সরকারের পাঁচ অগ্রাধিকার
- আপলোড টাইম : ১১:২৬:১৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৮ নভেম্বর ২০২৪
- / ২৭ বার পড়া হয়েছে
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যাশা নিয়ে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন এক অধ্যায় শুরু হয় ৮ আগস্ট। অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স তিন মাস পূর্ণ হয়েছে আজ শুক্রবার। রাষ্ট্র সংস্কারের মাধ্যমে বৈষম্যহীন সমাজ উপহার দেয়াই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও প্রথম অগ্রাধিকার। সেসঙ্গে যৌক্তিক সময়ে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন, জনগণের দুর্ভোগ লাগবে বাজার নিয়ন্ত্রণ, জননিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নসহ ‘মব জাস্টিসের’ মতো অনভিপ্রেত ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এনে রাজনৈতিক এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করাই অন্তর্বর্তী সরকারের মূল অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গত তিন মাসের মূল্যায়নে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভঙ্গুর সামষ্টিক অর্থনীতিতে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। আর দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্পষ্ট পদক্ষেপ না নেয়ায় এক ধরনের অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন রাজনীতিবিদরা।
শপথ নেয়ার পরই সংস্কারকে প্রাধান্য দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাষ্ট্র সংস্কার, অর্থনীতি পুনর্গঠন, আইনশৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করে নতুন সরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার আনার ওপর সবার আগে জোর দিতে হবে দায়িত্ব পাওয়া উপদেষ্টাদের। বিশ্লেষকদের মতে, রাষ্ট্র সংস্কারই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ বলে বিবেচিত হলেও তৃতীয় মাসে এসে তা কিছুটা প্রশ্নের মুখে পড়ে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ১০টি কমিশন গঠন করে। কমিশনগুলো হলো নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার, পুলিশ সংস্কার, বিচার বিভাগ সংস্কার, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার, জনপ্রশাসন সংস্কার, সংবিধান সংস্কার, স্বাস্থ্য খাত সংস্কার, শ্রমিক অধিকার সংস্কার, নারী অধিকার সংস্কার ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন। এছাড়া নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটিও গঠন করেছে সরকার। সরকার বলেছে, এর মধ্যদিয়েই নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করেছে তারা। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, সংবিধান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, সিভিল সোসাইটির সংগঠনসমূহের প্রতিনিধি, সিভিল সোসাইটির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি, পেশাজীবী সংগঠনসমূহের প্রতিনিধি, তরুণ চিন্তাবিদ, সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করবে কমিশন। তাদের কাছে থেকে লিখিত প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছে। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা করা হবে।
রাজনৈতিক-সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ :
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত তিন মাসে রাজনৈতিক-সামাজিক স্থিতিশীলতা আসেনি বরং মব জাস্টিসের নামে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। আইনের শাসন চাইলে মব জাস্টিসকে কখনোই সমর্থন করা যাবে না বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রধান সমন্বয়কারী দিলিপ কুমার সরকার। তিনি বলেন, এটি বন্ধ করতে হবে। এরকম কেউ আক্রান্ত হলে তার পাশে দাঁড়াবেন, প্রয়োজনে সমাজের মানুষ নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। নির্বাচনের কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দেয়নি সরকার। নির্বাচন হতে যত দেরি হবে ততই পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দিতে পারে- এই আশঙ্কায় বিএনপিসহ আন্দোলনের শরিক দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে তৎপরতা বাড়িয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কারে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে বিএনপি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে গুণগত পরিবর্তনের জন্য ৩১ দফা রূপরেখা নিয়ে এগোচ্ছে দলটি। শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলো রাজনৈতিক, সামাজিক ও কূটনৈতিক তৎপরতায় নতুন করে চাঙা হয়ে উঠেছে। নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে এগিয়ে চলেছে তারা। সারাদেশে দলকে মজবুত করতে বহুমুখী কর্মকাণ্ড সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করছে দলগুলো। সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে ১০ দফা রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবনা ঘোষণা করেছে, যেখানে নির্বাচনী প্রক্রিয়া, আইন, বিচার ব্যবস্থা এবং সংসদীয় প্রতিনিধিত্বের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। পাশাপাশি দলটি কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ওপরও জোর দিচ্ছে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু করেছে জামায়াত। গত সোমবার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, প্রয়োজনীয় সব সংস্কার শেষে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে।
এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘পদত্যাগ’ ইস্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্য এবং সেই কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তার পদত্যাগ দাবি করলেও বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের ভিন্নমত প্রকাশের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের অবস্থানও বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর সমর্থন পায়নি। বিএনপির পক্ষ থেকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে, তারা কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এখনো তাদের রোডম্যাপ পরিষ্কার নয়। তারপরও আমাদের আকাক্সক্ষা ছিল, তারা দ্রুত জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাবে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের প্রধান দাবি ছিল, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের আলোচনা শুরু করে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার। এসব কাজে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে পরামর্শ করবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা এখনো সফল হয়নি।
লাগামহীন বাজারদর এবং অর্থনীতি :
পণ্যমূল্যে দিশাহারা সাধারণ মানুষ। ইচ্ছামতোই বাড়ে ডিম, সবজি, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, সয়াবিন, সরিষার তেলের দাম। চালের বাজারও ঊর্ধ্বমুখী। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ডিম আমদানির জন্য সাতটি প্রতিষ্ঠানকে সাময়িকভাবে অনুমতি দিয়েছে। যদিও পণ্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে এবং দৈনন্দিন দরকারি পণ্যের দাম যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে সেজন্য বাজার তদারকি করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে সরকার।
বিশ্লেষকদের মতে, আর্থিক খাতে বিশৃঙ্খলা ছাড়াও একের পর এক বিভিন্ন সংগঠনের দাবি-আন্দোলনসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে সরকারকে। শিক্ষাঙ্গন এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক নয় বলে অনেকে মনে করছে। রেমিট্যান্সে গতি ফিরেছে। রিজার্ভ সুসংহত হওয়া শুরু করেছে। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণ সহায়তা চাওয়া হয়েছে। রিজার্ভ সামনে আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে অস্বস্তি রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্য নিয়ে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে তা অর্থনীতিকে সচল করার জন্য ইতিবাচক, তবে পর্যাপ্ত নয়। শিল্প-কারখানায় কিছুটা শৃঙ্খলা এসেছে, রেমিট্যান্স বেড়েছে, এটা ভালো দিক। অর্থনীতিকে আরো সচল করতে হলে সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ যাতে বাড়ে- সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোকে সচলের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষি উৎপাদন ত্বরান্বিত করতে হবে। তাহলে কর্মসংস্থান বাড়বে, অর্থনীতি গতিশীল হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সংগঠক সাইফুল হক বলেন, জনগণের বিশাল প্রত্যাশার চাপ নিয়ে সরকার পরিচালনায় নানা ঘাটতি ও দুর্বলতা থাকলেও গত তিন মাসে দেশের ভঙ্গুর সামষ্টিক অর্থনীতিতে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরেছে। অর্থনীতি কিছুটা সচল হতে শুরু করেছে। রেমিট্যান্স আসার গতি ও রিজার্ভ বেড়েছে। সরকার বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায়ে অনেকটা সক্ষম হয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলো কাজ করছে। তিনি বলেন, পণ্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি মানুষকে নাজেহাল করে তুলছে। জনআকাক্সক্ষা অনুযায়ী নির্বাচন ছাড়া অন্তর্র্বতী সরকারের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার ছিল জনজীবনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা বিধান করা। এজন্য সরকারের প্রচেষ্টা রয়েছে। কিন্তু বাজার পরিস্থিতি এখনো বেসামাল।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি :
বিশেষজ্ঞদের মতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ প্রশাসনকে এখনো পেশাদারি দক্ষতায় কার্যকরী করা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অন্তর্র্বতী সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনির ঘটনা এখনো একটি চিন্তার বিষয় হয়ে রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) অক্টোবর (২০২৪) মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু অক্টোবর মাসে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৯ জনই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। বাকি নিহত ৩ জন বিএনপির। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবরে রাজনৈতিক সহিংসতার ৫৮টি ঘটনায় সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪২৪ জন। অক্টোবরে অন্তত ২৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, যেখানে ১৯ জন নিহত ও ৩ জন নারীসহ ১৯ জন কিশোর ও যুবক গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। সাইফুল হক বলেন, জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতা উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীসহ প্রশাসনকে এখনো পুরোপুরি কার্যকর করা যায়নি।
রাজনীতিবিদরা যা বলছেন :
গত তিন মাসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, তারা অনেকগুলো কাজ করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, সবাই যদি সরকারকে সহযোগিতা করি তাহলে জাতির সামনে যে চ্যালেঞ্জ আছে তা পূরণে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দলের কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান বলেন, সরকার একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ দেশের সবস্তরে দুর্নীতি ও দলীয়করণ থেকে রাহুমুক্ত করতে সরকার কাজ করছে। দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে সরকার। ব্যাংক খাতে সংস্কার আনা হচ্ছে। এই দিকগুলো ইতিবাচক।