ইপেপার । আজ রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫

ভোটের চাপ বাড়াচ্ছে বিএনপি

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৪:২২:৩৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪
  • / ৫৬ বার পড়া হয়েছে

CREATOR: gd-jpeg v1.0 (using IJG JPEG v80), default quality


ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই জরুরি সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেয়ার তাগাদা দিয়ে আসছে বিএনপি। তবে যতই দিন গড়াচ্ছে নির্বাচন ইস্যুতে দলটির কণ্ঠ আরো জোরালো হচ্ছে। কারণ এই মুহূর্তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণকেই মূল চ্যালেঞ্জ মনে করছেন দলটির নেতারা। তাইতো নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা পেতে সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। দলের নেতাদের ভাষ্য, দ্রুত সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোটের রোডম্যাপ চান তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর যে আকাক্সক্ষা, তা আগের চেয়ে দৃঢ়ভাবে স্পষ্ট হচ্ছে। প্রথম দিকে নতুন সরকারকে সমর্থন জানানোটাই দলগুলোর মূখ্য বিষয় ছিল। তবে এই মুহূর্তে ‘দ্রুত নির্বাচন’ কিংবা ‘নির্বাচন কবে হবে সেই রোডম্যাপ’ চায় রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপিসহ অন্য দলের নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট- তাদের কাছে এখন মূখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে আগামী নির্বাচন। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো বহু বছর পর একটি ভালো নির্বাচনের জন্য যে মুখিয়ে আছে, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সরকারের উচিত এদিকে নজর বাড়িয়ে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করা; না হলে সংকট বাড়বে।
এদিকে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই সাধারণ মানুষের মুখেও ঘুরেফিরে যে প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে, সেটি হচ্ছে- পরবর্তী সংসদ নির্বাচন কবে হবে? অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে সহসা কোনো রোডম্যাপ ঘোষণার ইচ্ছা আছে; এখন পর্যন্ত সে ধরনের লক্ষণ স্পষ্ট নয়। অথচ সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্বের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, কখন নির্বাচন হবে, সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে, আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফা সংলাপ শেষে জানানো হয়েছিল- দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। সে লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, সংবিধান সংস্কার, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে ইতোমধ্যে দশটি কমিশন গঠনও করা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে। মূলত তারপরই সংস্কারের মূল কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে। কিন্তু সংস্কার করতে ঠিক কত সময় লাগবে এবং কবে নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি সরকার।
সংস্কার পর্যন্ত কি অপেক্ষা করবে বিএনপি? :
অন্তর্বর্তী সরকারের এসব সংস্কার তিন মাস বা ছয় মাসে শেষ হওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি সেই সংস্কার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে চলে যাওয়ার দুদিন পরই ৭ আগস্ট বিশাল বিজয় জনসমাবেশে লন্ডন থেকে অনলাইনে সংযুক্ত হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে তিনি বলেন, ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছেন। কেন্দ্রীয় নেতারাও দ্রুত নির্বাচনের তাগাদা দিয়ে প্রতিনিয়তই নরম-গরম বক্তব্য দিচ্ছেন।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এই মুহূর্তে ভাবনা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই মুহূর্তে বিএনপির ‘ফার্স্ট প্রায়োরিটি’ অতিদ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কারণ নির্বাচন করতে যত দেরি হবে; তত দেশের ক্ষতি হবে। তাছাড়া নির্বাচন বিলম্ব করতে যদি সংস্কার প্রক্রিয়াকে সামনে আনা হয়; তবে বলব, সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার। তিনি বলেন, সংস্কার আমরাও চাই। যত দ্রুত নির্বাচন করা যাবে ততই দেশের জন্য কল্যাণকর হবে। নির্বাচনের যৌক্তিক সময়ও আমরা দেব। তবে সেটা সাধ্যের মধ্যে। কোনো রকম টালবাহানা আমরা সহ্য করব না।
এদিকে, সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। এসব বক্তব্য জনমনে সন্দেহ-সংশয় তৈরি হচ্ছে বলেও মনে করে বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই এ সংশয়ের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সম্প্রতি বিএনপির এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের মতো একটি কাক্সিক্ষত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সরকারের বক্তব্যের গড়মিল জনগণের মনে নানা ধরনের সন্দেহ-সংশয়ের উদ্রেক করে। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে আরো দায়িত্বশীল গণমুখী ও কার্যকর দেখতে চায়।
বিরাজনীতিকরণের শঙ্কা! :
নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ পেতে দেরি হওয়ায় বিএনপির নেতারা ১/১১ এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় শুরু হওয়া বিরাজনীতিকরণের চক্রান্ত এখনো চলছে বলে সংশয়ে রয়েছেন। দলটির নেতাদের ভাষ্য- ফ্যাসিবাদ উৎখাতে যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো ছিল বিএনপির মিত্র, নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত হওয়ায় তাদের বেশির ভাগই এখন ঈর্ষান্বিত। এই ঈর্ষা যতটা না সচেতনভাবে তারা চর্চা করে, তার বাইরে অনেক অবচেতনভাবে তা চর্চা করছে। সে কারণে দ্রুত নির্বাচনের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, কোনো ষড়যন্ত্র সহ্য করব না। নির্বাচন যৌক্তিক সময়ে হতে হবে। নির্বাচন করার জন্য কত সময় দরকার তা আমরা জানি, বুঝি। সেই সময়টুকু আমরা দেব। সেই সময়টা অতিক্রান্ত হলে আমরা তারেক রহমানের নেতৃত্বে অবশ্যই ঘরে বসে চিনাবাদাম খাব না। বাস্তবতার নিরিখে যেটা করার ভবিষ্যতে সেটাই করব।
রাজপথে আওয়াজ জোড়ালো হবে :
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দলটি চায়, অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংস্কারকাজ সম্পন্ন করবে। এর বাইরে সংবিধান সংশোধনসহ রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকাজ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার করবে। ফলে এই মুহূর্তে নির্বাচনের বিষয়ে সুস্পষ্ট ফয়সালা হওয়া জরুরি। একই সঙ্গে প্রশাসনিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও রদবদলসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার ইস্যুতে সরকারের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় দলটি। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে দেশে সাংবিধানিক সংকটের আশঙ্কা ও নানামুখী টানাপড়েনে রীতিমতো বিরক্ত বিএনপির হাইকমান্ড। এ পরিস্থিতিতে সরকারের প্রায় ৩ মাসের কার্যক্রম মূল্যায়ন করে রাজপথে থেকে সরকারের ওপর চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছে বিএনপি। সরকারকে সমর্থনের পাশাপাশি দ্রুত আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ছাড়াও নির্বাচন ইস্যুতে জোড়ালোভাবে রাজপথে আওয়াজ তোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ ঐক্যের পাশাপাশি সমমনা অন্যান্য দল ও জোটের সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়াতেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা প্রথম থেকেই এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে দিন-তারিখ ঠিক করে দেইনি। আমরা বারবারই বলেছি অতি দ্রুত এই নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকেও নির্বাচনের সময় নিয়ে এখনো কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি, এটা হতাশার। এ কারণেই সরকারের উদ্দেশে এখন আমাদের জোর গলায় বলতে হচ্ছে- ‘দ্রুত নির্বাচন দিন’। বিএনপির এই সিনিয়র নেতার দাবি- যত দিন যাবে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে এবং ইতোমধ্যে সরকারের এই উপলব্ধি শুরু হয়েছে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

