দেশের সব ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস
সব ধর্মের আমরা সবাই এক পরিবার, পরিচয় বাংলাদেশি
- আপলোড টাইম : ০৮:৫৬:৪২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ৩৮ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশকে নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে নানা ধরনের চক্রান্ত, বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যমে যেসব অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে, সেটির বিরুদ্ধে দুনিয়াকে জাতীয় ঐক্যের বার্তা দিতে এবার মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের নেতাদের নিয়ে একসঙ্গে বসলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমাদের নানা মত, নানা ধর্ম থাকবে, নানা রীতিনীতি থাকবে; কিন্তু আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য। আমরা কেউ কারো শত্রু নই। আমাদের জাতীয়তা, পরিচয়ের প্রশ্নে এক জায়গায় চলে আসি। আমরা বাংলাদেশি, এক পরিবারের সদস্য।’ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে দেশের সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিয়ে কীভাবে অবাধ, সত্য তথ্য সংগ্রহ করা যায়, সে বিষয়ে তিনি ধর্মীয় নেতাদের কাছে পরামর্শ চেয়েছেন।
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে এবং পৃথিবীকে ঐক্যের বার্তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রথম বারের মতো বৈঠক করেছেন বুধবার। বৈঠকে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এর আগে মঙ্গলবার সরকারপ্রধান বৈঠক করেন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে। গতকালের বৈঠকে ধর্মীয় নেতাদের উদ্দেশে প্রফেসর ইউনূস বলেন, প্রকৃত খবরটা জানতে হবে। সেই প্রক্রিয়াটা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এত বড় দেশে যে কোনো ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু প্রকৃত তথ্য জানতে হবে, যাতে তাৎক্ষণিক সমাধান করা যায়। যেদিক থেকেই হোক দোষী দোষীই। তাকে বিচারের আওতায় আনা সরকারের দায়িত্ব।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজেদুর রহমান, হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মুহিউদ্দিন রাব্বানী, জুনায়েদ আল হাবিব ও মুনির হোসাইন কাসেমী, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের (বেফাক) মহাসচিব মাহফুজুল হক, ইসলামি বক্তা ও আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আহমদুল্লাহ, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব আবদুল মালেকসহ কয়েকজন আলেম বৈঠকে অংশ নেন। বৈঠকে হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারাও যোগ দেন।
বৈঠকের শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজকের আলোচনা খোলাখুলি, আমরা সবাই আলোচনা করব। আমাদের লক্ষ্যে কোনো গোলমাল নেই। তথ্যপ্রবাহ কীভাবে পাব, দোষীকে কীভাবে ধরব। যাতে সবাই সঠিক তথ্যটা পেয়ে যায়। এমন বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে চাই। যার নাম দিয়েছি নতুন বাংলাদেশ। এটা আমাদের করতে হবে। তিনি বলেন, মনে অনেকগুলো প্রশ্ন জেগেছে, সেই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাওয়ার জন্য আপনাদের সঙ্গে বসা। শুনলাম, এখনো সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে। তাই আমি সবাইকে নিয়ে বসলাম, এটা থেকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়।
প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণের আগে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে দেওয়া বক্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, তখন আমি বলেছিলাম, আমরা একটা পরিবার। এটাতে জোর দিয়েছিলাম। আমাদের শত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা পরস্পরের শত্রু নই। শপথ গ্রহণের পরে শুনতে আরম্ভ করলাম, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হচ্ছে। তখন মনটা খারাপ হয়ে গেল। এর পরপরই আমি ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গেলাম। সেখানেও বললাম, আমরা একই পরিবারের সদস্য। সব দাবিদাওয়া বাদ দিলেও একটা দাবি পরিষ্কার, আমাদের সবার সমান অধিকার, বলার অধিকার, ধর্মের অধিকার, কাজকর্মের অধিকার। সেটা এসেছে সংবিধান থেকে। নাগরিক হিসেবে প্রাপ্য, রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেটা নিশ্চিত করা।
বিদেশি কিছু প্রচারমাধ্যমে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে, এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখন আবার নতুন কথা, হামলা হচ্ছে, অত্যাচার শুরু হচ্ছে। আমি খোঁজ নিচ্ছি, কী হচ্ছে? সবদিকে দেখলাম, এটা (হামলা-অত্যাচার) হচ্ছে না। ভেতরে গিয়ে দেখতে হবে। সত্যটা কোথায়। প্রকৃত তথ্য, অনেক সময় সরকারি তথ্যের ওপর ভরসা করে লাভ নেই। কর্তা যা চায়, সেভাবে বলে। আসলটা মন খুলে বলতে চায় না। আমরা আসল খবরটা জানতে চাই। কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা যেন না ঘটে, প্রথমে সেই পরিবেশ সৃষ্টির ওপর জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, প্রথম কথাটা হলো ‘না হওয়ার’ পরিবেশ সৃষ্টি করা। আর হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক প্রতিকারের ব্যবস্থা করা। তথ্য সংগ্রহকারীর নিরাপত্তা এবং তথ্যদানকারীও যাতে বিব্রত না হন, তাও নিশ্চিত করতে হবে।
বৈঠক শেষে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের বলেন, সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে অপপ্রচার চললেও দেশ এগিয়ে যাবে। অপপ্রচারের বিরুদ্ধেও আমাদের একসঙ্গে লড়তে হবে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো সম্পর্কেও জনগণকে জানাতে হবে। তিনি বলেন, পতিত ফ্যাসিস্ট সরকার যে গণহত্যাকারী—ভারতকে সেটির স্বীকৃতি দিতে হবে। ভারতের ছড়ানো এসব অপতথ্য দুই দেশের জন্যই হুমকিস্বরূপ। বৈঠক শেষে গারো পুরোহিত জনসন ম্রি সাংবাদিকদের বলেন, যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে তাদের আমরা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করব, সরকারকে সহযোগিতা করব। রমনা মন্দিরের নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করেছেন। এখানে আমরা যারা বাংলাদেশে আছি কারো মধ্যে বিভেদ নেই। কিন্তু কী হচ্ছে, কোথায় হচ্ছে, কে করছে, সেটা তো জানতে হবে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কারো মধ্যেই বিভেদ নেই। বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে বাহির থেকে। আমাদের মধ্যে ঢুকে এই বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে।