‘পূর্বমুখী’ নীতি সমৃদ্ধির পথ
- আপলোড টাইম : ০৯:২২:২১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫
- / ২৭ বার পড়া হয়েছে
বন্ধুত্বের সোনালি দুয়ার : ভূ-কৌশলগত সুবিধা, পর্যটন, নিরাপত্তাসহ বহুমুখী গুরুত্ব
বেগম খালেদা জিয়ার দিক-নির্দেশনায় সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান ‘পূর্বমুখী অর্থনৈতিক-কূটনীতি’ প্রসারে মনোযোগী হন
‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছ!’ উপন্যাসের চরিত্রের মতোই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী শাসক গণঅভ্যুত্থানে পতিত পলাতক শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, যোগাযোগ-সম্পর্ক বা কানেকটিভিটি ও অর্থনীতিতে সঠিক পথ হারিয়ে বিচ্যুত হন। দেশ ও জাতিকে করেন দিকভ্রান্ত। হাসিনা দেশকে ভারতের নতজানু, মুখাপেক্ষী এবং সেবাদাসে পরিণত করেন। সাড়ে পনেরো বছরের শাসনামলে ট্রানজিট-করিডোর, অভিন্ন নদ-নদীর পানি, ভারতের স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী বা ‘বিদ্রেহাী’দের দমনসহ ভারতকে তাবৎ সুবধা দেন হাসিনা। এর বিনিময়ে দেশকে ভারত-নির্ভর এবং একচেটিয়া ভারতের বাজারে পরিণত করা হয়। সামগ্রিকভাবে ভারতের প্রভাব-বলয়ে রাখা হয়। জাতীয় স্বকীয়তা, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করে তোলা হয়। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য হাসিনা ভারতকে সবরকম সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা নিজেই স্বীকার করতেন, “আমরা ভারতকে যা দিয়েছি সেটি ভারত সারাজীবন মনে রাখবে”। এমনকি হাসিনার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছিলেন, “ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো!”।
হাসিনার একতরফা ভারতপ্রীতি ও তোষণের বিপরীতে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পশ্চিমা এবং বিশেষ করে এশিয়ার পূর্বদিকে অবস্থানকারী পৃথিবীর বিশাল অংশের দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ও স্বার্থের বিনিময় গৌণ ও চরম উপেক্ষিত হয়ে পড়ে। এরফলে বঞ্চিত হয় দেশের অর্থনীতির বিকাশ। বিশ^খ্যাত ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর রফতানি প্রসারের জন্য প্রয়োজন আন্তঃএশীয় সরবরাহ চেইনের মাধ্যমে ব্যাপক সংযোগ ও অংশগ্রহণ বৃদ্ধি। এরজন্য বাংলাদেশকে তার ‘পূর্বদিকে’র প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরালো করা অপরিহার্য’।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের অভিমত, ‘পূর্বমুখী’ (লুক-ইস্ট) যোগাযোগ সম্পর্ক বৃদ্ধির মাঝে ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি ও কূটনীতির পাশাপাশি বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা, স্বনির্ভরতাসহ বহুমুখী গুরুত্ব রয়েছে। পূর্বমুখী আন্তঃদেশীয় বন্ধুত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশের জন্য সোনালি সম্ভাবনার স্বর্ণ-দুয়ার খুলে যাবে। পূর্বমুখী নীতিতে সুসমৃদ্ধ হবে দেশের অর্থনীতি। এর মাঝেই রয়েছে বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত সুবিধা, নিরাপত্তা, পর্যটনসহ বহুমুখী গুরুত্ব। চীন, জাপান, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ পূর্বদিকের এশীয় প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগের ধারাবাহিকতা ঐতিহাসিক।
এসব দেশে বাংলাদেশের জন্য রয়েছে অবারিত আমদানি ও রফতানি বাজার সম্ভাবনা। রয়েছে সহযোগিতা বিনিময়ের সুবিশাল ক্ষেত্র। বাংলাদেশকে ‘পূর্বমুখী’ নীতি গ্রহণ না করে উপায় নেই। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান পূর্বমুখী পররাষ্ট্র নীতিকে গুরুত্ব দিতেন। তাছাড়া ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর বেগম খালেদা জিয়া ‘পূর্বমুখী’ নীতির ওপর সমধিক গুরুত্ব দিয়ে এ ব্যাপারে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। তার সরকারের অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান প্রথম ‘পূর্বমুখী অর্থনৈতিক-কূটনীতি’ প্রসারের দিকে মনোযোগী হন।
‘পূর্বমুখী’ সম্পর্ক ও নীতির গুরুত্বের বিষয়ে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ‘প্রেসিডেন্ট জিয়ার অন্তর্দৃৃষ্টি ও বাংলাদেশের পূর্বমুখী নীতি’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ‘বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে পূর্বমুখী হওয়া অথবা পূর্ব দিগন্তের উন্মোচন করা নতুন কিছু নয়। নয় বৈপ্লবিক কোন পদক্ষেপও। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জনসমষ্টির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, বাংলাদেশের পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলোর বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থা, জাতীয় নিরাপত্তার দাবি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জরুরি চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের পূর্বমুখী নীতি স্বাভাবিক এবং কাক্সিক্ষতও বটে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী যে ১০টি অর্থনীতি বিশ্বময় মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছেÑ অর্থাৎ চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ও তাইওয়ান; তাদের সাতটিই এশিয়া মহাদেশের এবং ছয়টির অবস্থান বাংলাদেশের পূর্বদিক ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। শুধু একটির অবস্থান পশ্চিমে আর তিনটি বহুদূরের, উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের। অন্যদিকে দৃষ্টি না দিয়ে শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতির এই মহাসমারোহে শামিল হওয়ার তাগিদেই বাংলাদেশের মুখ পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে ফেরাতে হবে।
