আলমডাঙ্গা পৌরসভায় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে সখ্যতায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন মা-মেয়ে দুই কর্মচারী
পর্ব-২: সব কাজের কাজী সার্ভেয়ার নিশি, নিতেন মোটা অঙ্কের উৎকোচ- আপলোড টাইম : ০৯:৫৬:০৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৪ নভেম্বর ২০২৪
- / ৮১ বার পড়া হয়েছে
আলমডাঙ্গা পৌরসভার চারটি পদের নিয়োগে তিনটিতে ঘুষ বাণিজ্যের গুঞ্জন থাকলেও সার্ভেয়ার মোর্শেদুর নাহার নিশির নিয়োগে পদে পদে আছে দুর্নীতি বা অনিয়ম। ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার খাতিরে নিশির নিয়োগে সবক্ষেত্রে করা হয়েছে অনিয়ম। পৌরসভা চাকরি বিধিমালা ১৯৯২ মোতাবেক সার্ভেয়ার/সাব-ওভারশিয়ার পদে চাকরির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে সার্ভেয়ারশীপ/সাব-ওভারশিয়ার/অথবা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। বাংলাদেশ গেজেটে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগ এর ০৭ই মার্চ, ১৯৯২ এর প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনের প্রথম অধ্যায় এর ০২ এর (ছ) তে উল্লেখ আছে যে, ‘ডিগ্রি’ বা ‘ডিপ্লোমা’ বা ‘সার্টিফিকেট’ বলিতে ক্ষেত্রমত স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়, স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান, স্বীকৃত ইনস্টিটিউট বা স্বীকৃত বোর্ড কর্তৃক প্রদত্ত ডিগ্রি, ডিপ্লোমা বা শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্দেশক সার্টিফিকেটকে বোঝাবে।
তবে সার্ভেয়ার মোর্শেদুর নাহার নিশি সার্ভেয়ার পদে চাকরির জন্য বগুড়ার একটি সীট টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২ বছরের একটি সার্ভেয়ার (আমিনশীপ) অথবা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা সনদ প্রদান করা হয়েছে। তবে সেই সনদও দৈনিক সমীকরণের এই প্রতিবেদকের নজরে এসেছে। সেখানে শিক্ষাকাল হিসেবে ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত দেখানো হয়েছে। তবে আলমডাঙ্গা পৌরসভায় কর্মরত সার্ভেয়ার কাম ওয়াসিস মোর্শেদুর নাহার নিশি আলমডাঙ্গা পৌরসভাতেই ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তথা সার্ভেয়ার পদে নিয়োগ পাওয়া পর্যন্ত চুক্তিভিত্তিক কম্পিউটার অপারেটর পদে কর্মরত ছিলেন। সে হিসেবে তার হাজিরা খাতা পর্যালোচনা করে জানা গেছে, তিনি তেমন কোনো বড় ধরনের ছুটি নেননি। আলমডাঙ্গা পৌরসভাতেই চাকরি করে দুই বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ তিনি কীভাবে সম্পন্ন করলেন, সেটি নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
অভিযোগের শেষ নেই এই সার্ভেয়ার মোর্শেদুর নাহার নিশির বিরুদ্ধে। একের পর এক অনিয়ম আর অন্যায় করেছেন তিনি এবং তার মা টিকাদান সহকারী বেবি খাতুন। একটি মহল বলছে, ওই জনপ্রতিনিধির সাথে মা-মেয়ে দুজনেরই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শুধু সম্পর্কটা মায়ের ক্ষেত্রে পূর্বে এবং মেয়ের ক্ষেত্রে বর্তমানে। তাই আলমডাঙ্গা পৌরসভার অনেকটাই তাদের দখলেই ছিল। অনিয়মের পাহাড় থাকলেও মামলা-হামলার ভয় দেখানোর জন্য মোর্শেদুর নাহার নিশির বিরুদ্ধে কথা বলার লোক কম।
