চুয়াডাঙ্গায় ‘সমাধান ফাউন্ডেশনের’ ফাঁদ, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বেকার-যুবকদের টার্গেট
চাকরির প্রলোভনে কয়েক মাসে হাতিয়েছে প্রায় ৭৪ লাখ টাকা
- আপলোড টাইম : ০৩:২৮:২৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর ২০২৪
- / ৩৪ বার পড়া হয়েছে
- সমাধানের সবকিছুই আসছে, কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়
- কাজ না আসা পর্যন্ত ঘরে বসেই মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা
- ২৪৪ জন মানুষের কাছে নেয়া হয়েছে জনপ্রতি ৩০ হাজার ৫০০ টাকা
- অনুসন্ধান বলছে, জেলার কমপক্ষে ১২০০ মানুষ ফাঁদে পা দিয়েছে
- জাতীয় এনজিও বিষয়ক ব্যুরো বা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেই
সমাধানের সবকিছুই আসছে। ৩২০ জন কর্মচারী নিয়োগ হবে, যতদিন না কাজ আসছে, ততদিন বসে বসেই বেতন হবে। কোনো সমস্যা নেই, কাজের অনেক ক্ষেত্র তৈরি হবে। ৩০ হাজার টাকায় আগেই চাকরি রাখো। মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা, সব টাকা উঠে যাবে। সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। রিসোর্ট হবে, কনজ্যুমার প্রোডাক্ট বিক্রি হবে। ভালো অফিস হবে। বসার জায়গা হবে। ইটভাটা-পানির ফ্যাক্টরি বসানো হবে। ওয়েবসাইটের কাজ চলছে। তবে সবই আসছে, সবই হবে, এখন টাকা দিয়ে শুধুই অপেক্ষা। এমনি এক ফন্দি এঁটে বসেছে ‘সমাধান ফাউন্ডেশন’ নামে একটি এনজিও। কাজের কোনো হদিস নেই, শুধু আছে আশা আর ভরসা। তবে অনুসন্ধান ও তথ্য বলছে, প্রতারণার অভিনব ফাঁদ এটি। ডিসেম্বরেই পালিয়ে যাবে চক্রটি। বিগত কয়েক মাসে তারা ২৪৪ জন মানুষের কাছে থেকে ৩০ হাজার ৫৫০ টাকা করে প্রায় ৭৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তবে অনুসন্ধান ও সূত্র বলছে, চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে কমপক্ষে ১২০০-এর ওপরে নারী-পুরুষ তাদেরকে ৩০ হাজার ৫৫০ টাকা করে দিয়েছে।
তবে প্রশ্ন উঠেছে, এনজিওটির কার্যক্রম নিয়ে। মূলত কোনো কাজ না থেকেও শুধুমাত্র একটি দোকানে অফিস খুলে বসেই কয়েকজন দিচ্ছেন ‘সমাধান’ নামে ওই এনজিওতে চাকরি। এনজিও নিবন্ধন থেকে শুরু করে, সবকিছু নিয়েই বেঁধেছে রহস্যের দানা। স্পষ্ট করে বলতে পারেন না স্বয়ং প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে জনমনে উঠেছে নানা প্রশ্ন। সচেতন মহলের দাবি, প্রতিষ্ঠানটির নিবন্ধন ও যাবতীয় কার্যক্রম যাচাই-বাছাই করার। মানুষ যেন ভুয়া ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারণার শিকার না হয়, সে জন্য জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপের দাবি উঠেছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চুয়াডাঙ্গা শহরের একাডেমি মোড়ে অবস্থিত মোহম্মদী শপিং কমপ্লেক্সের একটি দোকানে ‘সমাধান’ নামে একটি এনজিও’র অফিস দেয়া হয়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে তারা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে এবং চাকরি প্রার্থীদের থেকে এককালীন ৩ হাজার ৫৫০ টাকা ডোনেশন নিচ্ছে। মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে এই নিয়োগে বলা হয়েছে, ডিসেম্বর অবধি লোকবল সংগ্রহ ৩০০ জন হলে আগামী জানুয়ারি মাস থেকে সুপারশপসহ বিভিন্ন কৃষি, পশুপালন খাতে এ সকল কর্মীদের নিযুক্ত করা হবে।
