ইপেপার । আজ শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন

সমীকরণ প্রতিবেদন:
  • আপলোড টাইম : ০৯:২০:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪
  • / ৩০ বার পড়া হয়েছে

CREATOR: gd-jpeg v1.0 (using IJG JPEG v80), default quality

শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্রদের সহিংসতা ও চট্টগ্রামে আইনজীবী নিহতের ঘটনাসহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার পেছনে তৃতীয় পক্ষ কিংবা চিহ্নিত অপরাধীদের ইন্ধন রয়েছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা চলছে বলেও জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আরো দায়িত্ববান হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সেনাবাহিনী। গতকাল বৃহস্পতিবার বনানীর অফিসার্স মেসে ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারের আওতায় মোতায়েন করা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান এসব কথা বলেন।
বিভিন্ন ঘটনায় ইন্ধনদাতাদের প্রসঙ্গে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। ইন্ধনদাতারা সংখ্যায় অনেক কম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা পোস্ট করেন, তাদের অনেকেই ইন্ধনদাতা নন। না বুঝেই অনেকে পোস্ট করে থাকেন। ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। কারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব কাজ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং হবে। চট্টগ্রামের আদালতে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, সেখানে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি ছিল। সে কারণে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। আরো অনেক বড় ঘটনা ঘটতে পারত, আরো খারাপ হতে পারত। ছাত্র ও শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব আন্দোলনে তিন ধরনের বিষয় চিহ্নিত করা গেছে। একটা হচ্ছে- যারা চিহ্নিত অপরাধী, যাদের কাজই অপরাধ করা, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাজ করছে। আরেকটা বড় গ্রুপ আছে যারা দেশের সাধারণ জনগণ। যেমন- গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন।
তিনি বলেন, ছাত্ররাই কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তন এনেছে। সে জন্য আমরা সবাই আশা করছি যে, দেশটা একটা ভালোর দিকে যাবে। ছাত্রদেরই একটা অংশ এখন অন্য কারো ইন্ধনে পরিস্থিতি না বুঝে আন্দোলনে নামছে। তখন তাদের প্রতি চিন্তা করে আমাদের কাজ করতে হয়। আশা করি, ছাত্ররা, শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও সাধারণ মানুষ যারা আছেন প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ জায়গা থেকে দেশটাকে কোথায় দেখতে চাই ভাবা দরকার। সেখানে আমার নিজের কী দায়িত্ব, সেটা নিজেরা বুঝবেন। ইন্ধন জাতীয় কিছু হচ্ছে কিনা- সেটা তারা যাচাই করবেন যে, এমন কিছু হয়েছে কিনা। ঘটনা সত্য হলেও এত ভায়োলেন্স করার প্রয়োজন নেই। অনেক আন্দোলনই শান্তিপূর্ণভাবে করা যায়। কারণ আমরা সবাই শান্তি চাই। আমরা যদি সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি তাহলে এমন অনেক ঘটনা আমরা পরিহার করতে পারি।
ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সার্বিকভাবে যেসব দায়িত্ব পালন করছে সেগুলো হলো- অনাকাক্সিক্ষত অরাজকতা প্রতিরোধ করা; দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা; বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কলকারখানাগুলো সচল রাখা; রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা করা; মূল সড়কগুলোকে বাধামুক্ত রাখা; অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা; অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার, মাদক কারবারি ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা; বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তার করা; পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা; কক্সবাজার জেলায় এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা বিধান করা এবং সার্বিকভাবে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে, সে জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখা। সেনাবাহিনীর এই কর্মধারা বিনা বাধায় সম্পন্ন হয়নি। গত ২০ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর ১২৩ জন সদস্য হতাহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন কর্মকর্তা শাহাদাত বরণ করেছেন। ৯ জন কর্মকর্তাসহ ১২২ জন বিভিন্ন