ইপেপার । আজ শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

প্রশাসনের সর্বত্র ফ্যাসিবাদের ছায়া ; বিস্তৃত সংস্কার প্রয়োজন

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:২৬:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪
  • / ৩৭ বার পড়া হয়েছে

প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে কিভাবে একটি ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হলো তা পর্যালোচনা করে দেখার চেষ্টা চলছে। সবগুলো খাত নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজন থাকলেও আপাতত এমন বিস্তৃত মূল্যায়ন সম্ভব হচ্ছে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো কাজ শুরু করেছে। এ সংক্রান্ত একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি প্রশাসনে সৃষ্ট বিপর্যয় নিয়ে শীর্ষ আমলাদের বিস্তারিত মতামত নিয়েছে। কমিটির সাথে আলোচনায় আমলারা এর কারণগুলো জানিয়েছেন। সত্যি হলো- ফ্যাসিবাদী রাজনীতি যেমন প্রশাসনকে অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ছিল, তেমনি আমলাদের বড় একটি অংশ উৎসাহী হয়ে এ অরাজকতা তৈরিতে সহযোগী হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সামনের দিকে এগোতে হলে আমলাতন্ত্রে বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়ম কিভাবে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ল শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তা খতিয়ে দেখছে। কমিটির পক্ষ থেকে আমলাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিগত সরকারের আমলে উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করা হয়, তাতে প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল। উত্তরে অনেকটা সাফাই গাওয়ায় আমলাদের দায়টাও বোঝা যায়।
আত্মপক্ষ সমর্থন করে আমলারা জানিয়েছেন, সরকার ইচ্ছেমতো প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়েছে। ইচ্ছা করে দুর্বল প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্প ভুলভাবে টেকসই দেখানো হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় গাফিলতি করা হয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক প্রভাব মুখ্য হয়ে ওঠায় এমনটি হয়েছে। এ কারণে কর্মকর্তাদের কেউ সঠিকভাবে কাজ করতে গেলে তাকে তোপের মুখে পড়তে হতো। শেষ পর্যন্ত সরকারি দল, ব্যবসায়ী চক্র এবং আমলাদের একটি অংশ মিলে ত্রিমুখী চক্র গড়ে ওঠে। প্রকল্প চয়ন, প্রণয়ন, ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন সব পর্যায়ে এ চক্রের ইচ্ছার কাছে সবাই নতি স্বীকার করেন।
আমলাদের দাবি, জনপ্রশাসন সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল। পেশাগত কাঠামো ভেঙে যায়। পেশাজীবীদের যেসব সংগঠন ছিল সেগুলোও সরকারের কব্জায় চলে যায়। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, তাদের অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। বাস্তবতা হচ্ছে- বহু আমলাকে এ সময়ে দেখা গেছে রাজনৈতিক নেতার চেয়ে বেশি কট্টর ভূমিকায়। দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে সুবিধা নিতে দলদাস হয়ে কাজ করেছেন। এরা সৎ-দক্ষ ও পেশাদার আমলাদের প্রতিরোধ ভেঙে দিয়ে পুরো রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার কাছে পদানত করে। জনপ্রশাসন পুরোটা দলীয় ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়। তাই পতিত সরকারের অনুগ্রহভোজী আমলাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আসলে ২০০৯-২৩ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া ছয় লাখ ৪৮ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক দলীয় বিবেচনার বাইরে নিয়োগ পায়নি। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেলেও প্রায় সবাইকে ঘুষ দিতে হয়েছে। ফলে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে নিয়োগ পেয়ে নাগরিক সেবার চেয়ে ঘুষ গ্রহণকেই গুরুত্ব দিয়েছেন এতদিন। এখনো প্রশাসন আগাগোড়া ফ্যাসিবাদের দোসরদের দিয়ে সাজনো রয়েছে। এ অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে এর খোলনলচে পাল্টাতে হবে। প্রয়োজন হবে একটি যুগান্তকারী সংস্কারের। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে এখনো সেভাবে কাক্সিক্ষত গতি দৃশ্যমান নয়।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

প্রশাসনের সর্বত্র ফ্যাসিবাদের ছায়া ; বিস্তৃত সংস্কার প্রয়োজন

আপলোড টাইম : ০৯:২৬:১৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৫ নভেম্বর ২০২৪