আলমডাঙ্গা পৌরসভায় কর্মরত সার্ভেয়ার কাম ওয়াসিস মোর্শেদুর নাহার নিশি অফিসের কাজে মনোযোগী না হয়ে সাধারণ মানুষের জমিজমা মাপ এবং সমস্যা সমাধান করার জন্য লিয়াজুর দায়িত্বও নিয়েছিলেন। পৌর নিয়ম বহিরর্ভূতভাবেই মোর্শেদুর নাহার নিশি আমিন ভাড়া করে জমি পরিমাপ সম্পন্ন করেন। ওই জনপ্রতিনিধির ভয় দেখিয়ে তিনি দাদাগিরি করে সবকিছু মীমাংসার মাতব্বরও সাজতেন। নিতেন মোটা অংকের উৎকোচ।
আলমডাঙ্গা পৌরসভার নির্ভরযোগ্য তথ্যমতে, আলমডাঙ্গা পৌরসভায় কর্মরত সার্ভেয়ার কাম ওয়াসিস মোর্শেদুর নাহার নিশির চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য পৌরসভার কোনো রেজ্যুলেশন নেয়। তার সার্ভিস বুকে ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল তারিখ উল্লেখ করে রেজ্যুলেশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ওই তারিখে আলমডাঙ্গা পৌরসভাতে পৌর পরিষদের কোনো মাসিক সভা হয়নি।
পৌরসভার একটি মহল বলছে, বেবি খাতুনের বিরুদ্ধেও অভিযোগের তালিকা অনেক বড়। স্বেচ্ছাচারিতায় তিনি আলমডাঙ্গা পৌরসভার বড় মাপের কর্মচারী। তার থেকেই খামখেয়ালীপনা অফিস শুরু। তিনি অনিয়মিত হওয়া সত্ত্বেও পৌরসভার খাতায় তার হাজিরা নিয়মিত। দীর্ঘদিন যাবৎ অফিসকে না জানিয়ে ভারতে যাতায়াত করলেও তার নিয়মবর্হিভূত ছুটি নেই। পৌরসভার খাতা-কলমে তিনি নিয়মিত কর্মচারী। তবে তার ব্যক্তিগত পাসপোর্ট বলছে ভিন্ন কথা। দীর্ঘদিন ভারতে মাঝে মাঝে গিয়ে কিছুদিন কিছুদিন করে বা মাঝে মধ্যে দীর্ঘ সময় কাটানোরও প্রমাণ রয়েছে। তবে পাসপোর্ট অনুযায়ী গত ৮ বছর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেয়াদে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করলেও আলমডাঙ্গা পৌরসভায় তার উপস্থিতি স্বাভাবিক-নিয়মিত। কীভাবে তিনি দেশের বাইরে থেকেও খাতা-কলমে নিয়মিত অফিস করছেন, সেটি নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। দাবি করা হচ্ছে, বেবি খাতুনের সব কয়টি পাসপোর্ট এবং পৌরসভার হাজিরা খাতা যাচাই-বাছাইয়ের।
মোছা. বেবী খাতুন ও মেয়ে মোর্শেদুর নাহার নিশির বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গেলেই বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা নারী নির্যাতনের মামলা, মিথ্যা এসিড নিক্ষেপ এমনকি কাপড় ছিড়ে ধর্ষণের মতো অভিযোগ, ভয়-ভীতি দেখানোর কারণে পৌরসভার কেউই মুখ খোলেননি। হয়রানি আর হুমকি এক জনপ্রতিনিধির সাহসেই তারা দিতেন বলে জনশ্রুতি আছে।
