যৌথবাহিনীর হাতে আটকের পর যুবদল নেতার মৃত্যু
তোলপাড়, ক্যাম্প কমান্ডার প্রত্যাহার, তদন্ত কমিটি
- আপলোড টাইম : ০৩:০৫:১৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / ১৫ বার পড়া হয়েছে
যৌথবাহিনীর হেফাজতে যুবদল নেতা তৌহিদুর রহমানের মৃত্যুতে কাঁদছে তার পরিবার। চার শিশু সন্তানের আহাজারিতে কাঁদছেন স্বজনরাও। বিচার দাবিতে উত্তাল কুমিল্লা। গতকাল তৌহিদের লাশ নিয়ে শহরে মানববন্ধন করেছেন স্বজন ও সাধারণ মানুষ। এ সময় তৌহিদের চার শিশু সন্তান ও স্ত্রীর আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। এদিকে তৌহিদের মৃত্যুর ঘটনার দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে সেনা ক্যাম্প কমান্ডারকে প্রত্যাহার করা হয়েছে জানিয়েছে আইএসপিআর। তৌহিদ হত্যার বিচার দাবি করে বিবৃতি দিয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
গতকাল শনিবার দুপুুরে কুমিল্লা সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক তৌহিদুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে এলাকাবাসী। নিহতের বাড়ি থেকে লাশবাহী এম্বুলেন্সযোগে মরদেহ কুমিল্লা প্রেস ক্লাবে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করা হয়। বক্তব্য রাখেন, নিহত যুবদল নেতার স্ত্রী ইয়াসমিন নাহার। তিনি বলেন, আমার স্বামী সন্ত্রাসী ছিল না। তাকে কেন এভাবে মারা হলো? আমি ৪ সন্তান নিয়ে বিধবা হলাম। আরও বক্তব্য রাখেন, তৌহিদুরের সঙ্গে আটক করা প্রতিবেশী লুৎফুর রহমান। তিনি বলেন, তাকে এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছে সে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। মানববন্ধনে নিহতের ভাগ্নি গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর মাহবুবা উদ্দিন বলেন, ঘটনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত দফায় দফায় আমরা কুমিল্লা সেনানিবাসের সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সেনা আইনে বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা যদি ন্যায়বিচার না পাই তাহলে বিধি অনুসারে আইনগত পদক্ষেপ নেবো। মানববন্ধনে উপস্থিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কুমিল্লা মহানগর শাখার সদস্য সচিব রাশেদুল হাসান বলেন, ঘটনার পর থেকে আমরা এ বিষয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। সেনাবাহিনী জুলাই আগস্ট আন্দোলনে জনতার সঙ্গে মধুর সম্পর্ক রেখে দেশের জন্য কাজ করেছে। এভাবে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তির মৃত্যু আমাদের কষ্ট দেয়। আশাকরি ওই ব্যক্তির পরিবার বিচার পাবে। ওদিকে যুবদল নেতা তৌহিদের জানাজায় এলাকার সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেন। জানাজায় যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতারাও উপস্থিত ছিলেন।
যেভাবে তুলে নেয়া হয় তৌহিদকে: যুবদল নেতা তৌহিদের ভাই আবুল কালাম আজাদ টিপু সাংবাদিকদের জানান, ৪ দিন আগে তার বাবা মারা গেছে। শুক্রবার ছিল কুলখানি। আমরা শোকাহত। বৃহস্পতিবার রাত আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর ৩টি গাড়ি ও একটি লাল রঙের গাড়ি আমাদের বাড়ি আসে। এ সময় পোশাক ও সিভিলে থাকা কয়েকজন তৌহিদুল ইসলামের কাছে অস্ত্র আছে এমন অভিযোগে রুমে তল্লাশি করে। আমার ভাইয়ের কাছে অস্ত্র নেই আমরা বার বার তা বলার পরও তারা আমার ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। সকাল থেকে আমরা থানায় ভাইয়ের খোঁজ নিয়েও পাইনি। তিনি বলেন, শুক্রবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে কোতোয়ালি মডেল থানার এস আই মোরশেদ মোবাইল ফোনে আমাদের জানায় শহরতলীর গোমতী পাড়ের গোমতী বিলাশ নামক স্থান থেকে আমার ভাইকে উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়েছে। আমরা হাসপাতালে গিয়ে ভাইয়ের মরদেহ দেখতে পাই। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেন।