ভোটের চাপ বাড়াচ্ছে বিএনপি

আপলোড টাইম : ০৪:২২:৩৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪


ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই জরুরি সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেয়ার তাগাদা দিয়ে আসছে বিএনপি। তবে যতই দিন গড়াচ্ছে নির্বাচন ইস্যুতে দলটির কণ্ঠ আরো জোরালো হচ্ছে। কারণ এই মুহূর্তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণকেই মূল চ্যালেঞ্জ মনে করছেন দলটির নেতারা। তাইতো নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা পেতে সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। দলের নেতাদের ভাষ্য, দ্রুত সংস্কারকাজ সম্পন্ন করে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোটের রোডম্যাপ চান তারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর যে আকাক্সক্ষা, তা আগের চেয়ে দৃঢ়ভাবে স্পষ্ট হচ্ছে। প্রথম দিকে নতুন সরকারকে সমর্থন জানানোটাই দলগুলোর মূখ্য বিষয় ছিল। তবে এই মুহূর্তে ‘দ্রুত নির্বাচন’ কিংবা ‘নির্বাচন কবে হবে সেই রোডম্যাপ’ চায় রাজনৈতিক দলগুলো। বিএনপিসহ অন্য দলের নেতাদের বক্তব্যে স্পষ্ট- তাদের কাছে এখন মূখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে আগামী নির্বাচন। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ড. রাশেদা রওনক খান বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো বহু বছর পর একটি ভালো নির্বাচনের জন্য যে মুখিয়ে আছে, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সরকারের উচিত এদিকে নজর বাড়িয়ে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রকাশ করা; না হলে সংকট বাড়বে।
এদিকে গত ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই সাধারণ মানুষের মুখেও ঘুরেফিরে যে প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে, সেটি হচ্ছে- পরবর্তী সংসদ নির্বাচন কবে হবে? অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়ে আসছে। যদিও সরকারের তরফ থেকে সহসা কোনো রোডম্যাপ ঘোষণার ইচ্ছা আছে; এখন পর্যন্ত সে ধরনের লক্ষণ স্পষ্ট নয়। অথচ সংবিধানের ১২৩(৩)(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পূর্বের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। ১২৩(৩)(খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, মেয়াদ অবসান ছাড়া অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে।
ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, কখন নির্বাচন হবে, সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে, আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন। পরবর্তীতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দফা সংলাপ শেষে জানানো হয়েছিল- দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। সে লক্ষ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, সংবিধান সংস্কার, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনতে ইতোমধ্যে দশটি কমিশন গঠনও করা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে কমিশনগুলোর প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা রয়েছে। মূলত তারপরই সংস্কারের মূল কাজ শুরু হবে বলে জানা গেছে। কিন্তু সংস্কার করতে ঠিক কত সময় লাগবে এবং কবে নাগাদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানায়নি সরকার।
সংস্কার পর্যন্ত কি অপেক্ষা করবে বিএনপি? :
অন্তর্বর্তী সরকারের এসব সংস্কার তিন মাস বা ছয় মাসে শেষ হওয়ার কথা নয়। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ বাড়ানোর বিকল্প নেই। প্রশ্ন হলো, বিএনপি কি সেই সংস্কার পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে চলে যাওয়ার দুদিন পরই ৭ আগস্ট বিশাল বিজয় জনসমাবেশে লন্ডন থেকে অনলাইনে সংযুক্ত হন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে তিনি বলেন, ‘দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।’ দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছেন। কেন্দ্রীয় নেতারাও দ্রুত নির্বাচনের তাগাদা দিয়ে প্রতিনিয়তই নরম-গরম বক্তব্য দিচ্ছেন।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির এই মুহূর্তে ভাবনা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই মুহূর্তে বিএনপির ‘ফার্স্ট প্রায়োরিটি’ অতিদ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। কারণ নির্বাচন করতে যত দেরি হবে; তত দেশের ক্ষতি হবে। তাছাড়া নির্বাচন বিলম্ব করতে যদি সংস্কার প্রক্রিয়াকে সামনে আনা হয়; তবে বলব, সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার। তিনি বলেন, সংস্কার আমরাও চাই। যত দ্রুত নির্বাচন করা যাবে ততই দেশের জন্য কল্যাণকর হবে। নির্বাচনের যৌক্তিক সময়ও আমরা দেব। তবে সেটা সাধ্যের মধ্যে। কোনো রকম টালবাহানা আমরা সহ্য করব না।
