বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের হাইকোর্টে ঘেরাও-বিক্ষোভ
১২ বিচারপতিকে পাঠানো হলো ছুটিতে- আপলোড টাইম : ০৯:২৬:১৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪
- / ৪৭ বার পড়া হয়েছে
সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করে গতকাল দিনভর বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন শিক্ষার্থী-আইনজীরা। শত শত শিক্ষার্থী ও আইনজীবীদের মিছিল-স্লোগানে উত্তপ্ত ছিল আদালত প্রাঙ্গণ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়াদের মধ্যে দুর্নীতি ও দলকানার অভিযোগ রয়েছে, এমন বিচারপতিদের অপসারণের দাবিতে এই ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হয়। কর্মসূচি পালনের মধ্যেই হাইকোর্টের ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে সরিয়ে ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় সুপ্রিম কোর্ট। চলতি অবকাশ শেষে আগামী ২০ অক্টোবর থেকে এসব বিচারপতিদেরকে বিচারকাজ পরিচালনার জন্য দেওয়া হচ্ছে না কোনো বেঞ্চ। এরা হলেন : বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খান, বিচারপতি নাঈমা হায়দার, বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাস, বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামান, বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামান, বিচারপতি শাহেদ নূরউদ্দিন, বিচারপতি মো. আখতারুজ্জামান, বিচারপতি খিজির হায়াত, বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলন।
ঘেরাও কর্মসূচি পালনের মধ্যেই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের চায়ের নিমন্ত্রণে সাড়া দেন ১২ বিচারপতির মধ্যে বেশ কয়েকজন। পর্যায়ক্রমে তারা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে খাস কামরায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালেই তাদের বেঞ্চ না দেওয়া ও ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। এক ডজন বিচারপতিকে বেঞ্চ না দেওয়া ও ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানানোর পর বিকেল ৪টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আগামী রোববার পর্যন্ত কর্মসূচি স্থগিত রেখে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন। শিক্ষার্থীদের দাবি, শুধু ছুটিতে পাঠালেই হবে না, তাদেরকে বিচারপতির পদ থেকে অপসারণ করতে হবে।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের সঙ্গে বৈঠক : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলম গত মঙ্গলবার রাতে নিজ ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন। পোস্টে তারা বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের সহযোগী দুর্নীতি ও দলবাজ বিচারপতিদের অপসারণে হাইকোর্ট অভিমুখে পদযাত্রা করা হবে।’ ঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে তারা দুপুর ১২টার দিকে হাইকোর্টে প্রবেশ করেন। এর আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ মিছিল নিয়ে হাইকোর্টে অবস্থান নেয়। শিক্ষার্থীদের অবস্থান নেওয়ার আগেই বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজের ব্যানারে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন আইনজীবীরা। আইনজীবীদের পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে বিচারপতিদের অপসারণের দাবিতে নানা স্লোগান দেন। দফায় দফায় করেন বিক্ষোভ মিছিল। কর্মসূচি পালনের এক পর্যায়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ, সারজিস আলম, আরিফ সোহেলসহ বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে সমন্বয়করা বলেন, বিগত দেড় দশকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুপ্রিম কোর্টের ৩০-৩৫ জন বিচারপতি বিচার আসনে বসে দলীয় কর্মীর ন্যায় আচরণ করেছেন। ওই সব বিচারপতি নানা রায় ও আদেশ দিয়ে সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছেন। এতে বিচারকরা শপথ ও আচরণবিধিমালা ভঙ্গ করেছেন। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর এসব বিচারপতির আর বিচার আসনে বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। হয় তারা পদত্যাগ করবেন, নয়তো তাদের অপসারণ করতে হবে।
তখন রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমেদ ভুঞা বলেন, যেসব বিচারপতির বিরুদ্ধে শপথ ও আচরণবিধিমালা ভঙ্গের অভিযোগ রয়েছে, এরকম ১০-১২ জন বিচারপতিকে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। রোববার থেকে ওই সব বিচারপতি আর বিচার কাজে অংশ নিতে পারবেন না। এ পর্যায়ে সমন্বয়করা বলেন, আমাদের কাছে অভিযোগ রয়েছে দুর্নীতি ও দলবাজ বিচারপতিদের সংখ্যা ৩০-৩৫ জন। সেখানে মাত্র স্বল্পসংখ্যক বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো মেনে নেবেন না শিক্ষার্থীরা।
