জুলাই ঘোষণা নিয়ে ঐকমত্য
সবার মতের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র তৈরি করতে চাই : প্রধান উপদেষ্টা
- আপলোড টাইম : ০৯:৩১:১৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারী ২০২৫
- / ২০ বার পড়া হয়েছে
জুলাই ঘোষণাপত্রটি সবার মতামতের ভিত্তিতেই করতে চান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট ছিল আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতীক। ওই দিন পুরো অনুভূতিটাই ছিল একতার অনুভূতি। তাই এখন কিছু করতে হলে সবার মতামতের ভিত্তিতেই করতে হবে, যাতে কেউ বলতে না পারে- তুমি অমুক। কাজেই জুলাই ঘোষণাপত্র সবার মতামতের ভিত্তিতে করতে চাই। প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে ঘোষণাপত্র করতে না পারলে এর উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর হেয়ার রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠকের শুরুতে তিনি এ কথা বলেন। বিকেল সোয়া চারটার একটু পর শুরু হয় বৈঠক। চলে পৌনে ৬টা পর্যন্ত। প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, আদিলুর রহমান খান, মাহফুজ আলম, আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া উপস্থিত ছিলেন।
এ বৈঠকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরোয়ার, এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল ও এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের গাজী আতাউর রহমান ও আশরাফুল আলম, খেলাফত মজলিসের অধ্যাপক ড. আহমেদ আবদুল কাদের, গণ-অধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর ও রাশেদ খান, এবি পার্টির ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরিফ সোহেল ও আব্দুল হান্নান মাসুদ, নাগরিক কমিটির নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি ও আখতার হোসেন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাউয়ুম, জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জুনাইদ আল হাবিবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আপনাদের সঙ্গে দেখা হলে, বসতে পারলে খুব ভালো লাগে। মনে সাহস পাই। কারণটা পরিষ্কার, এ সরকারের জন্ম হয়েছে ঐক্যের মাঝখানে, ঐক্যের দ্বারা সৃষ্টি। যখন আমরা নিজেরা নিজেরা কাজ করি, তখন দেখি একা পড়ে গেছি, আশপাশে কেউ নেই আপনারা- তখন নিজেদের একটু দুর্বল মনে করি। যখন আবার সবাই একসঙ্গে কাজ করি তখন মনের মধ্যে সাহস বাড়ে, মনে হয় একতাবদ্ধ আছি। একতাতে আমাদের জন্ম, একতাই আমাদের শক্তি’। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মাঝখানে একদিন ছাত্ররা এসে বললো তারা একটা ঘোষণাপত্র দেবে। আমাকেও সেখানে থাকতে হবে। বুঝতে চাইলাম কী ঘোষণাপত্র দিচ্ছে, তারা বলল। আমি বললাম এটা হবে না। আমার চাওয়াটা হবে না, তোমাদের চাওয়াটাও হবে না। তোমরা যদি ৫ আগস্টে ফিরে যেতে চাও, সে দিনের পরিপ্রেক্ষিতে যা হয়েছিল সেটাকে রিক্রিয়েট করতে হবে। একা এটা করা যাবে না। ওই দিনের পুরো অনুভূতিটাই ছিল একতার অনুভূতি। কেউ বলে নাই তুমি অমুক, তুমি অমুক। কাজেই তোমরা করতে চাইলে সবাইকে নিয়েই করতে হবে- এটা পরিষ্কার। না করলে এটা ঠিক হবে না’।
জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র সবার মতামতের ভিত্তিতে করার ওপর গুরুত্বারোপ করে ড. ইউনূস আরও বলেন, ‘শুধু ছাত্ররা করলে, যে একতা দিয়ে তোমরা ৫ আগস্ট সৃষ্টি করেছিলে সেটার অবমাননা হবে। তারা আমার কথায় খুব খুশি হয়নি। কিন্তু ক্রমে তারা বুঝলো ৫ আগস্ট রিক্রিয়েট করতে হলে এভাবে করতে হবে। সেই কথা থেকে এ আলাপ শুরু। আজকের আলোচনা একে কেন্দ্র করেই হবে। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে করতে না পারলে উদ্দেশ্য ব্যহত হবে। তার দরকারও নেই। ঐক্যের মাধ্যমে করলে সবার মনে সাহস আসবে।’ সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘এক থাকলে সবাই ভাববে আমরা তো জেগে আছি এখনো। আমরা ভোঁতা হয়ে যাইনি। আমাদের অনুভূতি ভোঁতা হয়নি এখনো, এখনো চাঙা আছে। আমরা জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ আছি’।