এসআই মোরশেদ বলেন, গোমতী পাড়ের ঝাকুনি পাড়ার গোমতী বিলাসে গিয়ে যখন তৌহিদকে গাড়িতে উঠাই তখনো তার প্রাণ ছিল। কিন্তু কুমেক হাসপাতালে আনার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত্যু ঘোষণা করে। কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোহাম্মদ সাইফুল মালিক বলেন, সেনাবাহিনীর সদস্যরা ওই ব্যক্তিকে আমাদের নিকট হস্তান্তর করার সময় সে অসুস্থবোধ করায় হাসপাতালে নেয়ার পর তার মৃত্যু হয়। কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের আহ্বায়ক আনোয়ারুল হক বলেন, যুবদল নেতা তৌহিদ তাদের দলের একজন সৎ ও নিবেদিত নেতা ছিলেন। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তার ২ মেয়ে কোরআনের হাফেজ। সে অস্ত্রধারী হলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যেতো।
দ্রুত তদন্তের নির্দেশ সরকারের: নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে কুমিল্লায় যুবদল নেতা মো. তৌহিদুল ইসলামের মৃত্যুর ঘটনার দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে সরকার। শনিবার প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের এক বিবৃতিতে সরকারের এই নির্দেশনার কথা জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে যেকোনো ধরনের নির্যাতন ও হত্যার কঠোর নিন্দা জানায়। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই এই সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য, যেখানে দেশের শীর্ষ মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন। প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কুমিল্লায় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আহত অবস্থায় তরুণ তৌহিদুল ইসলামকে হাসপাতালে নেয়া হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, ওইদিন ভোররাতে তার বাড়ি থেকে আটক করার পর তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হন। তৌহিদুলের মৃত্যুর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। দেশে এ ধরনের অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার ইতিমধ্যে একাধিক কমিশন গঠন করেছে। এসব কমিশনের বেশির ভাগই তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ, অপরাধ ব্যবস্থাপনা এবং বিচারিক প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব সুযোগ নির্মূল করতে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গঠনমূলক সংলাপ করবে বলে প্রেস উইং জানায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই সংস্কার কর্মসূচি কার্যকর করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
যুবদল হত্যা নিয়ে যা বললো আইসএসপিআর: কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলা থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আটক মো. তৌহিদুল ইসলামের (৪০) মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। শনিবার আইএসপিআর এক বিবৃতিতে বলেছে, ঘটনাটি অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক। ওই সেনাক্যাম্পের কমান্ডারকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে। মৃত্যুর সঠিক কারণ উদ্ঘাটনের জন্য উচ্চপদস্থ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সেনা আইন অনুযায়ী যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইএসপিআর জানায়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাত তিনটার দিকে কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলা থেকে যৌথ বাহিনীর অভিযানে তৌহিদুল ইসলামকে আটক করা হয়। আইএসপিআর বলেছে, শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তৌহিদুল কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান।
বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিবাদ: যুবদল নেতা তৌহিদ হত্যায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। পৃথক বিবৃতিতে তারা ঘটনার সঠিক তদন্ত দাবি করেন। এক বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঘটনাকে দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেন। এই ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন জামায়াতের আমীর ডা. শফিকুর রহমান। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ওদিকে যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়ন গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তৌহিদ হত্যার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির। তৌহিদ হত্যার বিচার দাবি করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল নূরুল ইসলাম সাদ্দাম এক যৌথ বিবৃতিতে এর প্রতিবাদ জানান।