পর্ব-১: আলমডাঙ্গা পৌরসভায় চারটি পদে নিয়োগে অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ
ভুয়া বিজ্ঞপ্তি দিয়ে গোপনে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন
- আপলোড টাইম : ০৯:২৮:২২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ নভেম্বর ২০২৪
- / ৫৭ বার পড়া হয়েছে
- জনপ্রতিনিধির সাথে ঘনিষ্ঠতায় নিয়োগ পেয়েছেন সার্ভেয়ার নিশি
- চাকরির বয়স শেষ হলেও বয়স সংশোধন করে নিয়োগ
- মা-মেয়ের জিম্মিতে ছিল আলমডাঙ্গা পৌরসভা কার্যালয়ের অর্ধেক
- মামলা-হামলার ভয়ে সবকিছু জেনেও নিশ্চুপ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
- পুরো বিষয়টি পৌরসভার সচিব রাকিবুলের গোপন করার চেষ্টা
আলমডাঙ্গা পৌরসভার চারটি পদে নিয়োগ নিয়ে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ২০২১ সালে হওয়া পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকেই গোপনে সম্পন্ন করতে হরেক রকম কৌশলের পসরা সাজিয়েছিলেন পৌরসভার তৎকালীন কর্তারা। আবার এক জনপ্রতিনিধির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে তথ্য গোপন করে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে পৌরসভার সার্ভেয়ারের বিরুদ্ধে। ঘুষ বাণিজ্য ও অনিয়ম থাকলেও আলমডাঙ্গা পৌরসভার সচিব রাকিবুল ইসলাম করছেন গোপন করার চেষ্টা। অজানা কারণে এক নারীর হয়ে বেশি সাফাই গাওয়া নিয়েও পৌরসভা কার্যালয়ে চলছে হাসাহাসি। দুই কর্মচারী মা-মেয়ের জিম্মিতে ছিল আলমডাঙ্গা পৌরসভার অর্ধেক। সম্পূর্ণ জালিয়াতির নিয়োগে নিয়োগপ্রাপ্ত ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত উভয়ের বিরুদ্ধেই তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বর্তমান পৌর প্রশাসক বলছেন, ঘটনা সত্য হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এই প্রতিবেদনটিতে তথ্য অধিকার আইনের সহযোগিতা নিয়েছেন দৈনিক সময়ের সমীকরণ পত্রিকার এই প্রতিবেদক। তথ্য অধিকার আইনের ক ফরমে আবেদন করে আলমডাঙ্গা পৌরসভার একটি নিয়োগ সংক্রান্ত কাগজপত্র নেয় এ প্রতিবেদক। সেই তথ্য বিশ্লেষণে বেরিয়ে এলো থলের বিড়াল।
আলমডাঙ্গা পৌরসভার সার্ভেয়ার মোর্শেদুর নাহার নিশি ২০১৬ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আলমডাঙ্গা পৌরসভায় চুক্তিভিত্তিক কম্পিউটার অপারেটর পদে কর্মরত ছিলেন। ইচ্ছামতো সময়ে আসা, সিনিয়র অনেক কর্মকর্তাকে তোয়াক্কা না করাসহ আচরণগত দিক দিয়ে একাধিক অভিযোগ ছিল তার নামে। প্রথম দিকে অনেকেই বিষয়টি বুঝতে না পারলেও একজন জনপ্রতিনিধির সাথে তার ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। সেই জনপ্রতিনিধিই ক্ষমতার বলে চুক্তিভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে নিশিকে চাকরি দিয়েছিলেন।
আলমডাঙ্গা পৌরসভা থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর এশিয়া বাণী নামে একটি পত্রিকায় আলমডাঙ্গা পৌরসভায় সার্ভেয়ার/সাব ওভারশিয়ার, ট্রাক চালক, এমএলএসএস ও নৈশ প্রহরীসহ চারটি পদে চারজনের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে এই প্রতিবেদকের নিকট আলমডাঙ্গা পৌরসভা থেকে বিজ্ঞাপন প্রচারের যে ফটোকপি সরবরাহ করা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট যে বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া। যে ফটোকপিটি দেয়া হয়েছে, সেটার মেকাপ, জ্যাম এবং কার্টিং না মেলায় স্পষ্টভাবেই দৈনিক সময়ের সমীকরণ-এর নজর আসে বিষয়টি। যাচাই করতে ওই পত্রিকাটির ২০২০ সালের ২২ অক্টোবরের কপির সন্ধান করা হয়। তবে ওইদিন পত্রিকাটির ওয়েবসাইটে এ ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন ছাপা হয়নি। চারটি পদে নিয়োগ বাণিজ্যের কৌশল হিসেবে আলমডাঙ্গা-চুয়াডাঙ্গায় চলে না, এমন পত্রিকাতেই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, ঘটনাক্রমে ওই একই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি পুনঃবিজ্ঞপ্তি আকারে ছাপার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ২০২১ সালে। ওই বছরের ১৯ মার্চ আবারও কুষ্টিয়া থেকে প্রকাশিত আজকের আলো নামে একটি আঞ্চলিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপার খাতা-কলমের নাটক সাজানো হয়। কেউ কেউ বলছেন, পত্রিকাটি আলমডাঙ্গা-চুয়াডাঙ্গায় না আসায় এবং কৌশল অবলম্বন করায় সেবারও বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ্যে আসেনি। আবার অতিরিক্ত টাকা খরচ করে ওই দিনের সব পত্রিকা কিনে নেওয়ারও অভিযোগ আছে।
দৈনিক সময়ের সমীকরণ-এর অনুসন্ধানে স্পষ্ট চারটি পদের পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে গোপন রেখে সাজানো হয়েছে। দ্বিতীয়বার পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি নিয়েও যাচাই-বাছাইয়ে পাওয়া গেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ঘুষ বাণিজ্যের লাইন পরিষ্কার করতে একে তো অভিযোগ রয়েছে, ডিএফপি বর্হিভূত একটি পত্রিকায় নিয়ম না মেনে বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। তবে আলমডাঙ্গা পৌরসভা থেকে প্রাপ্ত পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তিটি ছাপা পত্রিকার ফটোকপি ওই পত্রিকাটির অফিসে পাঠিয়ে সম্পাদকের সাথে যোগাযোগ করা হলে পত্রিকাটির সম্পাদক নিশ্চিত করেছেন বিজ্ঞাপনটি ভুয়া। পত্রিকার কার্টিং করে ফটোকপি বুদ্ধি কাজের লাগানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তবে মেকাপে ভুল থাকায় ফটোকপিটি স্পষ্ট প্রমাণ করে ওই বিজ্ঞাপন ছাপার বিষয়টি জালিয়াতি করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ পেতে এই নারী অতি সক্রিয় ছিলেন। ২০২১ সালে যখন নতুন করে পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞপ্তির নাটক সাজানো হয়, তখন মোর্শেদুর নাহার নিশির চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষ হয়ে গিয়েছিল। জাতীয় পরিচয়পত্র তিনি সংশোধন করিয়েছিলেন। আলমডাঙ্গা পৌরসভায় কর্মরত সার্ভেয়ার কাম ওয়াসিস মোর্শেদুর নাহার নিশির জাতীয় পরিচয়পত্র ঘেটে পাওয়া গেছে আরও বিস্ময়কর তথ্য। পূর্বে তার জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্ম তারিখ ছিল ১৯৯১ সালের ২ জুলাই। তিনি ২০২৩ সালের ৮ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেন বয়স সংশোধনের জন্য। নতুন করে ১৯৯৫ সালের ১৫ মার্চ করার আবেদন করেন। তবে আবেদনটি উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় নির্বাচন কার্যালয়েও অনুমোদিত না হয়ে ক্যানসিল করা হয়।
অভিযোগ রয়েছে, যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে ২০২৩ সালের ৬ জুলাই এটিকে মোর্শেদুর নাহার নিশি অনুমোদন করিয়ে আনেন নির্বাচন কমিশন থেকে। তবে অনুসন্ধানে আরও তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ২০২১ সালের ১৯ মার্চ যে পুনঃনিয়োগ বিজ্ঞাপ্তির নাটক সাজানো হয়, সেই অনুযায়ী মোর্শেদুর নাহার নিশির চাকরির বয়স শেষ ছিল। এই কারণেই তিনি বয়স সংশোধন করান। তবে এগুলোর আগে তিনি প্রথমে জন্ম নিবন্ধন ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশোধিত সার্টিফিকেট কাজে লাগান। তবে নিয়োগ সংক্রান্ত কাজে তিনি জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যবহারই করেননি। স্পষ্ট প্রতীয়মান, সেখানেও তিনি তথ্য গোপন করেছেন। এবং নিয়োগের সময় তার বয়স চাকরির যোগ্যতা হারিয়েছিল।
অভিযোগ রয়েছে, সার্ভেয়ার মোর্শেদুর নাহার নিশির মা মোছা. বেবি খাতুন আলমডাঙ্গা পৌরসভাতেই টিকাদান সহকারী হিসেবে কর্মরত। তবে গত ৮ বছর টিকাদানের তেমন কোনো কার্যক্রমে এই কর্মচারীর দেখা যায়নি। দীর্ঘদিন অসুস্থতার কথা বলে বিনা ছুটিতে ভারতে অবস্থানেরও তথ্য এসেছে দৈনিক সময়ের সমীকরণ-এর হাতে। মোছা. বেবি খাতুন পৌরসভায় উপস্থিত না থাকলেও হাজিরা খাতায় থাকে তার স্বাক্ষর। তার মেয়ের ওই জনপ্রতিনিধির সাথে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার আগে দীর্ঘদিন মো. বেবি খাতুনের সাথে ওই জনপ্রতিনিধির সুসম্পর্ক থাকার ব্যাপক সমালোচনা আছে আলমডাঙ্গা শহরজুড়ে।
আলমডাঙ্গার অতি পরিচিত মুখ এই দুই মা-মেয়ের ভয়ে অতিষ্ঠ অনেকে। মামলা-হামলার ভয় দেখানোয় এই দুই নারী নিয়ে ঘাটাঘাটি করতেও রাজি নয় পৌরসভার অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী। দূরে থাকা, এড়িয়ে চলা আর তাদেরকে নিয়ে মন্তব্য না করাই পৌরসভার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দৃষ্টিতে পছন্দ। তবে এখানেই শেষ নয়। (চলবে…..)