প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে কিভাবে একটি ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হলো তা পর্যালোচনা করে দেখার চেষ্টা চলছে। সবগুলো খাত নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়োজন থাকলেও আপাতত এমন বিস্তৃত মূল্যায়ন সম্ভব হচ্ছে না। তবে কিছু ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো কাজ শুরু করেছে। এ সংক্রান্ত একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি প্রশাসনে সৃষ্ট বিপর্যয় নিয়ে শীর্ষ আমলাদের বিস্তারিত মতামত নিয়েছে। কমিটির সাথে আলোচনায় আমলারা এর কারণগুলো জানিয়েছেন। সত্যি হলো- ফ্যাসিবাদী রাজনীতি যেমন প্রশাসনকে অক্টোপাসের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ছিল, তেমনি আমলাদের বড় একটি অংশ উৎসাহী হয়ে এ অরাজকতা তৈরিতে সহযোগী হয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে সামনের দিকে এগোতে হলে আমলাতন্ত্রে বড় ধরনের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধেও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্নীতি-অনিয়ম কিভাবে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ল শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তা খতিয়ে দেখছে। কমিটির পক্ষ থেকে আমলাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিগত সরকারের আমলে উন্নয়নের যে বয়ান তৈরি করা হয়, তাতে প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল। উত্তরে অনেকটা সাফাই গাওয়ায় আমলাদের দায়টাও বোঝা যায়।
আত্মপক্ষ সমর্থন করে আমলারা জানিয়েছেন, সরকার ইচ্ছেমতো প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়েছে। ইচ্ছা করে দুর্বল প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। প্রকল্প ভুলভাবে টেকসই দেখানো হয়েছে। সম্ভাব্যতা যাচাই এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় গাফিলতি করা হয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক প্রভাব মুখ্য হয়ে ওঠায় এমনটি হয়েছে। এ কারণে কর্মকর্তাদের কেউ সঠিকভাবে কাজ করতে গেলে তাকে তোপের মুখে পড়তে হতো। শেষ পর্যন্ত সরকারি দল, ব্যবসায়ী চক্র এবং আমলাদের একটি অংশ মিলে ত্রিমুখী চক্র গড়ে ওঠে। প্রকল্প চয়ন, প্রণয়ন, ব্যবস্থাপনা ও বাস্তবায়ন সব পর্যায়ে এ চক্রের ইচ্ছার কাছে সবাই নতি স্বীকার করেন।
আমলাদের দাবি, জনপ্রশাসন সম্পূর্ণভাবে রাজনীতির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল। পেশাগত কাঠামো ভেঙে যায়। পেশাজীবীদের যেসব সংগঠন ছিল সেগুলোও সরকারের কব্জায় চলে যায়। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, তাদের অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। বাস্তবতা হচ্ছে- বহু আমলাকে এ সময়ে দেখা গেছে রাজনৈতিক নেতার চেয়ে বেশি কট্টর ভূমিকায়। দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে সুবিধা নিতে দলদাস হয়ে কাজ করেছেন। এরা সৎ-দক্ষ ও পেশাদার আমলাদের প্রতিরোধ ভেঙে দিয়ে পুরো রাষ্ট্রকে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার কাছে পদানত করে। জনপ্রশাসন পুরোটা দলীয় ব্যবস্থায় পর্যবসিত হয়। তাই পতিত সরকারের অনুগ্রহভোজী আমলাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আসলে ২০০৯-২৩ সাল পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পাওয়া ছয় লাখ ৪৮ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীর সবই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক দলীয় বিবেচনার বাইরে নিয়োগ পায়নি। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেলেও প্রায় সবাইকে ঘুষ দিতে হয়েছে। ফলে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরিতে নিয়োগ পেয়ে নাগরিক সেবার চেয়ে ঘুষ গ্রহণকেই গুরুত্ব দিয়েছেন এতদিন। এখনো প্রশাসন আগাগোড়া ফ্যাসিবাদের দোসরদের দিয়ে সাজনো রয়েছে। এ অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হলে এর খোলনলচে পাল্টাতে হবে। প্রয়োজন হবে একটি যুগান্তকারী সংস্কারের। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে এখনো সেভাবে কাক্সিক্ষত গতি দৃশ্যমান নয়।