ইপেপার । আজ বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঝিনাইদহে সওজের ৩৭ বিঘা জমি দখল করে গড়ে উঠেছে ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান

শত কোটি টাকার ৯১০ বিঘা খাস জমি প্রভাবশালীদের দখলে

আসিফ কাজল, ঝিনাইদহ থেকে:
  • আপলোড টাইম : ০৫:৩৩:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
  • / ২৩ বার পড়া হয়েছে

ঝিনাইদহে প্রায় শত কোটি টাকার মূল্যের ৯১০ বিঘা সরকারি খাস জমি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। এসব রাষ্ট্রীয় ভূ-সম্পত্তি দখলমুক্ত করতে কার্যকর কোনো সরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং উদ্বেগজনক হারে ঝিনাইদহে জমি দখলের প্রবণতা বাড়ছে। সরকারি জমি দখলের দিক থেকে মহেশপুর উপজেলা সবচেয়ে এগিয়ে। সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, সেখানে প্রায় ১২০০ বিঘা (৪০২.২৯ একর) খাস জমি বেদখল রয়েছে। এর মধ্যে মহেশপুরের কানাইডাঙ্গা মৌজায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের প্রায় ৩৭ বিঘা জমি দখল হয়েছে, যা প্রধান সড়কের পাশে হওয়ায় অত্যন্ত মূল্যবান। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীরা এই সরকারি খাস জমি কোটি কোটি টাকা দিয়ে কিনে সেখানে শিল্পকারখানা স্থাপন করছেন।

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূ-সম্পত্তি দখলবিষয়ক অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত কার্যক্রম মনিটরিং কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেলার ছয় উপজেলায় মোট ১,৪০২.৮ বিঘা (৪৬৭.৬০ একর) সরকারি খাস জমি বেদখল ছিল। এর মধ্যে ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ২৫.৩৫ একর, শৈলকুপায় ১৭.১০ একর, হরিণাকুণ্ডুতে ৫.৯৯ একর, কালীগঞ্জে ১০.১৫ একর, কোটচাঁদপুরে ৬.৭২ একর ও মহেশপুর উপজেলায় ৪০২.২৯ একর।

২০২৫ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত জেলা প্রশাসন মাত্র ১৬৪.৪০ একর জমি উদ্ধার করতে পেরেছে, কিন্তু এখনও ৩০৩.৪০ একর জমি উদ্ধারের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতি মাসে জমি দখলমুক্তির বিষয়ে মনিটরিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলেও, সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা কোনো কার্যকর উত্তর দিতে পারছেন না। প্রশাসনের দাবি, লোকবল ও পুলিশের সহায়তা না পাওয়ায় জমি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।

অভিযোগ রয়েছে, মনিটরিং কমিটির সভায় বারবার একই তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় অনুদ্ধারকৃত জমির পরিমাণ ছিল ৩০৪ একর, যা ২০২৫ সালের ২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সভায় দাঁড়িয়েছে ৩০৩.৪০ একর-অর্থাৎ তিন মাসে মাত্র ০.৭৭ শতক জমি উদ্ধার হয়েছে। মহেশপুরে বেদখল থাকা ৪০২.২৯ একর জমির পরিমাণ এক বছরেও অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে প্রভাবশালীরা সেখানে নির্ভয়ে স্থাপনা ও শিল্পকারখানা গড়ে তুলছেন।
বিশেষ করে ১৯৬৭ সালে অধিগ্রহণ করা ঝিনাইদহ সড়ক বিভাগের ৩৭ বিঘা জমি বর্তমানে ৮২ জনের নামে আরএস রেকর্ডভুক্ত হয়ে গেছে, যদিও এটি সরকারি ১/১ খাস খতিয়ানভুক্ত হওয়ার কথা। মহেশপুরের ফতেপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৬৭ সালে ঝিনাইদহ-কালীগঞ্জ-জীবননগর সড়ক নির্মাণের জন্য কানাইডাঙ্গা মৌজায় ৩৭ বিঘা (১২.৪৪ একর) জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সে সময় জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা পেলেও পরে তারা ওই সরকারি সম্পত্তি নিজেদের দখলে রেখে আরএস রেকর্ড করে নেন। এখন তারা বিনা বাধায় জমিগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন।

২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর ফতেপুর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ২৫ জন দখলদার চিহ্নিত করে তাদের কাছ থেকে জমি উদ্ধারে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও রেকর্ড সংশোধনের জন্য ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি (স্মারক নং ২০২৩/২৫৭) পাঠান। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রশাসন জমিগুলো দখলমুক্ত করতে পারেনি। ফলে এসব জমি কেনাবেচার মাধ্যমে হাতবদল হয়ে সেখানে ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
অন্যদিকে, ঝিনাইদহ সড়ক ও জনপথ বিভাগও জমি উদ্ধারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। সওজ বিভাগের সার্ভেয়ার জানান, তারা দখলদারদের চিহ্নিত করেছেন এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বকুল চন্দ্র কবিরাজ বলেন, ‘সরকারি খাস জমি উদ্ধারে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি, তবে এখনো সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। জমি উদ্ধারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) গণকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।’

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

ঝিনাইদহে সওজের ৩৭ বিঘা জমি দখল করে গড়ে উঠেছে ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান

