সরকারের নানামুখী উদ্যোগ: তবুও স্বস্তি ফেরেনি বাজারে
- আপলোড টাইম : ১০:০০:৫৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪
- / ৩২ বার পড়া হয়েছে
বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল, তেল, চিনি, পেঁয়াজ, আলু ও ডিম আমদানিতে শুল্ক ছাড় দিয়েছে অর্ন্তর্বর্তী সরকার। টাস্কফোর্স গঠন করে বাজার, আড়ত, বৈধ-অবৈধ গুদামসহ বিভিন্ন স্পটে চালানো হচ্ছে সাড়াশি অভিযান। ন্যায্যমূল্যে ১০টি পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করছে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়। ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ট্রাকসেল কার্যক্রম জোরদার করেছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। বেঁধে দেওয়া হয়েছে বেশকিছু নিত্যপণ্যের দামও। বাজারে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। তবে সরকারের নানামুখী এসব পদক্ষেপের পরও বাজারে স্বস্তি ফেরেনি বরং মাছ, কাঁচামরিচ ও ব্রয়লার মুরগিসহ বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভোক্তারা বাজারে গিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজার সংস্কারের সুষ্ঠু কোনো পরিকল্পনা না থাকায় নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়ার পরও দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে শুল্কছাড় ও টাস্কফোর্স গঠন করে অভিযান পরিচালনাসহ ধরাবাঁধা গুটিকয়েক পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়। এজন্য বাজারব্যবস্থাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানো জরুরি।
কনজ্্ুযমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, শুল্ক কমানোর পর এর সুবিধা একটি পক্ষ নিয়ে নিচ্ছে, ভোক্তারা পাচ্ছেন না। শুল্ক সুবিধা কারা নিয়ে যাচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কঠোরভাবে নজরদারি করতে হবে। সরকার এখন শুধু খুচরা পর্যায়ে তদারকি করছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য উৎপাদক, পাইকারি ও খুচরা- এই তিন স্তরেই তদারকি জরুরি। অথচ বাস্তবে তা হচ্ছে না।
সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে ও বাজারে নিয়ন্ত্রণ আনতে গত ৭ অক্টোবর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার ও সরবরাহ পরিস্থিতি তদারকি এবং পর্যালোচনার জন্য জেলা পর্যায়ে ১০ সদস্যের বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া, নিয়মিত বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। পাশাপাশি বাজার নিয়ন্ত্রণে ৬টি পণ্যের আমদানি শুল্কে ছাড়ও দেওয়া হয়েছে। শুল্ক হ্রাস করা এসব পণ্যের মধ্যে শুধু ডিমের দাম কমেছে। বাজারে বাকি পাঁচ পণ্যের দাম এখনো ঊর্ধ্বমুখী। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি এবং শুল্ক ছাড়ে কেনা অধিকাংশ পণ্য এখনো দেশে এসে না পৌঁছানোর কারণে দাম কমছে না।
এদিকে, দেশের ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিনের দাম বাড়ার দাবি করলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা জানান, প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১ হাজার ১০৫ ডলার। গত আগস্টে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩১ ডলারে। আবার কিছুটা বেড়ে সেপ্টেম্বরে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৪ ডলারে। তবে সার্বিকভাবে তেলের দাম নিম্নমুখী। গত ডিসেম্বরের তুলনায় সয়াবিনের দাম কমেছে ৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশের বাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী।
অন্যদিকে বিক্রেতারা চাহিদা দিয়েও অনেক কোম্পানির কাছ থেকে চাহিদামাফিক বোতলজাত সয়াবিন তেল পাচ্ছে না বিক্রেতারা। ১০ কার্টন তেল চাহিদা দিলে দুই কার্টন তেল দেওয়া হচ্ছে। কোম্পানিগুলো ইচ্ছা করেই এমনটা করেছে- যাতে রোজার আগে ভোজ্যতেলের দাম বাড়িয়ে বাড়তি মুনাফা করতে পারে। এতে খোলা তেলের চাহিদাও বেড়েছে। ফলে কিছু বিক্রেতা খোলা তেলের দাম বেশি হওয়ায় বোতলজাত তেলের মুখ খুলে খোলা তেলের ড্রামে ঢেলে বিক্রি করছেন। এতে বাজারে বোতলজাত তেলেরও সংকট দেখা দিয়েছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, রোজা যত ঘনিয়ে আসছে, ভোজ্যতেলের বাজারে অসাধু চক্রের কারসাজি তত বাড়ছে। কোমর বেঁধে সক্রিয় হচ্ছে সেই পুরনো সিন্ডিকেট। পরিস্থিতি এমন- রোজা শুরুর চার মাস আগেই কোম্পানিগুলো মিল পর্যায় থেকে তেলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে। ডিলারের কাছে সরবরাহ কমিয়েছে। এতে ডিলার থেকে খুচরা বাজারে সরবরাহ কমিয়ে বাড়ানো হচ্ছে দাম। অথচ তেলের দাম সহনীয় রাখতে ১৭ অক্টোবর পাম ও সয়াবিন তেলের মূল্য সংযোজন কর ১৫ শতাংশ কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এছাড়া উৎপাদন ও ব্যবসা পর্যায়ে সয়াবিন ও পাম তেলের মূল্য সংযোজন কর অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সুবিধা কার্যকর থাকবে। তবে মাসের ব্যবধানে লিটারে ২০ টাকা বেড়ে খোলা সয়াবিন খুচরা বাজারে ১৮৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আর লিটারে ৩ টাকা বেড়ে বোতলজাত বিক্রি হচ্ছে ১৬৭-১৭০ টাকা। সঙ্গে ১৫ দিনের ব্যবধানে পাম তেল ও রাইসব্রান তেলের দামও লিটারে ৬ থেকে ২০ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। এতে আসন্ন রোজায় বাজার আরও অস্থির হওয়ার আশঙ্কা করছেন ভোক্তারা।
এ প্রসঙ্গে কনজ্্ুযমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, রোজা ঘিরে কয়েক বছর ধরে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট একটি পন্থা অবলম্বন করছে। রোজায় দাম না বাড়িয়ে রোজা শুরুর তিন থেকে চার মাস আগেই পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাখছে। এতে রোজায় ক্রেতারা বাড়তি দরেই পণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। আর অতি মুনাফা লুফে নিচ্ছে সেই চিরচেনা সিন্ডিকেট। তাই এখন থেকেই কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে।
এদিকে গত ৮ অক্টোবর পরিশোধিত ও অপরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করেছে এনবিআর। নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৫০ শতাংশ হ্রাস করা সত্ত্বেও বাজারে পরিশোধিত চিনির সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এক সপ্তাহের মধ্যে পুনরায় পরিশোধিত চিনির ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক প্রতি টন ৬ হাজার টাকা থেকে কমিয়ে প্রতি টন ৪ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করেছে।
পরিশোধিত চিনির ওপর আমদানি শুল্ক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে কমানোর ফলে পরিশোধিত চিনি আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ বাড়বে এবং চিনির মূল্য সহনশীল পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে বলে আশা করেছিল এনবিআর। তবে বাজার পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকায় যা গত সপ্তাহে ছিল ১৩০-১৩৫ টাকা।
এদিকে চালের ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ, বিদ্যমান রেগুলেটরি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং বিদ্যমান ৫ শতাংশ আগাম কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেছে এনবিআর। সংস্থাটি জানায়, চাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক/কর হ্রাসের ফলে প্রতি কেজি চালের আমদানি ব্যয় ১৪.৪০ টাকা কমবে। আমদানি শুল্ক ও রেগুলেটরি শুল্ক হ্রাস এবং আগাম কর প্রত্যাহারের ফলে বাজারে চালের সরবরাহ বাড়বে।
তবে বাজারের চিত্রে উঠে আসে, গরিবের আহার মোটা চালের কেজিতে তিন টাকা বৃদ্ধির পাশাপাশি সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চালের দামই কেজিতে বেড়েছে অন্তত পাঁচ টাকা। খুচরায় প্রতি কেজি আটাইশ চালের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬২-৬৫ টাকা। অথচ সাত দিন আগেও যা বিক্রি হয়েছে ৫৬-৫৮ টাকায়। আর পাঁচ টাকা বেড়ে মিনিকেটের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭২-৭৫ টাকায়। এছাড়া নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৭৬-৮২ টাকায়।
গত ৫ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে এনবিআর জানায়, পেঁয়াজ আমদানিতে বিদ্যমান ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে যা বহাল থাকবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। একই দিন আলু আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে এনবিআর। একই সঙ্গে আলু আমদানিতে যে ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ছিল তা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়। আলু আমদানিতে এ শুল্ক সুবিধা বহাল থাকবে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত।
অথচ প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে বাড়ছে আলু-পেঁয়াজের দাম। এর মধ্যে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়লেও আলুর দাম বাড়ছে ধীরগতিতে। গত সপ্তাহে প্রতি কেজিতে দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়েছিল ১০-২০ টাকা। তার আগের সপ্তাহেও একই পেঁয়াজের একইরকম দাম বেড়েছিল। এখন বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকা কেজি দরে।
এদিকে গত সপ্তাহে লাল ও সাদা আলুর দাম বেড়েছিল প্রতি কেজিতে ৫ টাকা করে। চলতি সপ্তাহে বেড়েছে আরও ৫ টাকা। সে হিসাবে লাল ও সাদা আলু বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা কেজি। আর বগুড়ার আলুর দাম ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়।
অথচ পেঁয়াজ ও আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে টিসিবি এবং কৃষি মন্ত্রণালয় ট্রাকসেল কার্যক্রম বাড়িয়েছে। শুধুমাত্র ঢাকাতেই ৫০টি স্পটে টিসিবি ৩০ টাকা দরে আলু বিক্রি করছে। ৯ অক্টোবর থেকে টিসিবি ৩৫ টাকা দরে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। যদিও প্রতিটি পরিবারকে সর্বোচ্চ দুই কেজি করে পেঁয়াজ দেওয়া হচ্ছে।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ক্রমাগত আলু-পেঁয়াজের দাম বেড়ে চললেও মনিটরিংয়ের দিকে নজর নেই সংশ্লিষ্টদের। বাজারে যে আলু ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে তা পাড়া-মহলস্নার দোকানে বা ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে বিক্রি বিক্রি হচ্ছে ৭৫-৮০ টাকা পর্যন্ত। একই চিত্র পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও।