গড়াইটুপি ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান রাজুর সরোজগঞ্জ স্কুলে চাকরি নিয়ে বিতর্ক
প্রধান শিক্ষক নিয়োগেও দুর্নীতির অভিযোগ, তদন্তের দাবি
- আপলোড টাইম : ১০:৩৬:৫৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৮৭ বার পড়া হয়েছে
চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর বন্ধ করেন বিদ্যালয়ে উপস্থিতি
চেয়ারম্যান হওয়ার পরেও শিক্ষক হিসেবে বেতন নিতেন
অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে নেন এক মাসের ছুটি
প্রধান শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘ সময় গঠন হয়নি নিয়োগ বোর্ড
গড়াইটুপি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান রাজুর সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ট্রেডের ইন্সট্রাক্টর হিসেবে চাকরি নিয়ে নতুন বির্তকের সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নিয়োগেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। দাবি করা হচ্ছে, সদর উপজেলার বড় এবং ধনী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বিষয় নিয়ে গভীর তদন্তের। তবে শফিকুর রহমান রাজু ছুটিতে নেই, তিনি বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত আছেন, বলছে বিদ্যালয় প্রশাসন। এতে করে তিনি চাকরি হারাবেন বলেই ধারণা করছেন সচেতন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, গড়াইটুপি ইউনিয়নে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইন্সট্রাক্টর শফিকুর রহমান রাজু। তিনি সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০০০ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। দলীয় প্রতীক নিয়ে ভোট করে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি আর সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যেতেন না। ওই প্রতিষ্ঠানে তিনি শিক্ষক হিসেবে এখনো আছেন, সেটাও এলাকাবাসী জানতেন না। তবে গোপনে তাকে আবারও ওই প্রতিষ্ঠানে রাখার কথা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। স্থানীয় পত্রিকার অফিসে এ বিষয়ে বেনামী লিখিত তথ্যও সরবরাহ করা হয়েছে।
দাবি উঠেছে, সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম-অসঙ্গতি খতিয়ে দেখার। অভিযোগ, ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক আকবর আলীর নিয়োগে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে এবং মেকানিক্যাল ট্রেডের ইন্সট্রাক্টর ও গড়াইটুপি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম রাজু নিয়মবর্হিভূতভাবে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার পরও তাকে পুনরায় বিদ্যালয়ে যোগদান করানোর পায়তারার। বিদ্যালয় সূত্র বলছে, চেয়ারম্যান পদ হারানোর পর শফিকুর রহমান রাজু বিদ্যালয়ে অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে এক মাসের ছুটি নেন। পরে আরও তিন মাসের ছুটি চাইলে তা তাকে প্রদান করা হয়নি।
অনুসন্ধান বলছে, ২০১৩ সালে সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অবসরে যান। সে সময় বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পান বর্তমানে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন সহকারী প্রধান শিক্ষক আকবর আলী। অভিযোগ ওঠে, ২০১৩ সালে সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যে প্রতিষ্ঠানের বাহ্যিক আয় তথা হাট-বাজার থেকে আয় হয়, সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আকবর আলীর আচরণে পরিবর্তন ঘটে। দীর্ঘদিন পরপর প্রধান শিক্ষক নিয়োগের নাটক সাজানো হয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেয়া হয়। তবে বিজ্ঞাপন দেয়া হলেও অজানা কারণে নিয়োগ কমিটি গঠন করা হয়নি। গড়িমসি করতে করতে শেষমেষ ২০২২ সালে পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। সেবার প্রধান শিক্ষক পদে খুব বেশি প্রার্থীও ছিলেন না। সেবারেই নিয়োগ বোর্ড গঠন করা হয়। তবে অভিযোগ ওঠে তৎকালীন মুজিবুর রহমান নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন। তার সাথে যোগসাজস করেই তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আকবর আলী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান।
সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আকবর আলী বলেন, ‘যখন রাজু সাহেব চেয়ারম্যান হন, তখন ইউএনও সাদিকুর রহমান ছিলেন আমাদের সভাপতি। আমি স্যারকে বলেছিলাম, তখন স্যারসহ আমি বোর্ডে ফোন দিয়ে খোঁজ নিই। তখন বোর্ড বলে, উনি যেকোনো একটা বেতন নেবেন। তখন ওনার পরিবর্তে আমরা শিক্ষক রেখেছিলাম। উনি চেয়ারম্যানের বেতন তুলতেন না। তবে শিক্ষক হিসেবে বেতন নিতেন। ওনার বেতন থেকেই ওনার পরিবর্তে রাখা খন্ডকালীন শিক্ষকের বেতন কেটে নেয়া হতো। বোর্ড আমাদেরকে বলেছিল, বাংলাদেশে বহু শিক্ষক চেয়ারম্যান আছে। আমরা এভাবে দিয়ে থাকি এটা সমস্যা না। ৫ তারিখের পর ওনার চেয়ারম্যানশীপ চলে যায়। উনি একটা আবেদন দেন অসুস্থতার জন্য ছুটির। তখন আমি ইউএনও স্যারকে বিষয়টি জানায়। যেহেতু একজন ডাক্তার লিখেছে, তখন এক মাসের ছুটি দেয়া হয়েছিল। পরে জানতে পারি, উনি অসুস্থ না। আবার অর্ধবেতনে তিন মাসের ছুটি চান উনি। আমি পরবর্তিতে ওই তিন মাসের ছুটি আর দিইনি। তিন মাসই অনুপস্থিতি দেখানো হয়েছে। গতকাল সোমবার তার তিন মাস পার হয়েছে। আমি তাকে শোকজ নোটিশ দেব। কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত দিবে। না হলে উনি কোর্টে যাবেন। তবে যা যা ঘটেছে, আমি সবটাই কোর্টে বলব। রাজুর আর বেতন হবে না। কিন্তু পড়ানোর জন্য তো শিক্ষক লাগবে। ওনার পরিবর্তে যে খন্ডকালীন শিক্ষক ছিল, তাকে এখনো রাখা হয়েছে। তার আপাতত সম্মানি ভাউচার করে স্কুল থেকে দেয়া হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাজুর বেতন দুই মাস ধরে বন্ধ রাখা আছে। স্কুলে না আসায় বেতন বন্ধ রাখা হয়েছে। ইউএনও বলেছেন, যে অনুপস্থিত, তার বেতন করবেন না। রাজু সাহেব ঢোকার চেষ্টা করলেও তিনি পারবেন না।’ প্রধান শিক্ষক হিসেবে তার নিয়োগে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘২০২২ সালের ২২ শে সেপ্টেম্বর আমি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। সকল প্রক্রিয়া নির্ধারিত নিয়মে সম্পন্ন করার পরই আমার নিয়োগ হয়। আমার নিয়োগের সময় ৬-৭ জন প্রার্থী ছিলেন। নিয়োগ বোর্ডের কর্মকর্তারা আমার নিয়োগ দিয়েছেন।’
গড়াইটুপি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও সরোজগঞ্জ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ট্রেড ইন্সট্রাক্টর শফিকুর রহমান রাজু বলেন, ‘আমি অসুস্থতার কারণে ছুটিতে আছি।’ তবে তার ছুটি মঞ্জুর হয়নি জানালে তিনি বলেন, ‘এখন আমি নিজেই জীবন শঙ্কায় আছি। এই অবস্থায় কীভাবে স্কুলে যাবো। যখন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হই, তখন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমি শুধু স্কুলের বেতন তুলতাম। তবে আমি চেয়ারম্যান হিসেবে কোনো সম্মানি উত্তোলন করিনি। আমার পিতা এবং মাতা দুজনেই চেয়ারম্যান ছিলেন। পারিবারিক সূত্রে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলাম, এতুটুকুই’।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিকাশ কুমার সাহা বলেন, ‘অনেক জায়গায় বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক চেয়ারম্যান। তারা একটি বেতন উত্তোলন করেন। আর এ নিয়ে নীতিমালায় স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। শুনেছি শফিকুর রহমান রাজু চেয়ারম্যান থাকাকালীন একটি বেতন উত্তোলন করেছেন।’
প্রধান শিক্ষক নিয়োগের সময় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার হিসেবে তিনি ছিলেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওখানে প্রধান শিক্ষক নিয়োগে কয়েকবার সার্কুলার হয়। তবে ওনারা নিয়োগ বোর্ড গঠন করেনি। এখন কেন, কী কারণে তারা বোর্ড গঠন করেননি, সেটা আমি জানি না। পরে যখন নিয়োগ হয়, তখন তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। তবে ওই পরীক্ষায় ক্যানডিডেট সে রকম ছিল না।’