আরেক দিক থেকেও বাংলাদেশের পূর্বমুখী হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর ক্ষমতা দ্বন্দ্বের প্রতিযোগিতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে ভারত মহাসাগর; পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা ও বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ভারত মহাসাগর সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে। বাংলাদেশ একদিকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ার সংযোগ বিন্দুতুল্য। অনেকটা হাইফেনের মতো। বাংলাদেশের এই কৌশলগত অবস্থান দিনে দিনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কালক্রমে তা রূপান্তরিত হচ্ছে। বাংলাদেশের গন্তব্য কোন দিকেÑ তা যদি বাংলাদেশের নিরাপত্তাবিশারদ ও অর্থনীতির প-তিরা অনুধাবনে ব্যর্থ হন, তাহলে বাংলাদেশ যে ‘ব্যাকওয়াটার’ সেখানেই পড়ে থাকতে হবে। অর্থাৎ অজ্ঞাত দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত এক ‘প্রান্তিক রাষ্ট্র’ হিসেবে থেকে যাবে।
বাংলাদেশের কৃতী রাষ্ট্রনায়ক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম বাংলাদেশের এই কৌশলগত অবস্থান সম্পর্কে সচকিত হন। তিনি ‘আমাদের পথ’ শীর্ষক এক নিবন্ধে নিজেই লিখেছেন : ‘বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে আমি কিছু বলতে চাই। উপমহাদেশ ও এই অঞ্চলের মানচিত্রের দিকে তাকালে এটা স্পষ্টতই বোঝা যায় যে ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের বিশেষ একটা গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ এই উপমহাদেশের এই অঞ্চলে সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। এর উত্তরে সুউচ্চ হিমালয় পর্বত আর দক্ষিণে সুগভীর বঙ্গোপসাগর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে পশ্চিম এশিয়ার যোগসূত্র স্থাপন করে রেখেছে বাংলাদেশ তার আপন ভূখ-রে বৈচিত্র্য দিয়ে।’
এই ‘যোগসূত্রে’র সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হলে আজ বাংলাদেশ যে পর্যায়ে রয়েছে তার বৈপ্লবিক পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশ ‘পূর্বমুখী’ হলে অবিলম্বে সুসমৃদ্ধ হবে, রাজনৈতিক দিক থেকে প্রাণবন্ত ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গতিশীল এক এলাকায়। আধিপত্য-আনুগত্যের সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে, সম-সার্বভৌমত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে, জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে, বাংলাদেশ অগ্রসর হতে পারবে অগ্রগতির বিস্তীর্ণ মোহনায়। ইউনান, মিয়ানমার, ভারতের উত্তর-পূর্বের সাতটি প্রদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হলে সম্ভাবনার শত বাতায়ন উন্মুক্ত হবে। সব কিছু ঠিকঠাক চললে লাওস, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের শেষ প্রান্ত ছাড়িয়ে সমগ্র পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ পৌঁছে যেতে পারে। এই এলাকায় বিনিয়োগ ও যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হতে পারে। এই সমগ্র অঞ্চলের সম্পদের বৃদ্ধি ঘটতে পারে প্রচুর পরিমাণে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির তীর ঘেঁষে রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ পূর্বমুখী হলে এবং সার্থকভাবে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হলে আমাদের প্রতিবেশী বিরাট ভারতের ওপর যে স্বভাবজাত আনুগত্যের প্রবণতা বিদ্যমান, তা থেকে অব্যাহতি লাভও সম্ভব হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে। বিষয়টিকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা না করেও শুধু এটুকু বলতে চাই, ভারত বিরাট প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে চীনকে খাড়া করেছে।
ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের রাষ্ট্রগুলোকে নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশকে যেভাবে তার নিরাপত্তার লক্ষ্যে ভারত ‘সীমানার বর্ধিতাংশ’ (এক্সটেন্ডেড ফ্রন্টিয়ার) রূপে ব্যবহারে মনোযোগী হয়েছে। এরজন্য তার প্রভাববলয়ের মধ্যে রাখতে সংকল্পবদ্ধ রয়েছে, সেই প্রেক্ষাপটে ভারতের সঙ্গে সুষম সম্পর্কের জন্য প্রয়োজন পূর্বদিকের ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করা। এর কোনো বিকল্প নেই। সবদিক বিবেচনা করে প্রথমে অর্থনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে অগ্রসর হলে, এরপরে অর্থনৈতিক কর্মকা-রে মাধ্যমে সৃষ্ট আস্থার মধ্যদিয়ে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার বিষয়কে সামনে আনলে, বাংলাদেশের ‘পূর্বমুখী’ অভিযান সফল হতে বাধ্য। জাতি এ ক্ষেত্রে সাফল্যকে অভিনন্দিত করার আশায় প্রহর গুনছে’।
এদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে ‘পূর্বমুখী’ যোগাযোগ-সম্পর্ক বৃদ্ধি করে একতরফা ভারত তোষণ নীতি এবং ভারত-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের দৃষ্টির সীমানা উন্মুক্তকরণের। এর ফলে পূর্ব দিকের শক্তিধর দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের অর্থবহ সম্পর্ক ও আদান-প্রদান প্রসারিত হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস পশ্চিমা বিশে^র সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধির পাশাপাশি পূর্বমুখী (লুক-ইস্ট) নীতিকে গুরুত্ব দিয়ে পূর্বের দেশসমূহের সাথে সম্পর্কের সেতুবন্ধন সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে অগ্রসর হচ্ছেন। তিনি দক্ষিণ-পূর্ব ও পূর্বের দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক জোরদারের দিকে মনোযোগী হয়েছেন। এ ক্ষেত্রে আরো কার্যকর, দ্রুততর এবং বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদগণ।