শিশুর কাঁধে বইয়ের বোঝা!
- আপলোড টাইম : ০২:৪৯:০১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪
- / ৪৫ বার পড়া হয়েছে
- এনসিটিবি নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের অতিরিক্ত বই পড়াচ্ছে বিদ্যালয়গুলো
- আট বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা
প্রথম শ্রেণিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নির্ধারিত পাঠ্যবই আটটি। কিন্তু অধিকাংশ নামিদামি স্কুলে প্রথম শ্রেণির শিশুদের পড়ানো হয় আরো দুই থেকে পাঁচটি বই বেশি। অতিরিক্ত বই, ক্লাসের খাতা, স্কেল বাক্স, পানির বোতল, টিফিন বক্স-সব মিলিয়ে স্কুল ব্যাগের ভার বইতে বইতে ছাত্রছাত্রীরা সত্যিই ক্লান্ত। দিনের পর দিন ছোট ছোট বাচ্চার পিঠে এই স্কুল ব্যাগের বোঝা ক্রমশই যেন বেড়ে চলেছে। রাজধানীর একটি সচরাচর দৃশ্য, ব্যাগের ভারে কুঁজো হয়ে হাঁটছে শিশু, নয়তো ছেলেমেয়ের ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে চলেছেন তাদের মা-বাবা কিংবা অভিভাবক। বিভিন্ন নামি স্কুলের প্রথম শ্রেণির শিশুর ব্যাগের ওজন তিন কেজির বেশি। আবার ইংলিশ ভার্শনে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন গড়ে চার কেজির বেশি। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন পাঁচ কেজির বেশি। এক্ষেত্রে আট বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা। ফলে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। একটি শিশুর ওজনের ১০ শতাংশের বেশি তার স্কুল ব্যাগের ওজন হবে না। এটা হাইকোর্টের আদেশ। এজন্য আইন-বিধিমালা প্রণয়নে আদালতের নির্দেশনা আছে। কিন্তু তার পরও স্কুল ব্যাগের ওজন থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশুরা। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের স্কুল ব্যাগের ওজন তার শরীরের ওজনের শতকরা ৩০ ভাগেরও বেশি। হাইকোর্টের বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও আশিস রঞ্জন স্কুল ব্যাগ নিয়ে এই রায় দেন ২০১৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর। এ রায়ের পর আইন না করা এবং নির্দেশনা না মানায় সংশ্লিষ্টরা একটি আদালত অবমাননা আবেদনও করেছিলেন। সেটি এখনো শুনানির অপেক্ষায় আছে।
শিশুদের জন্য প্রথম শ্রেণিতে এনসিটিবির পাঠক্রম অনুযায়ী নির্ধারিত পাঠ্যবই হলো- ইংরেজি, বাংলা, প্রাথমিক গণিত, পরিবেশ পরিচিতি সমাজ ও বিজ্ঞান, সংগীত, শারীরিক শিক্ষা, চারু ও কারুকলা এবং ধর্ম। তবে মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রথম শ্রেণির শিশুদের পড়ানো হয় অতিরিক্ত আরো দুটি বই। রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলে প্রথম শ্রেণির শিশুদের পড়ানো হয় অতিরিক্ত চারটি বই। এর মধ্যে বাংলা বিষয়ে দুটি ও ইংরেজির দুটি। অতিরিক্ত চারটি বই ও স্কুল কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত খাতা, কলম, স্কেল বক্স, পানির বোতল-সব মিলিয়ে ব্যাগের ওজন তিন কেজির বেশি। শুধু প্রথম শ্রেণি নয়, বিভিন্ন শ্রেণিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের বাইরে অতিরিক্ত বই রয়েছে। পঞ্চম শ্রেণিতে অতিরিক্ত পাঁচটি বই পড়ানো হয়। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলেও পড়ানো হয় অতিরিক্ত বই। শুধু এ তিনটা স্কুল নয়, ঢাকা ও বিভাগীয় শহরের বেশির ভাগ স্কুলেই বাড়তি বই পড়তে বাধ্য করা হয় শিক্ষার্থীদের। যদিও আইনে এটি নিষিদ্ধ। তার পরও বছরের পর বছর ধরে শিশুদের অতিরিক্ত বই পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। রাজধানীর কয়েকটি স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শ্রেণিভেদে দুই থেকে পাঁচটি অতিরিক্ত বই পড়ানো হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, অতিরিক্ত বই বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে কোনো কোনো স্কুল নিজেরা বইয়ের ব্যবসা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্কুল সরাসরি বই বিক্রি করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বইয়ের দোকান ঠিক করে দেয়, যেখান থেকে সুবিধা পায়। বাড়তি বই পড়ানোর মাধ্যমে শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্যও উত্সাহিত হয়। শিক্ষাবিদরা বলেন, শিক্ষার্থীর বয়স ও বিকাশের কথা বিবেচনা করে পাঠ্যবই ও পাঠগুলো নির্ধারণ করা হয়। এর অতিরিক্ত বই বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হলে তা ক্ষতির কারণ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হালিম বলেন, দেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা পরিবর্তন করা উচিত। শিশুদের স্কুল সময় হওয়া উচিত সকাল ৮টা বা ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। শিশুরা শিখবে, পড়বে, খেলবে এবং দুপুরের খাওয়া-দাওয়া স্কুলেই করবে। শিক্ষাবিদরা বলেন, কোন শ্রেণিতে কয়টি বই পড়ানো হবে, তা নির্ধারণ করে দেয় এনসিটিবি। সেটি ঠিক করার জন্য শিক্ষাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটিও রয়েছে। প্রাক্-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পাঠ্যবই দেয় সরকার। এনসিটিবির আইনে বলা আছে, বোর্ড কর্তৃক পাঠ্যপুস্তক প্রণীত ও প্রকাশিত নয় অথবা পাঠ্যপুস্তক হিসেবে অনুমোদিত নয়, এমন কোনো পুস্তককে কোনো বিদ্যালয়ের জন্য পাঠ্যপুস্তক হিসেবে নির্ধারণ করা যাবে না।
রাজধানীর একটি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত বই পড়ানোর বিষয়ে গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, ‘ভালো কিছু শেখানোর জন্যই অতিরিক্ত বই পড়ানো হচ্ছে। এটা এখানকার সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত।’ এ ব্যাপারে জানতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে এই স্কুলের প্রথম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অতিরিক্ত বই পড়ানোর বিরুদ্ধে অভিভাবকদের আসলে কিছুই করার নেই। তারা অসহায়। এটি বন্ধ করতে হলে সব স্কুলে একসঙ্গে বন্ধ করতে হবে। উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, শিশুদের অতিরিক্ত বই পড়ালেই দক্ষতা বাড়ে না; বরং অনেক সময় শেখার প্রতি বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। যা তিনি তার সন্তানের মধ্যে দেখতে পাচ্ছেন।
নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের বাইরে অতিরিক্ত বই পড়ানো বন্ধের দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি), প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও এনসিটিবির। কিন্তু তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির একজন কর্মকর্তা বলেন, যেসব বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর অতিরিক্ত বই চাপিয়ে দিচ্ছে, তারা শুধু বেআইনি কাজই করছে না, শিক্ষার্থীদের ওপর চাপ তৈরি করছে। একইভাবে বৈষম্যেরও সৃষ্টি করছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, পাঁচ বছরের একটি ছেলেশিশুর আদর্শ ওজন ১৮ দশমিক ৭ কেজি, আর মেয়ের ১৭ দশমিক ৭ কেজি। ছয় বছরের একটি ছেলেশিশুর আদর্শ ওজন ২০ দশমিক ৬৯ কেজি আর মেয়ের ১৯ দশমিক ৯৫ কেজি। সে হিসাবে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীর ব্যাগের ওজন তার শরীরের ওজনের ১০ শতাংশ অর্থাত্ সর্বোচ্চ দুই কেজি হওয়ার কথা। সেখানে ঢাকার খ্যাতনামা বিভিন্ন স্কুলে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ব্যাগের ওজন পাওয়া গেছে সর্বনিম্ন তিন থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ কেজি। একদিকে বাড়তি বই পড়ার চাপ; অন্যদিকে কোচিংয়ের জন্য চাপ-এসব সহ্য করতে না পেরে শিশুরা প্রায়ই অসুস্থ হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, বইয়ের বোঝা কাঁধে বহন করার কারণে শিশুরা আর্থ্রাইটিস ও অস্টিওপোরোসিসের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে, যা ভবিষ্যত্ বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। অনেক শিশু কাঁধের ব্যথায় ভুগছে। তাদের মতে, শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভার বহন করা উচিত নয়। এতে শিশুদের পিঠ ও পায়ে ব্যথাসহ বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুরা হয়ে যেতে পারে বামন বা খর্বাকৃতির।