এদিকে, অনিয়ম দুর্নীতির শীর্ষে থাকার পরও সার্ভেয়ার মোর্শেদুন নাহার নিশির ক্ষমতার দাপট কমেনি। গত ২৮ অক্টোবর তাকে দেয়া হয় আলমডাঙ্গা পৌরসভার সকল প্রকার ভবনের নকশা অনুমোদনের দায়িত্ব। এতে করে পৌরসভার মধ্যেই তৈরি হয় একটি ক্ষোভ। দুর্নীতিবাজ এই নারীকে দায়িত্ব দেয়া নিয়ে হচ্ছে সমালোচনা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আলমডাঙ্গা পৌরসভায় কর্মরত সার্ভেয়ার কাম ওয়াসিস মোর্শেদুর নাহার নিশি বলেন, ‘মাস্টার রোলে অতো অফিস করতে হয় না। মাস্টার রোল রাখে কাজের প্রয়োজনে। আমি অফিস করেছি, ছুটিও নিয়েছি আর তেমনিতে মাস্টার রোলে তো অতো ধরাধত্তি নেই। যোগাযোগ রেখেছি, রেগুলার ক্লাস করতে পারিনি। বগুড়ায় আমার খালা ভাড়ায় থাকে, সেখানে গিয়ে থাকতাম। দেখেন কলেজ লেবেলেও যারা ক্লাস করে তারাও তো রেগুলার ক্লাস করতে পারে না।’
নিয়োগের সময় জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী বয়স না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে মোর্শেদুর নাহার নিশি বলেন, ‘সে সময় আমি জন্ম নিবন্ধন কাগজ দিয়েছি। জাতীয় পরিচয়পত্র দিইনি।’ আলমডাঙ্গা পৌরসভার একজন জনপ্রতিনিধির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে মেয়র, আমার বস। তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কেন থাকবে। পারলে প্রমাণ দেখান। তার সাথে ঘনিষ্ঠ অবস্থায় থাকার প্রমাণ দেন। লোকে বলবে আর তাই মানতে হবে?’
মোছা. বেবি খাতুন বলেন, ‘তিন দিনের বেশি ছুটি হয়। আমি তিন দিনের বেশি ছুটি নিইনি। খাতা চেক করেন।’ এসময় মোছা. বেবি খাতুনের পাসপোর্ট অনুযায়ী অধিক সময় অবস্থানের বিষয়ে জিজ্ঞেস করার পর তিনি বলেন, ‘মেয়র ছিল। অনেকভাবে চলেছে। কত লোকে কতভাবে গেছে। কেউ বলে গেছে, কেউ না বলে গেছে। আমার অফিসের অনেকেই গেছে। মেয়র যেভাবে চালাই গেছে, আমি সেভাবে চলেছি। আমি হয়ত দু’দিনের ছুটি নিয়েছি, পরে মৌখিকভাবে তিন দিনের ছুটি নিয়েছি।’ তবে মোছা. বেবি খাতুন উপস্থিত না থেকেও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করা নিয়ে কিছু বলেননি।
এদিকে, আলমডাঙ্গা পৌরসভা এই প্রতিবেদককে তথ্য অধিকার আইনে যে তথ্য প্রদান করেছে, সেখানে সত্যায়িত করেছেন আলমডাঙ্গা পৌরসভার সচিব রাকিবুল ইসলাম। পত্রিকায় প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি স্বচোখে দেখে তিনি ফটোকপিতে স্বাক্ষর করেছেন কি না জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা দুই দিন টালবাহানা করেছেন। প্রথম দিনে তিনি কাগজপত্র পুনরায় দেখে জানানোর কথা বলেন। তবে দ্বিতীয় দিন যোগাযোগ করা হলে তিনি সারাদিন মিটিং করছেন বলে জানান। তবে মূল কাগজ না দেখে সত্যায়িত করার বিষয়ে উঠেছে প্রশ্ন। আলমডাঙ্গা পৌরসভার একটি মহল বলছে, এই কর্মকর্তা মোর্শেদুর নাহার নিশির কাগজপত্র সঠিক না থাকা সত্ত্বেও ঠিক করার চেষ্টায় আছেন।
আলমডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র হাসান কাদির গনু বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে আমি কিছু বলতে পারছি না। তবে বিষয়টি পৌরসভার কর্মর্তাদের কাছে শুনে বলতে পারবো।’
আলমডাঙ্গা পৌরসভার প্রশাসক শেখ মেহেদী ইসলাম বলেন, ‘এ বিষয়ে নিশ্চয় তদন্ত করে দেখা হবে। কেউ যদি দোষী হয়, সে বিধি অনুযায়ী শাস্তি পাবে।’