এদিকে, সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন। এসব বক্তব্য জনমনে সন্দেহ-সংশয় তৈরি হচ্ছে বলেও মনে করে বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই এ সংশয়ের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সম্প্রতি বিএনপির এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের মতো একটি কাক্সিক্ষত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সরকারের বক্তব্যের গড়মিল জনগণের মনে নানা ধরনের সন্দেহ-সংশয়ের উদ্রেক করে। জনগণ অন্তর্বর্তী সরকারকে আরো দায়িত্বশীল গণমুখী ও কার্যকর দেখতে চায়।
বিরাজনীতিকরণের শঙ্কা! :
নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ পেতে দেরি হওয়ায় বিএনপির নেতারা ১/১১ এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় শুরু হওয়া বিরাজনীতিকরণের চক্রান্ত এখনো চলছে বলে সংশয়ে রয়েছেন। দলটির নেতাদের ভাষ্য- ফ্যাসিবাদ উৎখাতে যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো ছিল বিএনপির মিত্র, নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত হওয়ায় তাদের বেশির ভাগই এখন ঈর্ষান্বিত। এই ঈর্ষা যতটা না সচেতনভাবে তারা চর্চা করে, তার বাইরে অনেক অবচেতনভাবে তা চর্চা করছে। সে কারণে দ্রুত নির্বাচনের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, কোনো ষড়যন্ত্র সহ্য করব না। নির্বাচন যৌক্তিক সময়ে হতে হবে। নির্বাচন করার জন্য কত সময় দরকার তা আমরা জানি, বুঝি। সেই সময়টুকু আমরা দেব। সেই সময়টা অতিক্রান্ত হলে আমরা তারেক রহমানের নেতৃত্বে অবশ্যই ঘরে বসে চিনাবাদাম খাব না। বাস্তবতার নিরিখে যেটা করার ভবিষ্যতে সেটাই করব।
রাজপথে আওয়াজ জোড়ালো হবে :
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দলটি চায়, অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকার শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সংস্কারকাজ সম্পন্ন করবে। এর বাইরে সংবিধান সংশোধনসহ রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারকাজ জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার করবে। ফলে এই মুহূর্তে নির্বাচনের বিষয়ে সুস্পষ্ট ফয়সালা হওয়া জরুরি। একই সঙ্গে প্রশাসনিক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও রদবদলসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার ইস্যুতে সরকারের প্রতি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয় দলটি। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে দেশে সাংবিধানিক সংকটের আশঙ্কা ও নানামুখী টানাপড়েনে রীতিমতো বিরক্ত বিএনপির হাইকমান্ড। এ পরিস্থিতিতে সরকারের প্রায় ৩ মাসের কার্যক্রম মূল্যায়ন করে রাজপথে থেকে সরকারের ওপর চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছে বিএনপি। সরকারকে সমর্থনের পাশাপাশি দ্রুত আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা ছাড়াও নির্বাচন ইস্যুতে জোড়ালোভাবে রাজপথে আওয়াজ তোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। এছাড়াও অভ্যন্তরীণ ঐক্যের পাশাপাশি সমমনা অন্যান্য দল ও জোটের সঙ্গেও সম্পর্ক বাড়াতেও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।
আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা প্রথম থেকেই এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে দিন-তারিখ ঠিক করে দেইনি। আমরা বারবারই বলেছি অতি দ্রুত এই নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকেও নির্বাচনের সময় নিয়ে এখনো কোনো বক্তব্য দেয়া হয়নি, এটা হতাশার। এ কারণেই সরকারের উদ্দেশে এখন আমাদের জোর গলায় বলতে হচ্ছে- ‘দ্রুত নির্বাচন দিন’। বিএনপির এই সিনিয়র নেতার দাবি- যত দিন যাবে অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে এবং ইতোমধ্যে সরকারের এই উপলব্ধি শুরু হয়েছে।