ব্যবহার করছেন, তা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এটা এক ধরনের নৈতিক স্খলন।
দল গঠনে ব্যস্ত সমন্বয়করা :
৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদদের পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার অভাব, আর্থিক সহায়তা না পাওয়া ও ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলনে রাস্তায় নেমেছেন। তাদের দাবি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও এখনো অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছেন না। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে ভুগছেন আহতরা এবং আর্থিক সংকটে দিন কাটাচ্ছেন শহিদদের পরিবার। আহত ও শহিদের পরিবারের অভিযোগ, আগস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এখন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও দল গঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারেরও তাদের প্রতি খুব একটা নজর নেই। গত শনি ও রোববার গণঅভ্যুত্থানে আহতরা অসুস্থ শরীর নিয়ে রাজধানীর সড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। রোববার বেলা ১১টা থেকে শিশুমেলার সামনে তিন রাস্তার মোড়ে আহতরা তাদের দাবি আদায়ে অবস্থান শুরু করেন। সন্ধ্যায় মিরপুর সড়ক ছেড়ে বিক্ষুব্ধরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাত্রা করেন। সন্ধ্যায় ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে বিক্ষোভ করেন।
আন্দোলনকারীদের একজন আমিনুল ইসলাম ইমন বলেন, শনিবার রাত থেকে তারা সড়কে অবস্থান করলেও সরকারের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তি তাদের সঙ্গে দেখা করা তো দূরের কথা, ন্যূনতম সহানুভূতিও দেখাননি। অথচ জুলাই আন্দোলনে নিহত ও আহত মানুষদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যেসব প্রতিশ্রুতি ছিল, বাস্তবে সে উদ্যোগগুলো তেমন গতি নেই। শহিদ এবং আহতদের ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্টদের যে বিষয়গুলো দ্রুতগতিতে দেখার কথা ছিল, সেখানেও আমরা একটু গাফিলতি দেখতে পাচ্ছি।
অভ্যুত্থানে আহতরা যখন সুচিকিৎসার দাবিতে রাস্তায়, তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ব্যস্ত দল গঠনে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে ছাত্র- জনতার নতুন দল গঠনের ঘোষণা দেওয়ার বিষয়টি প্রায় চূড়ান্ত। এসব কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা। এদিকে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগের মধ্যেই নেতৃত্বের লড়াই এবং আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে একের পর এক হামলা-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কেন্দ্রীয় নেতাদেরও অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার খরব পাওয়া গেছে।
দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় মনযোগ বিএনপির বিতর্কে জামায়াত :
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক দলগুলো নতুনভাবে নিজেদের সংগঠিত করার চেষ্টা করলেও বিভক্তি, ক্ষমতার লড়াই ও সঠিক নেতৃত্ব সংকট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে এখনো পুরোপুরি বের হতে পারছে না বিএনপি। এরই মধ্যে নানা অভিযোগে সারা দেশে বহিষ্কার করা হয়েছে দলটির ১২০০ নেতা-কর্মীকে। এছাড়া বিতর্কের চাপে রাজনীতিতে এখনো ধরাশায়ী জামায়াতে ইসলামী। বাকি ইসলামী দলগুলোও এখনো সেই পুরোনো ধারায় নিজেদের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ভুগছে জাতীয় পার্টি। দলগুলোর মধ্যে বাড়ছে দূরত্ব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি দলগুলো দ্রুত সংগঠিত হতে না পারে, ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়; তাহলে বাংলাদেশ আরো গভীর রাজনৈতিক সংকটে পড়তে পারে।