ঘোষণাপত্রের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা নিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে দেশের সামনে আসতে পারলে তা দেশের জন্য ভালো। আন্তর্জাতিকভাবেও ভালো। সবাই দেখবে যে এ জাতির মধ্যে বহু ঠোকাঠুকি হয়েছে কিন্তু নড়ে না। স্থির হয়ে আছে, শক্ত হয়ে আছে। একতার বিষয়টি সারা দুনিয়াকে জানাতে চাই, দেশবাসীকে জানাতে চাই। বৈঠকের সমাপনী বক্তব্যে অধ্যাপক ইউনূস রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে বলেন, আপনাদের সাথে একসঙ্গে বসায়-সারা জাতি আজ সাহস অনুভব করবে। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি এবং সুন্দরভাবে এর সমাধানও হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ সভায় বলেন, ‘আমি এখানে এসেছি শুধুমাত্র ডক্টর ইউনূস সরকারকে সমর্থনের জন্য। আমরা জাতিকে দেখাতে চাই যে আমরা এক আছি। সারা দেশকে দেখাতে চাই, আমাদের সামনে ফ্যাসিবাদবিরোধী যে জাতীয় ঐক্য, সেটা ঐক্য হিসেবে সুদৃঢ় হয়েছে। আমরা এক আছি। সুতরাং আমরা আমাদের ভেতরে আলোচনা করি। আর সে আলোচনার ভিত্তিতে, শক্তিশালী ঐতিহাসিক দলিল আমরা করতে পারব। কিন্তু সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে, জাতি এবং জনগণের মধ্যে এরকম কোনো বিভ্রান্তি যেন সৃষ্টি না হয় যে, আমরা প্রতিপক্ষ হয়ে গেছি সরকারের। তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ঘোষণা প্রসঙ্গের কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়া প্রয়োজন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ঘোষণার আসলেই কি প্রয়োজন আছে? এটা উপস্থাপন করে কি আমরা আবার ৫ আগস্টকে বিতর্কে আনলাম? এই জুলাই ঘোষণাপত্র কারা করবেন? কাদের তত্ত্বাবধানে এটি প্রণীত হবে? এ বিষয়গুলো জানা দরকার ঘোষণাপত্র যদি প্রয়োজন হয়, এবং প্রণীত হয়, তার লিগ্যাল ইম্প্যাক্ট কী থাকবে এবং সেটার আসলে কোথায় জায়গা হবে সেটিও দেখতে হবে। যদি ঘোষণাপত্র প্রণীত হয় এটা অবশ্যই ঐতিহাসিক দলিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটাতে কি কোনো ধরনের আইনগত প্রভাব থাকবে? সে প্রশ্নেরও সমাধান থাকতে হবে।
তিনি বলেন, সর্ববিষয়ে আমি মনে করি, আমাদের অত্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে, সময়ের বিষয়ে আমরা কেউই যেন তাড়াহুড়ো না করি। ইমোশনালি সেটা করতে গিয়ে ঐক্যের মধ্যে যেন ফাটল না ধরে সেটা লক্ষ্য রাখা সবচেয়ে বেশি জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে সবাই মিলে এই দলিল প্রণয়নের উদ্যোগ নিন। এখানে সবাইকে সম্পৃক্ত করুন। ঐক্যবদ্ধভাবে এই দলিল কিভাবে প্রণয়ন করা যায় সেটার ব্যবস্থা করুন।
সময় আরেকটু লাগবে, তবে অহেতুক কালক্ষেপণ নয়: গণ-অভ্যুত্থানে সব দলের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ বিষয়ে রাজনৈতিকদলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘সবার অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক জুলাই ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হবে। এতে সময় আরেকটু বেশি লাগবে, তবে অহেতুক কালক্ষেপণ যেন না হয়- সে জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।’ ঐকমত্যের ভিত্তিতেই জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি করা হবে বলেও জানান তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর হেয়ার রোডে ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সাথে সর্বদলীয় বৈঠক শেষে আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। আইন উপদেষ্টা বলেন, মতবিনিময়ে যারা অংশ নিয়েছেন তারা বলেছেন ঐকমত্য পোষণ করে সর্বসম্মতিক্রমে একটি ডকুমেন্ট প্রস্তুত করার জন্য সময় লাগুক, তাড়াহুড়া যেন না করা হয়, আবার অযথা কালক্ষেপণ যেন না করা হয়। কয়েকজন প্রস্তাব করেছেন এই লক্ষ্যে সংগঠিতভাবে আলোচনা করার জন্য যেন একটি কমিটি গঠন করা হয়, সেই প্রস্তাবও এসেছে। তিনি বলেন, ‘সব প্রস্তাব অ্যাক্টিভলি বিবেচনা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’ বৈঠকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জামায়াতে ইসলামী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনরা উপস্থিত ছিলেন।