মাত্রায় আহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় গত এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮ মাসে পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) অতর্কিত হামলায় ৭ জন সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। এসময়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিশেষ যৌথ অভিযানে কেএনএর ১৭৯ জন সক্রিয় সদস্য ও সহায়তাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে কেএনএর হাত থেকে স্থানীয় নিরীহ জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ যৌথ অভিযান গত এপ্রিল থেকেই পরিচালিত হয়ে আসছে। সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে মানবাধিকার রক্ষা করে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে এ অভিযান। তিনি বলেন, অভিযানে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ মোট ৬টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ ও সামরিক সরঞ্জামাদি (দূরবীন, ম্যাপ, আইইডি সরঞ্জাম, ওয়াকিটকি, ইউনিফর্ম, ল্যাপটপ ইত্যাদি) উদ্ধার করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর এ কর্মকর্তা আরো বলেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদবির অফিসারদের সরকার থেকে যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়, তা গত ১৫ নভেম্বর ফের ৬০ দিনের জন্য বাড়ানো হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার সুষ্ঠু এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর সব পর্যায়ের সদস্যরা সচেষ্ট রয়েছেন। গত ১৩ নভেম্বর থেকে পরের দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান তুলে ধরে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী মোট ২৪টি অবৈধ অস্ত্র এবং ৩৬৫ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৪০টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং ১৮টি সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে এবং কারখানাগুলোকে চালু রাখার জন্য মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। শিল্পাঞ্চল ছাড়াও ৬৩টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৬টি, সরকারি সংস্থা/অফিস সংক্রান্ত ১টি, রাজনৈতিক কোন্দল ৬টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ৪০টি।
যৌথ অভিযানের কথা উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা বলেন, যৌথ অভিযানে ২২৮ জন মাদক কারবারি, মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার এবং বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোট ১ হাজার ৩২৮ জন ব্যক্তিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, সারাদেশে সদ্য সমাপ্ত বৌদ্ধদের দেশব্যাপী কঠিন চীবর দান উৎসব যেন নিরাপদে পালিত হতে পারে, সে জন্য সেনাবাহিনী অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট বৌদ্ধ সংগঠন ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী মোট ৪৪৪টি বৌদ্ধ বিহারে কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই কঠিন চীবর দান উৎসব পালিত হয়েছে। নভেম্বরের ১৫-১৬ এবং ২০ তারিখে সনাতন ধর্মাবলম্বী মতুয়া গোষ্ঠীর রাসমেলা ও নবান্ন উৎসব উদ্যাপনের জন্য গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও পটুয়াখালী জেলায় নিরাপত্তা সহায়তা দেয়া হয়েছে এবং উভয় অনুষ্ঠান অত্যন্ত আনন্দ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়েছে। এছাড়া ১০-১২ নভেম্বর প্রায় ৫০ হাজার দর্শনার্থীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত বরিশালের জগদ্ধাত্রী পূজাতেও নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে।
কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনী ৩ হাজার ৪৩০ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে; যার মধ্যে ৩৫ জন এখনো সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। সিএমএইচে এ পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫৩টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ মাত্রার। এছাড়া ৪ জন গুরুতর আহত রোগীকে উন্নত সুচিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে সেনাবাহিনী।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন

আপলোড টাইম : ০৯:২০:১০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪

শ্রমিক আন্দোলন, ছাত্রদের সহিংসতা ও চট্টগ্রামে আইনজীবী নিহতের ঘটনাসহ সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার পেছনে তৃতীয় পক্ষ কিংবা চিহ্নিত অপরাধীদের ইন্ধন রয়েছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টিতে ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনার চেষ্টা চলছে বলেও জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আরো দায়িত্ববান হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সেনাবাহিনী। গতকাল বৃহস্পতিবার বনানীর অফিসার্স মেসে ইন এইড টু সিভিল পাওয়ারের আওতায় মোতায়েন করা সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কিত প্রেস ব্রিফিংয়ে মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান এসব কথা বলেন।
বিভিন্ন ঘটনায় ইন্ধনদাতাদের প্রসঙ্গে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আমাদের আরো সচেতন হতে হবে। ইন্ধনদাতারা সংখ্যায় অনেক কম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যারা পোস্ট করেন, তাদের অনেকেই ইন্ধনদাতা নন। না বুঝেই অনেকে পোস্ট করে থাকেন। ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। কারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব কাজ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং হবে। চট্টগ্রামের আদালতে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, সেখানে সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রস্তুতি ছিল। সে কারণে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। আরো অনেক বড় ঘটনা ঘটতে পারত, আরো খারাপ হতে পারত। ছাত্র ও শ্রমিকদের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এসব আন্দোলনে তিন ধরনের বিষয় চিহ্নিত করা গেছে। একটা হচ্ছে- যারা চিহ্নিত অপরাধী, যাদের কাজই অপরাধ করা, তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাজ করছে। আরেকটা বড় গ্রুপ আছে যারা দেশের সাধারণ জনগণ। যেমন- গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন।
তিনি বলেন, ছাত্ররাই কিন্তু আন্দোলনের মাধ্যমে পরিবর্তন এনেছে। সে জন্য আমরা সবাই আশা করছি যে, দেশটা একটা ভালোর দিকে যাবে। ছাত্রদেরই একটা অংশ এখন অন্য কারো ইন্ধনে পরিস্থিতি না বুঝে আন্দোলনে নামছে। তখন তাদের প্রতি চিন্তা করে আমাদের কাজ করতে হয়। আশা করি, ছাত্ররা, শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও সাধারণ মানুষ যারা আছেন প্রত্যেকেই তার নিজ নিজ জায়গা থেকে দেশটাকে কোথায় দেখতে চাই ভাবা দরকার। সেখানে আমার নিজের কী দায়িত্ব, সেটা নিজেরা বুঝবেন। ইন্ধন জাতীয় কিছু হচ্ছে কিনা- সেটা তারা যাচাই করবেন যে, এমন কিছু হয়েছে কিনা। ঘটনা সত্য হলেও এত ভায়োলেন্স করার প্রয়োজন নেই। অনেক আন্দোলনই শান্তিপূর্ণভাবে করা যায়। কারণ আমরা সবাই শান্তি চাই। আমরা যদি সবাই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করি তাহলে এমন অনেক ঘটনা আমরা পরিহার করতে পারি।
ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সার্বিকভাবে যেসব দায়িত্ব পালন করছে সেগুলো হলো- অনাকাক্সিক্ষত অরাজকতা প্রতিরোধ করা; দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা; বিদেশি কূটনীতিক ও দূতাবাসগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিল্পাঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কলকারখানাগুলো সচল রাখা; রাষ্ট্রের কেপিআই এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনাগুলোকে রক্ষা করা; মূল সড়কগুলোকে বাধামুক্ত রাখা; অবৈধ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা; অবৈধ মাদকদ্রব্য উদ্ধার, মাদক কারবারি ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা; বিভিন্ন চিহ্নিত অপরাধী ও নাশকতামূলক কাজের ইন্ধনদাতা ও পরিকল্পনাকারীদের গ্রেপ্তার করা; পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা; কক্সবাজার জেলায় এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকার নিরাপত্তা বিধান করা এবং সার্বিকভাবে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেন তাদের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে, সে জন্য স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখা। সেনাবাহিনীর এই কর্মধারা বিনা বাধায় সম্পন্ন হয়নি। গত ২০ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর ১২৩ জন সদস্য হতাহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন কর্মকর্তা শাহাদাত বরণ করেছেন। ৯ জন কর্মকর্তাসহ ১২২ জন বিভিন্ন মাত্রায় আহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় গত এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ৮ মাসে পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) অতর্কিত হামলায় ৭ জন সেনাসদস্য নিহত হয়েছেন। এসময়ে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে বিশেষ যৌথ অভিযানে কেএনএর ১৭৯ জন সক্রিয় সদস্য ও সহায়তাকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে কেএনএর হাত থেকে স্থানীয় নিরীহ জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে একটি বিশেষ যৌথ অভিযান গত এপ্রিল থেকেই পরিচালিত হয়ে আসছে। সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে মানবাধিকার রক্ষা করে সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে এ অভিযান। তিনি বলেন, অভিযানে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ মোট ৬টি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও বিপুল পরিমাণে গোলাবারুদ ও সামরিক সরঞ্জামাদি (দূরবীন, ম্যাপ, আইইডি সরঞ্জাম, ওয়াকিটকি, ইউনিফর্ম, ল্যাপটপ ইত্যাদি) উদ্ধার করা হয়েছে।
সেনাবাহিনীর এ কর্মকর্তা আরো বলেন, গত ১৭ সেপ্টেম্বর দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে সশস্ত্র বাহিনীর ক্যাপ্টেন ও তদূর্ধ্ব পদবির অফিসারদের সরকার থেকে যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেয়া হয়, তা গত ১৫ নভেম্বর ফের ৬০ দিনের জন্য বাড়ানো হয়েছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতার সুষ্ঠু এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর সব পর্যায়ের সদস্যরা সচেষ্ট রয়েছেন। গত ১৩ নভেম্বর থেকে পরের দুই সপ্তাহে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান তুলে ধরে কর্নেল ইন্তেখাব হায়দার খান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী মোট ২৪টি অবৈধ অস্ত্র এবং ৩৬৫ রাউন্ড গোলাবারুদ উদ্ধার করেছে। দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে ৪০টি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি এবং ১৮টি সড়ক অবরোধ নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে এবং কারখানাগুলোকে চালু রাখার জন্য মালিকপক্ষ, শ্রমিকপক্ষ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিজিএমইএসহ সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। শিল্পাঞ্চল ছাড়াও ৬৩টি বিভিন্ন ধরনের বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে, যার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত ঘটনা ছিল ১৬টি, সরকারি সংস্থা/অফিস সংক্রান্ত ১টি, রাজনৈতিক কোন্দল ৬টি এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ৪০টি।
যৌথ অভিযানের কথা উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা বলেন, যৌথ অভিযানে ২২৮ জন মাদক কারবারি, মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার এবং বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোট ১ হাজার ৩২৮ জন ব্যক্তিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, সারাদেশে সদ্য সমাপ্ত বৌদ্ধদের দেশব্যাপী কঠিন চীবর দান উৎসব যেন নিরাপদে পালিত হতে পারে, সে জন্য সেনাবাহিনী অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট বৌদ্ধ সংগঠন ও ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী মোট ৪৪৪টি বৌদ্ধ বিহারে কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই কঠিন চীবর দান উৎসব পালিত হয়েছে। নভেম্বরের ১৫-১৬ এবং ২০ তারিখে সনাতন ধর্মাবলম্বী মতুয়া গোষ্ঠীর রাসমেলা ও নবান্ন উৎসব উদ্যাপনের জন্য গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, পিরোজপুর ও পটুয়াখালী জেলায় নিরাপত্তা সহায়তা দেয়া হয়েছে এবং উভয় অনুষ্ঠান অত্যন্ত আনন্দ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়েছে। এছাড়া ১০-১২ নভেম্বর প্রায় ৫০ হাজার দর্শনার্থীর অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত বরিশালের জগদ্ধাত্রী পূজাতেও নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে।
কর্নেল ইন্তেখাব বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন সময়ে যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনী ৩ হাজার ৪৩০ জনকে দেশের বিভিন্ন সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে; যার মধ্যে ৩৫ জন এখনো সিএমএইচে চিকিৎসাধীন। সিএমএইচে এ পর্যন্ত দেড় হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫৩টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ মাত্রার। এছাড়া ৪ জন গুরুতর আহত রোগীকে উন্নত সুচিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে সেনাবাহিনী।