সমন্বয়কদের এই মনোভাব প্রধান বিচারপতিকে তার কামরায় গিয়ে অবহিত করেন রেজিস্ট্রার জেনারেল। সেখান থেকে প্রধান বিচারপতির বার্তা নিয়ে আবার নিজ কার্যালয়ে এসে সমন্বয়কদের তা অবহিত করা হয়। রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত মামলার রিভিউ পিটিশন নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। ওই মামলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না আসার আগে প্রধান বিচারপতির পক্ষ থেকে আর কিছু করা সম্ভব নয়। কারণ বিচারপতি অপসারণের সিদ্ধান্ত একমাত্র রাষ্ট্রপতির হাতে। প্রধান বিচারপতির হাতে যে ক্ষমতা রয়েছে, সেটা তিনি প্রয়োগ করেছেন। এরপরই সমন্বয়কদের নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে এসে বিচারপতিদের বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান রেজিস্ট্রার জেনারেল।
যা বললেন রেজিস্ট্রার জেনারেল :
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, আপনারা জানেন বিচারপতি পদত্যাগ বা অপসারণের প্রক্রিয়া আছে। বর্তমানে দেশে এ সংক্রান্ত কোনো আইন বিদ্যমান নেই। বিগত সরকার সংসদের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের উদ্যোগ নিয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সেটি (ষোড়শ সংশোধনীর মামলা) বাতিল করে দিয়েছিল। তার বিরুদ্ধে সরকার (বিগত আওয়ামী লীগ সরকার) আবার রিভিউ করেছে। আগামী ২০ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এই রিভিউর শুনানি হবে। তিনি বলেন, বিচারপতিদের নিয়োগকর্তা হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। পদত্যাগ বা অপসারণের উদ্যোগও রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে হয়ে থাকে। এখানে প্রধান বিচারপতির যেটা করণীয় উনি সেটা করেছেন। রেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, আপাতত ১২ জন বিচারপতিকে প্রাথমিকভাবে কোনো বেঞ্চ দেওয়া হচ্ছে না। বেঞ্চ না দেওয়ার অর্থই হলো ২০ অক্টোবর কোর্ট খুললে (অবকাশ ছুটির পর) তারা আর বিচারকাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। আর ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ শুনানি ও সিদ্ধান্তের পর পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো শুরু হবে।
সমন্বয়করা যা বললেন :
সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের মামলাটি চলমান আছে। আগামী রোববার ওই মামলায় যদি সমাধান চলে আসে, তাহলে বিচারপতি অপসারণের দায়িত্ব সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। সেদিনই আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সঙ্গে জড়িত বিচারকদের পদত্যাগ করতে হবে। তাদের অপসারণ করা হবে। তারা (সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন) আমাদের কথা দিয়েছেন। ফলে রোববার বিকেল পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব বিচারপতিদের অপসারণের কী সিদ্ধান্ত আসে। তারপর হচ্ছে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ। যদি প্রত্যাশিত সিদ্ধান্ত না আসে তাহলে সোমবার থেকে পরবর্তী কর্মসূচি পুরো বাংলাদেশ দেখবে। তিনি বলেন, ‘যদি মেরুদণ্ডহীন বিচারকগুলো নিজে থেকে পদত্যাগ না করে কিংবা তাদের অপসারণ করা না হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি পদে যিনি বসে আছেন, তিনি যেন ভুলে না যান কাদের অবদানে তিনি এখনো সেখানে বসে আছেন। হাসিনার দালাল বিচারপতিদের অপসারণ করতে হবে। যদি না করা হয় তখন কী অ্যাকশন নিতে হয়, সেটি ছাত্রসমাজ জানে।’ সমন্বয়ক হাসনাত বলেন, ‘আমরা দেখেছি হাইকোর্ট, জজকোর্টসহ আমাদের যতগুলো বিচারালয় আছে, সেখানে দম্ভের সঙ্গে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা মিছিল বের করেছে শেখ হাসিনার পুনর্বাসনের জন্য। ছাত্র-নাগরিকের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে দাবি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাদেরকে গ্রেপ্তার করুন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দোসর যারা সুবিধা দিয়েছে ও নিয়েছে, অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে তারা অপ্রাসঙ্গিক।’
সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘শেখ হাসিনার দালাল বিচারপতিদের অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। এসব বিচারপতি নানা রায় ও আদেশ দিয়ে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ভূমিকা রেখেছিল। এদেরকে পদত্যাগে বাধ্য বা অপসারণ করতে হবে।’ এরপরই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন শিক্ষার্থীরা।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্র-জনতার দাবির মুখে সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন। পরে প্রধান বিচারপতি করা হয় হাইকোর্টের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে।