মধুচন্দ্রিমা শেষে চাপ বাড়ছে অন্তর্বর্তী সরকারের
- আপলোড টাইম : ০৪:৫৬:১৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
- / ২০ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার যে বিপুল সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিল, তা অনেকটা কমতে শুরু করেছে বলে মনে করছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। আইসিজি বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুধু অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির বিভেদ ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে না, দৈনন্দিন ব্যবস্থাপনা নিয়েও জনসমালোচনার মুখে পড়েছে। এছাড়া, প্রতিশ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করতে তত চাপে পড়ছে। গণতান্ত্রিক উত্তরণে সহায়তা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও এর সদস্যদেশগুলো কী উদ্যোগ নিতে পারে, তা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার ক্রাইসিস গ্রুপ তাদের মতামত তুলে ধরেছে। ইইউ ও এর সদস্যদেশগুলো কোথায় শান্তির সম্ভাবনা বাড়াতে পারে, তা চিহ্নিত করে প্রতিবছর ক্রাইসিস গ্রুপ ইইউ ওয়াচ লিস্ট বা ইইউ পর্যবেক্ষণ তালিকা প্রকাশ করে। এ বছরের তালিকায় বাংলাদেশ ছাড়াও ইউক্রেন, সিরিয়া, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন, ইরানসহ বেশ কয়েকটি দেশের নাম রয়েছে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে শিরোনাম, বাংলাদেশ: গণতান্ত্রিক উত্তরণে উভয়সংকট।
ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশবিষয়ক সিনিয়র কনসালট্যান্ট থমাস কিয়ান বলেছেন, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমা এখন পুরোপুরি শেষ। রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ সংস্কার নিয়ে দরকষাকষি করায় এবং নির্বাচনী সুবিধার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় এই বছর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বাড়তে পারে। জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণেও অন্তর্বর্তী সরকার চাপে রয়েছে, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার হিসেবে তারা পেয়েছে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, অর্থনীতিকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চলমান প্রচেষ্টার সুফল বাংলাদেশের জনগণের বাস্তবে পেতে আরও সময় লাগবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে এখনো টানাপোড়েন রয়েছে আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এরপরও আগামী বছর বাংলাদেশের সামনে দেশটির জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং এটিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক করার একটি বিরল সুযোগ রয়েছে। এই লক্ষ্যে সংস্কার কমিশনগুলো কয়েক শ প্রস্তাব সম্বলিত প্রতিবেদন জমা দিতে শুরু করেছে। এদিকে নির্বাচনী রাজনীতিতে বাংলাদেশের জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
গণঅভ্যুত্থানে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতনের ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছে। আগামী ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার ও তার সমর্থকরা আশা করছেন, এই ভোট কেবল গণতন্ত্রই পুনরুদ্ধার করবে না, বরং ১৫ বছরের ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী ও দমনমূলক শাসনের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন যুগের সূচনা করবে। থমাস আরও বলেন, সংস্কার প্রক্রিয়ার সমর্থনে এবং অন্তর্র্বতী সরকার যাতে বাংলাদেশকে একটি জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হয় তা নিশ্চিতে আলাপ-আলোচনা, কারিগরি ও আর্থিকভাবে বিদেশি অংশীদারদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে ইইউর সামনে গণতান্ত্রিক উত্তরণকে সমর্থন দেওয়ার এবং অত্যন্ত ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের একটি অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ এক বাণিজ্য অংশীদারের সঙ্গে তাদের সম্পর্কোন্নয়নের সুযোগ এনে দিয়েছে বাংলাদেশ।
আইসিজির মতে, বাংলাদেশকে সমর্থন দিতে ইইউ ও এর সদস্যদেশগুলোর যা করতে পারে সেগুলো হলো, বাংলাদেশে উচ্চপর্যায়ের সফর ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারকাজে সমর্থনের ওপর জোর দেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে; যাতে ড. ইউনূস সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় এবং ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চাওয়া শক্তিগুলো দুর্বল হয়। পাশাপাশি নতুন অংশীদারি প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতামূলক চুক্তি করার চেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচিকে কারিগরি এবং আর্থিকভাবে সমর্থন দেওয়া দরকার। গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা, শাসনব্যবস্থার উন্নয়ন ও মানবাধিকার রক্ষাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে পারে ইইউ। নির্বাচনগুলো পর্যবেক্ষণে একটি নির্বাচনী পর্যবেক্ষক মিশন পাঠানো উচিত এ জোটের।
আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সমর্থন আদায় করে জাতীয় অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে অবদান রাখতে পারে ইউরোপ; এতে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার-আরও আকর্ষণীয় বিদেশি বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরিতে সহায়ক হবে। তৈরি পোশাক উৎপাদন খাতের বাইরে এনে দেশের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করার প্রচেষ্টায় সমর্থন, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত সম্পদ পুনরুদ্ধারে সহায়তা এবং ২০২৯ সালের পরও ইউরোপীয় বাজারে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার বিস্তৃত করতে ঢাকার সঙ্গে সমঝোতা চালিয়ে যাওয়া দরকার।
ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে উত্তেজনা কমাতে এবং দুই দেশের মধ্যে অনাস্থা কাটিয়ে সম্পর্ককে ভালো অবস্থানে নিতে ইইউর উচিত হবে দুই পক্ষের ওপরই প্রভাব খাটানো। ইইউ ২০২৫ সালে পরিকল্পনার অংশ হিসেবে উচ্চপর্যায়ের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে নীরবে ভারতকে উৎসাহিত করা, যা বাংলাদেশের সংস্কারে আরও সহায়ক হবে। রোহিঙ্গা ও তাদের আশ্রয় দেওয়া স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য বাংলাদেশে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে অর্থায়ন অব্যাহত রাখা দরকার। পাশাপাশি রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্যায়ের সম্মেলন আয়োজনে ঢাকার চেষ্টাকে সহায়তা প্রদান এবং সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগে অন্তর্বর্তী সরকারকে উৎসাহিত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন অভিমুখে লাখো বিক্ষোভকারী এগিয়ে আসায় আগস্টের শুরুতে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরও মাসখানেক আগে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ শুরু হয়, যখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রীয় চাকরির কোটা ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবিতে রাস্তায় নামেন। হাসিনার নিষ্ঠুরভাবে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা তার পতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তার শাসন নিয়ে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ গণআন্দোলনে রূপ নেয়-যা তাকে সরে যেতে বাধ্য করে। শেখ হাসিনার পতন বাংলাদেশের জন্য ঐতিহাসিক এক মূহূর্ত।
অবশেষে, সেনাবাহিনী, ছাত্র নেতা এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বিত সিদ্ধান্তে ড. ইউনূসকে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয়। দেশে ও বিদেশে ড. ইউনূসের প্রতি শ্রদ্ধা অন্তর্বর্র্তী সরকারের বৈধতা আদায়, উচ্চাকাক্সক্ষী রাজনৈতিক সংস্কারকাজে সমর্থন জোগাড় ও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠায় ছিল জরুরি। হাসিনাকে উৎখাতের সঙ্গে যে উচ্ছ্বাস মিশে ছিল, তা ইউনূসের প্রশাসনের জন্য ব্যাপক সমর্থনে রূপ নেয়। তবে সেই মধুচন্দ্রিমা শেষ। কেবল প্রতিশ্রুত সংস্কার নয়, দৈনন্দিন শাসন-ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্যও এ সরকারের ওপর জনগণের চাপ বেড়েছে। এর একটি হলো, নতুন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারকে চাপ বাড়াচ্ছে। তফসিল ঘোষণা হলে বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাবে। গত ১৬ ডিসেম্বর ড. ইউনূস বলেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর অর্থ, তার প্রশাসন দুই বছরের কম মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবে। পুরোপুরি না হলেও এই ঘোষণা সমালোচকদের মুখ বন্ধ করেছে। সম্ভাব্য নির্বাচনে যথেষ্ট সময় থাকলেও বিএনপি, অন্যান্য রাজনৈতিক দল (যেমন জামায়াতে ইসলামী) এবং ছাত্র নেতাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে। ছাত্ররা এখন একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনার ব্যাপারে নিশ্চিত।
নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণার বাইরেও নির্বাচন প্রক্রিয়ার অনেক কিছু ও নির্বাচন-পরবর্তী সময় নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। উচ্চাকাক্সক্ষী সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে ড. ইউনূস বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। চারটি কমিশন জানুয়ারির মাঝামাঝিতে তাদের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে। ব্যাপক রাজনৈতিক সংস্কারকাজ চালানোর সুপারিশ করেছে তারা। মুহাম্মদ ইউনূসও একটি কমিশনের নেতৃত্বে রয়েছেন। সব কমিশনের সুপারিশ পাওয়ার পর তা নিয়ে তিনি সরকার রাজনৈতিক দলগুলো, নাগরিক সমাজ ও অন্যান্য শক্তির সঙ্গে আলোচনা করবে। এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কোন সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হবে এবং কোনগুলো বাদ দেওয়া হবে অথবা ভবিষ্যতের সরকারের জন্য রেখে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক জটিলতা ছাড়াও অন্তর্বর্তী সরকার অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তুষ্টির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, ব্যাপক দুর্নীতি, আর্থিক খাতে তার সঙ্গীদের লুটপাট। সরকারের এক তদন্ত অনুযায়ী, অর্থনৈতিক খাতের অরাজকতা অন্তত ১০টি ব্যাংককে ‹কার্যত দেউলিয়া করে ফেলেছে।
ইউনূস যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছিল এবং খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। নীতি নির্ধারণে উন্নতি ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়গুলোতে যোগ্য কর্মকর্তা নিয়োগসহ তার পদক্ষেপগুলো অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য যে অনিশ্চয়তার বীজ বপন করা হয়েছে, তার ফলে অর্থনীতি এখনো স্থিতিশীল হতে পারছে না। বাংলাদেশিরা ক্রমাগতভাবে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে ভুগছে, বিশেষত খাবারের দামে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্ন করছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আশা করছে, আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে এবং মুদ্রাস্ফীতি অর্ধেকে নেমে আসবে। তবে একটি উজ্জীবিত অর্থনীতির জন্য স্থানীয় ও বিদেশি বিনিয়োগ উৎসাহিত করা, দুর্নীতি ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য মোকাবিলা এবং নতুন খাতে বৈচিত্র্য আনতে সংস্কার প্রয়োজন। অন্যদিকে আশঙ্কা করা হচ্ছে, বাংলাদেশের যুবক, ক্রমবর্ধমান সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরি করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি করবে।