শত কোটি টাকার ৯১০ বিঘা খাস জমি প্রভাবশালীদের দখলে

আপলোড টাইম : ০৫:৩৩:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ঝিনাইদহে প্রায় শত কোটি টাকার মূল্যের ৯১০ বিঘা সরকারি খাস জমি প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে। এসব রাষ্ট্রীয় ভূ-সম্পত্তি দখলমুক্ত করতে কার্যকর কোনো সরকারি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বরং উদ্বেগজনক হারে ঝিনাইদহে জমি দখলের প্রবণতা বাড়ছে। সরকারি জমি দখলের দিক থেকে মহেশপুর উপজেলা সবচেয়ে এগিয়ে। সরকারি রেকর্ড অনুযায়ী, সেখানে প্রায় ১২০০ বিঘা (৪০২.২৯ একর) খাস জমি বেদখল রয়েছে। এর মধ্যে মহেশপুরের কানাইডাঙ্গা মৌজায় সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের প্রায় ৩৭ বিঘা জমি দখল হয়েছে, যা প্রধান সড়কের পাশে হওয়ায় অত্যন্ত মূল্যবান। অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীরা এই সরকারি খাস জমি কোটি কোটি টাকা দিয়ে কিনে সেখানে শিল্পকারখানা স্থাপন করছেন।

ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূ-সম্পত্তি দখলবিষয়ক অভিযোগ গ্রহণ ও তদন্ত কার্যক্রম মনিটরিং কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেলার ছয় উপজেলায় মোট ১,৪০২.৮ বিঘা (৪৬৭.৬০ একর) সরকারি খাস জমি বেদখল ছিল। এর মধ্যে ঝিনাইদহ সদর উপজেলায় ২৫.৩৫ একর, শৈলকুপায় ১৭.১০ একর, হরিণাকুণ্ডুতে ৫.৯৯ একর, কালীগঞ্জে ১০.১৫ একর, কোটচাঁদপুরে ৬.৭২ একর ও মহেশপুর উপজেলায় ৪০২.২৯ একর।

২০২৫ সালের ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত জেলা প্রশাসন মাত্র ১৬৪.৪০ একর জমি উদ্ধার করতে পেরেছে, কিন্তু এখনও ৩০৩.৪০ একর জমি উদ্ধারের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রতি মাসে জমি দখলমুক্তির বিষয়ে মনিটরিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলেও, সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা কোনো কার্যকর উত্তর দিতে পারছেন না। প্রশাসনের দাবি, লোকবল ও পুলিশের সহায়তা না পাওয়ায় জমি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।

অভিযোগ রয়েছে, মনিটরিং কমিটির সভায় বারবার একই তথ্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় অনুদ্ধারকৃত জমির পরিমাণ ছিল ৩০৪ একর, যা ২০২৫ সালের ২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সভায় দাঁড়িয়েছে ৩০৩.৪০ একর-অর্থাৎ তিন মাসে মাত্র ০.৭৭ শতক জমি উদ্ধার হয়েছে। মহেশপুরে বেদখল থাকা ৪০২.২৯ একর জমির পরিমাণ এক বছরেও অপরিবর্তিত রয়েছে। ফলে প্রভাবশালীরা সেখানে নির্ভয়ে স্থাপনা ও শিল্পকারখানা গড়ে তুলছেন।
বিশেষ করে ১৯৬৭ সালে অধিগ্রহণ করা ঝিনাইদহ সড়ক বিভাগের ৩৭ বিঘা জমি বর্তমানে ৮২ জনের নামে আরএস রেকর্ডভুক্ত হয়ে গেছে, যদিও এটি সরকারি ১/১ খাস খতিয়ানভুক্ত হওয়ার কথা। মহেশপুরের ফতেপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৬৭ সালে ঝিনাইদহ-কালীগঞ্জ-জীবননগর সড়ক নির্মাণের জন্য কানাইডাঙ্গা মৌজায় ৩৭ বিঘা (১২.৪৪ একর) জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সে সময় জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণের টাকা পেলেও পরে তারা ওই সরকারি সম্পত্তি নিজেদের দখলে রেখে আরএস রেকর্ড করে নেন। এখন তারা বিনা বাধায় জমিগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন।

২০২৩ সালের ২৫ অক্টোবর ফতেপুর ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তা ২৫ জন দখলদার চিহ্নিত করে তাদের কাছ থেকে জমি উদ্ধারে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও রেকর্ড সংশোধনের জন্য ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কাছে চিঠি (স্মারক নং ২০২৩/২৫৭) পাঠান। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও প্রশাসন জমিগুলো দখলমুক্ত করতে পারেনি। ফলে এসব জমি কেনাবেচার মাধ্যমে হাতবদল হয়ে সেখানে ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
অন্যদিকে, ঝিনাইদহ সড়ক ও জনপথ বিভাগও জমি উদ্ধারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। সওজ বিভাগের সার্ভেয়ার জানান, তারা দখলদারদের চিহ্নিত করেছেন এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) বকুল চন্দ্র কবিরাজ বলেন, ‘সরকারি খাস জমি উদ্ধারে আমরা নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি, তবে এখনো সন্তোষজনক অগ্রগতি হয়নি। জমি উদ্ধারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) গণকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।’