নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস ২০২৪
- আপলোড টাইম : ০৪:৫৪:৪৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ অক্টোবর ২০২৪
- / ৮২ বার পড়া হয়েছে
-অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান:
Some are born great; some achieves greatness and Some have greatness thrust upon them.
২০০৬ সালের ১৩ অক্টোবর অপরাহ্ন ৩:৩০ মিনিটে, নরওয়ের রাজধানী হতে নোবেল পুরস্কার কমিটির কাছ থেকে ঘোষণা এসেছিল বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ, ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহম্মদ ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরষ্কারের বার্তা। এ বার্তা বাঙালি জাতির জন্য গর্বের বিষয়। আর এ জন্যেই ১৩ অক্টোবর আমাদের বাঙালি জাতির এক অবিস্মরণীয় দিন। জাতি হিসেবে এটি একটি বড় অর্জন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের নোবেল বিজয়ের পর ড. মুহম্মদ ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয় বাঙালি জাতির অহঙ্কার। বাঙালিদের মধ্যে তিনিই তৃতীয় নোবেল বিজয়ী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বে গলা উঁচু করে বলতে পারি আমরা ড. মুহম্মদ ইউনূসের দেশের লোক। তাই নোবেল বিজয়ের ১৮ বছর পর ড. ইউনূস ও তার কার্যক্রম সম্পর্কে দুটি লাইন না লিখলেই নয়।
ড. মুহম্মদ ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কারের মূল থিম ছিল ‘অশান্তির মূল উৎস দারিদ্র্য’। তাইতো পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পৃথিবী থেকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যকে হটানোর ব্রত নিয়ে সহস্রাব্দের বার্তা বাহক হিসেবে নতুন দর্শন নিয়ে বিশ্ব মানব কল্যাণে এগিয়ে এসেছেন ড. মুহম্মদ ইউনূস। দেশ এবং বিদেশের দারিদ্র্য পীড়িত মানুষকে শোনালেন আশার বাণী। অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরষ্কারের মূল থিম ছিল ‘ক্রয়ের অক্ষমতা’ দারিদ্র্যের মূল কারণ। সেই থিমকে বান্তবে রূপ দিয়েছেন ড. ইউনূস।
১৯৪০ সালে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বাথুয়া গ্রামে ড. ইউনূসের জন্ম। গ্রামের স্কুল জীবন শেষ করে ১৯৫৫ সালে ১৬তম স্থান লাভের মাধ্যমে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করেন। ১৯৬০ সালে স্নাতক এবং ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম এ পাশ করেন। ১৯৬১ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে লেকচারার পদে যোগদান করেন। অতঃপর ১৯৬৫ সালে ফুল ব্্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকার নাশভিলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৬৯ সালে। ১৯৬৯-১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি মিডল পেনিসি স্টেট বিশ্ব্বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। অতঃপর দেশে ফিরে ড. ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।
জীবনে মা সুফিয়া খাতুনের মানব প্রেম তিনি পুরোটাই পেয়েছিলেন। ড. ইউনূস সবসময় গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্রত নিয়ে এগিয়ে গেছেন এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন বলেই তার এতো খ্যাতি। তিনি জানতেন দেশের একটি বড় গরিব জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়নই সম্ভব নয়। ড. ইউনূস স্বপ্ন দেখেছিলেন গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণ চালু করে গ্রামের গরিব মানুষ বিশেষত, গরিব মহিলাদের দারিদ্র্য বিমোচনসহ তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
তাইতো ড. ইউনূস বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামের জোবরা গ্রামে কয়েকজন গরিব মহিলাদের নিয়ে মাত্র ১ হাজার ৮ শ টাকা দিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম শুরু করেন। দারিদ্র্য বিমোচনের মূল শক্তি সঞ্চার করে ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে যে ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটানো যায়, তিনি সেটি প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আজ পৃথিবীর অনেক দেশেই ড. ইউনূসের কনসেপ্ট ব্যবহৃত হচ্ছে। তার এ স্বপ্ন স্বার্থক হয়েছে নোবেল পুরষ্কারের মাধ্যমে।
ড. ইউনূস স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলার কৃষকেরা মাঠে কাজ করার সময় তাদের হাতে থাকবে মোবাইল ফোন। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যাতে কৃষকরা তাদের বিভিন্ন কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করতে পারে, তার এ স্বপ্নও বাস্তবে রূপ নিয়েছে। সকলের হাতেই এখন মোবাইল ফোন। আগেই বলেছি দারিদ্র্য শান্তির জন্য হুমকি। শান্তির সঙ্গে দারিদ্র্যের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। বিশ্বে আয়ের বণ্টনের চিত্র থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। বিশ্বে মোট আয়ের ৯৪ শতাংশ যার মাত্র শতকরা ৪০ জনের পকেটে। বাকি শতকরা ৬০ জন বিশ্ব আয়ের মাত্র ৬ শতাংশ দিয়ে জীবন নির্বাহ করে। এটা আর যাই হোক শান্তির জন্য কোনো ফর্মুলা হতে পারে না। অমর্ত্য সেন আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘এটা দুর্ভাগ্যজনক যে অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে ব্যক্তিস্বার্থ ও মুনাফাকেই অর্থনৈতিক অবস্থার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে’।
১৯৯৭ সালে ওয়াশিংটনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি মাইক্রোক্রেটিড সামিট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই সামিটে বলা হয়েছিল ২০০৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ১০ কোটি দরিদ্র পরিবারের নিকট ক্ষুদ্র ঋণ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে এবং পরে এটা সম্ভবও হয়েছে বটে। এই সামিটের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ২০০৫ সালকে ‘আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র ঋণ বর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেন’।
এক সময় আমাদের বাংলার মানুষ মহাজনের কাছ থেকে অধিক মুনাফায় ঋণ নিত। কিন্তু ঋণ পরিষোধ করতে না পারায় তারা বাড়িঘর, সহয়-সম্পদ মহাজনদের দিয়ে ভিটামাটি ছাড়া হতো। শেরে বাংলা ফজলুল হক ঋণ সালিশি বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে মহাজনদের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করেছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে দেশের ধনীরাই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিষোধ করে না, ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়, সেখানে গরিবদের কথা ভাবাই যায় না। কিন্তু অতি সত্য কথা গরিবরাই ঋণ নিয়ে সময় মতো ঋণ পরিষোধ করে থাকে। বাংলাদেশ সরকার এই ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমকে সমর্থন দিয়েছে বলেই ক্ষুদ্র পুঁজি ঋণ আন্দোলন এত ব্যাপকতা লাভ করেছে। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারের অর্থপ্রদানকারী সংস্থা পিকেএসপি-কে ধন্যবাদ জানানো প্রয়োজন। এ কারণেই শুধু বাংলাদেশ নয়, এই ক্ষুদ্রঋণ পদ্ধতি বর্তমানে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিল ক্লিনটন পর্যন্ত এ পদ্ধতিকে দারিদ্র্য বিমোচনের চাবিকাঠি বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ড. ইউনূসের কনসেপ্ট, ক্ষুদ্রপুঁজি ঋণ কার্যক্রম যদি সাবলিল গতিতে চলতে থাকে, তাহলে আগামী ৩০ বছরে দেশের মানুষ আর গরিব থাকবে না। পিআরএসপি বাস্তবায়নেও এ কার্যক্রম ভূমিকা রেখে চলেছে। আমরা আজ গর্বিত। কয়েক বছর আগে নোবেল প্রাইজ কমিটির সভাপতি বাংলাদেশে বেড়াতে এসে বলেছিলেন তোমরা ভাগ্যবান, তোমাদের দেশে ড. ইউনূসের মতো অনেক মেধা লুকিয়ে আছে। আর একটি পরিচয়, তোমরা ড. ইউনুসের দেশের লোক। সেই ড. ইউনূসই বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর নেতৃতে বৈষম্য দূর করে দেশ অবশ্যই সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। তিনি বিশে^র গরীবের বন্ধু। আজকের দিনে ড. ইউনূসের নোবেল বিজয়ের ১৮ বছর পূর্তিতে তার প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও শুভেচ্ছ্।া ড. ইউনূস হোক আমাদের উন্নয়নের প্রতীক। তাঁর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করি।
কলাম লেখক: অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান
সাবেক অধ্যক্ষ
চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজ ও
দর্শনা সরকারি কলেজ