সমাধান ফাউন্ডেশনের ট্রেড লাইসেন্স মাত্র ২০ দিন আগে অর্থাৎ ৭ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে ইস্যুকৃত। লাইসেন্সটি প্রতিষ্ঠানের মালিক খন্দকার মেহেদী হাসানের নামে ঢাকা সিটি করপোরেশন থেকে নেয়া। এবং তাতে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ব্যবসায়ের ধরণ সরবরাহকারী। অথচ প্রতিষ্ঠানটি বছরের পর বছর ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। ট্রেড লাইসেন্স যা করা হয়েছে, তাতে শুধুমাত্র তারা ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মধ্যে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারবে, অন্য এলাকায় নয়। প্রতিষ্ঠানের নাম ‘সমাধান গ্রুপ’, চালানো হচ্ছে ‘সমাধান ফাউন্ডেশন’-এর নামে।
সরবরাহকারী হিসেবে নিবন্ধিত এ প্রতিষ্ঠান মানবসম্পদ উন্নয়ন ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে অসংখ্য মানুষের টাকা হাতিয়ে নিলেও এখন পর্যন্ত কোনো ভিত্তিমূলক কার্যক্রম দেখাতে পারেনি। বরং চলছে এমএলএম স্কিমে, অর্থাৎ চাকরিপ্রার্থীর ডোনেশনের টাকাতেই পুরানো কর্মীদের বেতন চলছে। নিজেদের কখনো চেইন কোম্পানি, কখনো এনজিও হিসেবে পরিচয় দিলেও জাতীয় এনজিও বিষয়ক ব্যুরো বা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমোদন তাদের নেই।
এনজিওটির দাবি, চুয়াডাঙ্গার মধ্যে মাত্র বিগত কয়েক মাসে তারা ২৪৪ জন মানুষের কাছে থেকে ৩০ হাজার ৫৫০ টাকা নিয়েছে তারা। যা মোট হিসেবে ৭৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা। তবে একটি অনুসন্ধান ও সূত্র বলছে, চুয়াডাঙ্গা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে কমপক্ষে ১২০০ এর ওপরে নারী-পুরুষ তাদেরকে ৩০ হাজার ৫৫০ টাকা করে দিয়েছে। চলতি বছর ডিসেম্বরেই এরা পালিয়ে যাবে। সমাধান ফাউন্ডেশন নামে বাংলাদেশে আরও দুটি প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে, যাদের কর্মকাণ্ড এবং লোগো কোনোটিই চুয়াডাঙ্গার সমাধান ফাউন্ডেশনের সাথে মেলেনি।
চুয়াডাঙ্গা জেলা সমাজসেবা অফিস এই সমাধান ফাউন্ডেশনের কথা জানে না। নিজস্ব ওয়েবসাইট না থাকলেও সাইনবোর্ডে একটি ওয়েবসাইটের ঠিকানা দেওয়া আছে, যেটাতে ঢুকলে একটি এনজিওর কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে। নগদ ৩০ হাজার ৫৫০ টাকা নেওয়া হলেও কথিত ডোনেশন প্রক্রিয়ায় টাকা প্রাপ্তির রশিদে লেখা হচ্ছে ৩০ হাজার টাকা। অফিস খরচ ও ভিজিটিং কার্ড বাবদ বাকি ৫৫০ টাকা রাখা হচ্ছে বলে সমাধান ফাউন্ডেশন জানিয়েছে।
সংগঠনটির অফিস মোহম্মদী শপিং কমপ্লেক্সে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি চেয়ার ও দুটি টেবিল নিয়ে একটি দোকানকে অফিস বানানো হয়েছে। যেখানে সেই প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বা বেচা-বিক্রির কোনো পণ্য নেই। প্রতিষ্ঠানটিতে অর্গানাইজার হিসেবে মাহবুবুর রহমান নামে একজনকে পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘সমাধান সেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠান। জেলার বিভিন্ন স্থানের বহু চাকরি সন্ধানীকে মাত্র ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে চাকরি দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। ৩০ হাজার টাকা ডোনেট করে একটি মেম্বারশিপ নিতে হবে। ৩০ হাজার ৫৫০ টাকার মানি রিসিভ দেয়া হবে। প্রত্যেকটি জেলায় সুপার শপ হবে। প্রোডাক্ট সব রেডি হচ্ছে। প্রত্যেক ইউনিয়নে সেল হবে। প্রোডাক্টের লিস্ট এখনো আসেনি। আমাদের চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মেহেরপুরে কার্যক্রম চলমান আছে। পরবর্তীতে আমাদের পরিকল্পনা হচ্ছে, কেউ ধান করবে, আমরা ধানের জন্য টাকা দেব। ওই ধানটাই আবার আমরা সরাসরি কিনব। এমন একটি প্লান আছে। পুরো জেলায় বর্তমানে ২৪৪ জন সদস্য। যথাসম্ভব আমাদের ৩২০ জন লাগবে। ৩০ হাজার টাকা কোম্পানিকে ডোনেট করা হচ্ছে। এটা আর কেউ ফেরত পাবে না। যে বেতনটা হবে ‘সমাধান’ গ্রুপ থেকে দেবে।’
৪ মাস ধরে নিয়োগ দিচ্ছেন, তাহলে যারা প্রথম দিকে নিয়োগ পেয়েছেন, তারা বর্তমানে কী কাজ করছেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘কোম্পানির কথা প্রজেক্ট চালু হবে জানুয়ারি থেকে। এখন বর্তমানে সবাই মাঝে মধ্যে অফিসে আসবে। আমাদের কথাবার্তা শুনবে। আমাদের নির্দেশনা শুনবে। অর্গানাইজারদের একটি করে ইউনিট করে দেবে। কোম্পানির কথা টাকার ঘাটতি থাকবে না। আমাদের হজ্ব প্যাকেজ, রিসোর্ট আছে। ওখান থেকেও টাকা আসবে।’
কোম্পানির ওয়েবসাইট আছে কি? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওয়েবসাইটের কাজ চলমান। এখনো সেখানে ঢোকা যাচ্ছে না। আমাদের কোম্পানির প্লান আছে, এখানে একটি পানির ফ্যাক্টরিও করবে। অলরেডি নীলমণিগঞ্জে আমরা দুইটা ভাটাসহ দেখছি, অটোব্রিকস করার জন্য। পানির ফ্যাক্টরির জায়গাও এখনো নেয়নি, তবে নেবে।’ চুয়াডাঙ্গার দায়িত্বে কে আছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফকিরপাড়ায় বাড়ি চুয়াডাঙ্গার সোহেল আলী। তিনি আগে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসনা করতেন। তিনি চুয়াডাঙ্গার দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তাকে সারাদেশের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’
সোহেল আলীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সোহেল আলী বলেন, ‘ডোনেশন দিয়ে আমাদের মেম্বার হচ্ছে। আমরা তাদেরকে প্রত্যেক মাসে ১৫ হাজার টাকা করে স্যালারি দিচ্ছি। আমরা জানুয়ারি থেকে সুপারশপ রানিং করব। সমাধান গ্রুপ অব কোম্পানি বেতন দিচ্ছে।’ এসময় সোহেল আলী একজনের নাম খন্দকার মেহেদী হাসান এবং তিনি চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে তার কাছে মুঠোফোন প্রদান করেন। মুঠোফোনে খন্দকার মেহেদী হাসান বলেন, ‘এখন সারা দেশে আমরা ১১ হাজার অর্গানাইজার নিচ্ছি। কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য একেকজন প্রতিনিধি নিচ্ছি। আমাদের যে সমস্ত কনজ্যুমার প্রোডাক্ট আছে, সেগুলো বিক্রি করা হবে। প্রত্যেকটা জেলাভিত্তিক আমরা রিসোর্ট তৈরি করব।’
তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি আমাদের উদ্বোধনে থাকবেন।’ জেলা প্রশাসকের সাথে কথা হয়েছে কবে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে কথা ঘোরানোর চেষ্টা করেন। এবং পরে কথা ঘুরিয়ে নিয়ে তিনি বলেন, আগামীকাল জেলা প্রশাসক অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে। আমাদের সচিবের বন্ধু ডিসি।’ তিন মাস আগে নিয়োগ হয়েছে, বসিয়ে কীভাবে বেতন দিচ্ছেন, সেটা জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেননি। তবে তিনি বলেন, ‘আমার পলিসির সাথে অন্য কোনো কোম্পানির মিল পাবেন না।’
ওয়েবসাইট আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের ওয়েবসাইট আছে। সেখানো প্রোডাক্টগুলোর ডিসপ্লে করা হচ্ছে।’ তবে ওয়েবসাইটের লিংক চাইলে তিনি দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আপনার কাছে আমি কোনো কিছু দিতে বাধ্য নই। তদন্ত হলে নির্ধারিত জায়গায় দেব। আপনি পারলে নিউজ করেন।’
এদিকে সচেতন মহল বলছেন, একটি প্রতিষ্ঠান কাজ না করেই বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবে। আবার ডোনেশনের নামে ৩০ হাজার করে টাকা নেবে। নিশ্চয় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে ভেজাল আছে। এটি যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। পরে টাকা নিয়ে উধাও না হয়ে যায়। আর আদৌ প্রতিষ্ঠানটির কোনো নিবন্ধন আছে কি না, বা থাকলে সেটা কী হিসেবে? সেগুলো জেলা প্রশাসনের তদারকি করা প্রয়োজন। যেটাই হোক, ডোনেশনের নামে ৩০ হাজার টাকা করে নেয়াটা ঠিক নয়। এর মধ্যে ঝামেলা আছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের বাসিন্দা আশিকুজ্জামান নামে একজন বলেন, ‘আমার কয়েকজন পরিচিতজন চাকরি নিয়েছে। আমি শুনে বিষয়টির খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম। তবে তারা যা বলছে, তাতে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগছে না। আপাতত তাদের কাছে কোনো কাজও নেই। আমি সবকিছু শুনে ঘুরে চলে এসছি।’
আরেকজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে বলেন, ‘সেখানে কয়েকজন মূর্খ বসেছে। তারা কীভাবে চাকরি দিচ্ছে। চুয়াডাঙ্গার যারা এই কাজ করছে, তারা নিজেও জানে না, ভূগোল বুঝিয়ে তারা আসলে টাকা তুলছে। তবে টাকা যদি কোম্পানি মেরে দেয়, তখন তাদের কী হবে? আর সেখানে বেকাররাই যাচ্ছে চাকরির আশায়। চাকরি পাবে ভেবে টাকা দিচ্ছে। তখন যদি চাকরি না হয়, আবার টাকা হারাতে হয়, এই অসহায় বেকার যুবকদের দেখবে কে। এটা অতিদ্রুত যাচাই করতে হবে। সমাধানের সমাধান করা প্রয়োজন। এ জাতীয় গজিয়ে ওঠা ফাউন্ডেশন মানুষের আবেগ নিয়ে প্রতারণা করে প্রচুর টাকা হাতিয়ে নেয়, ইতোপূর্বে ডেসটিনির কেলেংকারি তার উত্তম উদাহরণ। আর চুয়াডাঙ্গার মানুষ বারবার কেন ফাঁদে পা দেয়?