চালাঘর থেকে বিভাগীয় শ্রেষ্ঠত্ব: দাওরা হাদিসের পরীক্ষা কেন্দ্র স্বীকৃতি
এক স্বপ্ন পূরণের গল্প হাজী শামসুজ্জোহা জামি’আ আরাবিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা
মাদ্রাসাটি যেন ইসলামী শিক্ষার আলো ছড়ানোর একটি কেন্দ্র- বেফাক মহাসচিব মাহফুজুল হক
- আপলোড টাইম : ১১:১৬:৩৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ জানুয়ারী ২০২৫
- / ৫১ বার পড়া হয়েছে
সময়টা ২০০১ সাল। চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার পাঁচকমলাপুর গ্রামে একটি ছোট চালাঘরে মাত্র ১৩ জন শিক্ষার্থী আর একজন শিক্ষককে নিয়ে শুরু হয় একটি ছোট দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মহাযাত্রা। প্রতিষ্ঠাতা হাজী শামসুজ্জোহা বিশ্বাসের চোখে তখন স্বপ্ন-একদিন এই মাদ্রাসা আলমডাঙ্গার শ্রেষ্ঠ মাদ্রাসায় পরিণত হবে। এখান থেকে শিক্ষার্থীরা দাওরা হাদিস সম্পন্ন করবে, আলেম হয়ে আলো ছড়াবে সমাজে। কিন্তু সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি হাজী শামসুজ্জোহা বিশ্বাস। তার প্রয়াণে যেন থমকে যেতে বসেছিল সেই স্বপ্ন। কিন্তু বাবার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে জীবনপণ লড়াই শুরু করেন তার সুযোগ্য সন্তান সাহিদুজ্জামান টরিক। অক্লান্ত পরিশ্রম আর আত্মত্যাগে তিনি মাদ্রাসাকে শুধু আলমডাঙ্গার গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রাখেননি, পরিণত করেছেন পুরো জেলা তথা খুলনা বিভাগের গর্বে।
গতকাল শনিবার সেই মাদ্রাসা থেকে ১৪ জন শিক্ষার্থী দাওরা হাদিস সম্পন্ন করেছে। এটি কেবল একটি অর্জন নয়, বরং প্রতিষ্ঠাতা হাজী শামসুজ্জোহা বিশ্বাসের স্বপ্নের পূর্ণতা। মাদ্রাসাটি শুধু দাওরা হাদিস চালু করেই থেমে থাকেনি, বরং এটি এখন দাওরা হাদীস পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবেও স্বীকৃতি পেয়েছে। যা শুধু পাঁচকমলাপুর নয়, পুরো জেলার জন্য গৌরবের।
গতকাল শনিবার পাঁচকমলাপুরে অবস্থিত এই ‘হাজী শামসুজ্জোহা জামি’আ আরাবিয়া দারুল উলুম’ মাদ্রাসায় (পূর্বের নাম: পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম কওমিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা) খতমে বুখারী ও দোয়া মাহফিলের মধ্য দিয়ে দাওরা হাদিস সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা ও পাগড়ী প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এ মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড-বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা মাহফুজুল হক (দাঃবাঃ)। তিনি শিক্ষার্থীদের মাথায় পাগড়ী পরিয়ে দেন এবং মূল্যবান দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য প্রদান করেন। গতকাল শনিবার দুপুরের পর মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আল্লামা মাহফুজুল হক বেলা সাড়ে তিনটায় মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পৌঁছান। এ সময় তিনি মাদ্রাসা ঘুরে দেখে এর কার্যক্রম সম্পর্কে খোঁজখবর নেন এবং মাদ্রাসার সুন্দর পরিবেশ উপভোগ করেন এবং মাদ্রাসার পরিবেশে মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করেন। এরপর মাদ্রাসার পরিচালক আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিকের সঙ্গে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হাজী শামসুজ্জোহা বিশ্বাস ও তার সহধর্মিণী সাহিদা বেগমের কবর জিয়ারত করেন। পরে তিনি খতমে বুখারী মাহফিলে উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদান করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘হাজী শামসুজ্জোহার মতো একজন মানুষের স্বপ্নের মাদ্রাসা আজ যে উচ্চতায় পৌঁছেছে, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এটি শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এই অঞ্চলের মানুষের জন্য ইসলামী শিক্ষার আলো ছড়ানোর একটি কেন্দ্র। প্রয়াত প্রতিষ্ঠাতার এই অবদান সবসময় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হবে। আমি এই মাদ্রাসার বর্তমান পরিচালনা পরিষদ, শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং এলাকাবাসীকে ধন্যবাদ জানাই, যারা অক্লান্ত পরিশ্রম ও আন্তরিকতার মাধ্যমে মাদ্রাসার উন্নয়নে কাজ করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘দাওরা হাদিস একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তর, যা ইসলামী জ্ঞান অর্জনের শীর্ষস্থান। যারা এই স্তর সম্পন্ন করেছে, তারা কেবল জ্ঞান অর্জন করেনি, বরং সমাজে আলোকিত মানুষ তৈরি করার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছে। আমি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা কেবল একজন আলেম নন, বরং ইসলাম ও মানবতার প্রতিনিধি। আপনাদের প্রতিটি কাজ ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য তুলে ধরবে। তাই জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি সৎ, আদর্শবান এবং মানবিক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।’
তিনি মাদ্রাসার পরিচালনা পরিষদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা শুধু একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করছেন না, বরং একটি দৃষ্টান্ত তৈরি করছেন। এই প্রতিষ্ঠানের অর্জন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দেখে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। আমি আশা করি, এই মাদ্রাসা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মানের ইসলামী শিক্ষা প্রদানের কেন্দ্রে পরিণত হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইসলামী শিক্ষার উন্নয়নে এই ধরনের উদ্যোগ কেবল একটি গ্রাম বা এলাকার জন্য নয়, পুরো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এই মাদ্রাসা আজ প্রমাণ করেছে যে সঠিক পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম এবং আল্লাহর রহমতে বড় বড় চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করা সম্ভব।’
অনুষ্ঠান শেষে বিশেষ দোয়া মাহফিলে তিনি বলেন, ‘আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, এই মাদ্রাসার সাফল্য আরও বৃদ্ধি পাক এবং এর শিক্ষার্থীরা জ্ঞান, নৈতিকতা ও মানবিকতায় যেন পৃথিবীর বুকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।’
মাদ্রাসার পরিচালক আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক বলেন, ‘আমাদের মাদ্রাসার ১৪ জন শিক্ষার্থী সফলভাবে দাওরা হাদিস সম্পন্ন করেছে। এছাড়াও বোর্ড স্ট্যান্ড করা ৮ জন শিক্ষার্থীর সাফল্য আমাদের গর্বিত করেছে। আল্লাহ’র অশেষ রহমতে আমার বাবার এই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এছাড়াও মাদ্রাসাটি এখন দাওরা হাদিস পরীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে এলাকার শিক্ষার্থীদের জন্য সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আমি সকলের কাছে আমার কবরস্থ পিতা-মাতার জন্য দোয়া প্রার্থনা করছি। আল্লাহ যেন তাদেরকে কবুল করেন এবং জান্নাত নসিব করেন।’
এছাড়াও অনুষ্ঠানে চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ এবং যশোরসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত শতাধিক মুফতি ও আলেম (শাইখুল হাদিস) উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণকে জ্ঞানগর্ভ সম্মেলনস্থলে পরিণত করে।
সফলতা এবং অতিথিদের উপস্থিতি এলাকাবাসীর মাঝে ইসলামী শিক্ষার প্রতি গভীর আগ্রহ ও ভালোবাসা সৃষ্টি করেছে। দাওরা হাদিস সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীরা হলেন- মাওলানা মাসুম বিল্লাহ, মাওলানা ইসমাইল হোসেন, মাওলানা সিয়াম হাসান, মাওলানা আবু ইউসুফ, মাওলানা হাবিবুল্লাহ মেসবাহ, মাওলানা সাফায়েত ইসলাম আজিজী, মাওলানা জুবায়ের আহমেদ, মাওলানা শামীম হুসাইন, মাওলানা আব্দুল মোমিন, মাওলানা সাইদুর রহমান, মাওলানা নাজমুল হাসান, মাওলানা ইয়ামিন আলী, মাওলানা মিয়ারুল ইসলাম ও মাওলানা আব্দুল্লাহ অরফে হৃদয় চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা জেলা উলামা পরিষদের সভাপতি মুফতি জুনাইদ আল হাবিবী, চুয়াডাঙ্গা ফজলুল উলুম মাদ্রাসার নায়েবে মোহতামিম মাওলানা জহুরুল ইসলাম আজিজী, বুজরুকগড়গড়ি মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম মুফতি আযিযুল্লাহ, কওমি পরিষদ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুফতি রুহুল আমিন, মাওলানা ইব্রাহিম হুসাইন কাসেমী, কুষ্টিয়া। এবং সমাপনী বক্তব্য দেন হাজী শামসুজ্জোহা জামি’আ আরাবিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব মোস্তাফিজুর রহমান শামীম।
এদিকে, অনুষ্ঠানে দাওরা হাদিস সম্পন্নকারী শিক্ষার্থীদের গর্বিত পিতাদেরও বিশেষ সম্মান দেওয়া হয়। প্রধান অতিথি বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা মাহফুজুল হক এবং মাদ্রাসার পরিচালক আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক গর্বিত পিতাদের মাথায় টুপি পড়িয়ে দেন এবং সকলকে অভিনন্দন জানান।
মুফতি নাফিউজ্জামানের পরিচালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তিলাওয়াত করেন মাদ্রাসার শিক্ষার্থী হাফেজ তামজীদ হুসাইন, ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশনা করেন মিহসান উদ্দীন ও রবিউল ইসলাম। অনুষ্ঠানে স্বাগতগ বক্তব্য দেন মুফতি আব্দুর রাজ্জাক, মাদ্রাসার ইতিহাস বর্ণনা করেন হাফেজ ইনারুল ইসলাম ইন্না। এছাড়াও আলোচনা করেন মাওলানা বায়জিদ হুসাইন। মাহফিল শেষে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণ উৎসবমুখর পরিবেশে পরিণত হয়। এসময় শিক্ষার্থীরা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি আল্লামা মাহফুজুল হক এবং মাদ্রাসার পরিচালক সাহিদুজ্জামান টরিককে সম্মান জানিয়ে তাঁদের সঙ্গে একে একে মুসাফা করেন।
উল্লেখ থাকে যে, দাওরা-এ-হাদিস বা দাওরায়ে হাদিস অথবা দাওরা হাদিস বা তাকমিলুল হাদিস হলো ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দরসে নিজামি দ্বারা পরিচালিত কওমি তথা দেওবন্দি মাদ্রাসামসূহের সর্বোচ্চ শ্রেণির নাম। দাওরা হাদিস সম্পন্নকারী একজন ছাত্রকে সাধারণত মাওলানা, ফাযেল/আলেম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। দারসে নিজামি অনুযায়ী প্রথম শ্রেণি থেকে দাওরা হাদিস পর্যন্ত কোর্সের ব্যাপ্তি ১৬-১৭ বছর। এর সাথে হিফজুল কোরআন যোগ করা হলে তার ব্যাপ্তি ২০ বছর পর্যন্ত হয়। বাংলাদেশে প্রথম ১৯০৮ সালে দারুল উলুম হাটহাজারিতে দাওরা হাদিস জামাত (শ্রেণি) চালু করা হয় এবং ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবিতে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান প্রদান করে।
উল্লেখ্য, চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান আলহাজ্ব সাহিদুজ্জামান টরিক, এক সময়ের সাংবাদিক ও বর্তমান বিশিষ্ট প্রবাসী ব্যবসায়ী আরিফুজ্জামান আরিফ ও দৈনিক সময়ের সমীকরণের প্রকাশক-সম্পাদক শরীফুজ্জামান শরীফের পিতা মরহুম শামসুজ্জোহা বিশ্বাস একটি সুন্দর দ্বীনি শিক্ষার ভাবনা নিয়ে ২০০১ সালে মাত্র ১৩ জন ছাত্র ও একজন শিক্ষক নিয়ে একটি চালাঘরে আলমডাঙ্গা উপজেলার খাদিমপুর ইউনিয়নের পাঁচকমলাপুর গ্রামে ‘পাঁচকমলাপুর দারুল উলুম কওমিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা’ নামে দ্বীনি শিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১০ সালে হাজী শামসুজ্জোহা বিশ্বাসের মৃত্যুর পর এই মাদ্রাসাটির পরিচালকের দায়িত্ব নেন তাঁর পুত্র সাহিদুজ্জামান টরিক। একজন সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে পিতার সুস্বপ্নকে আন্তরিকতা, ভালোবাসা, মেধা ও শ্রম দিয়ে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। মাদ্রাসাটি পরিচালনার জন্য সাহিদুজ্জামান টরিক চুয়াডাঙ্গায় তিন তারকা মানের হোটেল সাহিদ প্যালেস অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টার নির্মাণ করেছেন। সেখানে থেকে আয়কৃত সম্পূর্ণ অর্থ এ মাদ্রাসা কার্যক্রমে ব্যয় করা হয়। ২০১১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে মাদ্রাসাটিতে ছাত্রদের জন্য লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে তিন বেলা মাদ্রাসার সকল ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে বিনামূল্যে খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়।