ইপেপার । আজ মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

জীবননগরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন স্কুলশিক্ষক নুরুল ইসলাম

অবসরের টাকায় নিজ বাড়িতে গড়েছেন লাইব্রেরি

মো. মিঠুন মাহমুদ, জীবননগর:
  • আপলোড টাইম : ০১:০৭:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ অক্টোবর ২০২৪
  • / ৯২ বার পড়া হয়েছে

জীবননগর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের থানাপাড়ার রাজনগর গ্রাম। পৌর শহর থেকে এ গ্রামের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। এই গ্রামে দুই-তিন হাজার মানুষের বসবাস। গ্রামটি পৌর শহরে অবস্থিত হলেও এখানকার মানুষের জীবনমানের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে। তবে গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়াতে কাজ করছেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নুরু স্যার। তিনি উপজেলাব্যাপী ও শিক্ষার্থীদের নিকট ব্যাপকভাবে নুরু স্যার হিসেবে পরিচিত হলেও তার পুরো নাম নুরুল ইসলাম। জীবননগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী দৌলৎগঞ্জ সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘসময় শিক্ষকতা করার পর ২০০৭ সালে তিনি অবসর নিয়েছেন।
দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে তিনি জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর ২০০৭ সালে অবসর নেওয়ার পর ২০০৯ সালে নিজ বাড়িতে একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন একটি লাইব্রেরি। তার লাইব্রেরিতে দুই সহস্রাধিকের মতো বই রয়েছে। তার লাইব্রেরিতে ধর্মীয়ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সংক্রান্ত বইয়ের সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু-কিশোর ও নারী শিক্ষা, রান্ন বিষয়ক বই তার লাইব্রেরিতে রয়েছে। তবে ঘরে বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং এ বই নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। আর্থিক অনটনের কারণে তিনি ভালো ব্যবস্থা করতে পারছেন না। তবে তার প্রবল ইচ্ছা লাইব্রেরিটি উন্নত পরিবেশ ও বইয়ে বইয়ে ভরে ওঠার।
নুরু স্যার জানান, প্রতি মাসে অবসর ভাতা পেলেই কিছু বই কিনে বাড়ি ফিরেন। এমনও দিন গেছে বাজারের ব্যাগ নিয়ে গেছেন বাজার করতে কিন্তু বাজার করা হয়নি, কারণ এসময় তার বই পছন্দ হওয়ায় বই কিনে বাড়ি ফিরেছেন, বাজার করেননি।
তিনি জানান, তার দৃষ্টিতে লাইব্রেরির বইগুলো তার সন্তানের মতো। অন্যান্য লাইব্রেরির চেয়ে তার লাইব্রেরিটি ব্যতিক্রমধর্মী। তার পাঠাগারে সকাল-বিকেল শিশু থেকে বৃদ্ধরা বই পড়তে আসে। তবে সেখানে বসার জন্য নেই কোনো চেয়ার-টেবিল। অনেক পাঠক তাদের পছন্দ মতো তার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে যায় এবং পড়া শেষে আবার বইটি ফেরত দিয়ে যান। তবে তিনি কারও নিকট থেকে কোনো টাকা-পয়সা নেন না। তবে কেউ ইচ্ছা করলে খুশি হয়ে দু-একটি বই কিনে দিতে পারেন। তিনি ভালো কোনো বইয়ের সন্ধান পেলে তা কিনতে অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি ধার-দেনা করে হলেও সেই বই কেনেন।
পাঠাগারের নিয়মিত কয়েকজন পাঠক বলেন, ‘আমরা নুরু স্যারের ছাত্র। আমাদের এলাকায় জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোনো পাঠাগার নেই। তবে স্যারের একক প্রচেষ্টায় তার বাড়িতে লাইব্রেরি গড়ে তোলা লাইব্রেরিতে ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরেরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আমরা তার পাঠাগারে নিয়মিত পাঠক।
তারা আরও বলেন, অনেক সময় বই নিয়ে যায় এবং পড়া শেষে তা ফেরত দেয়। তবে নুরু স্যার বিনিময়ে কোনো টাকা-পয়সা কারও নিকট থেকে নেন না। স্যারকে কেউ যদি সহযোগিতা করতেন তাহলে তিনি আরও বই কিনে পাঠকদের জন্য পড়ার সুযোগ করে দিতে পারতেন। স্যার অভাবগ্রস্ত মানুষ। তার সাধ থাকলেও পাঠাগারটি বইয়ে বইয়ে ভরে তোলার মতো কোনো সাধ্য নেই। তবে স্যারের অনেক ছাত্র-ছাত্রী দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। তারা ইচ্ছা করলেই স্যারের শেষ জীবনের ইচ্ছাটুকু পূরণ করতে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারেন।
নুরুল ইসলাম নুরু স্যার আরও বলেন, ছাত্রজীবন থেকে আমার বই পড়ার ওপর প্রবল ঝোঁক ছিল। সে সময় আমি অর্থাভাবে বই কিনে পড়তে পারিনি। চাকরি জীবনেও সুযোগ পাইনি। সেসময় থেকে আমার শখ ছিল কখন যদি সুযোগ হয় ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলব। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পরই বই সংগ্রহ শুরু করি এবং বর্তমানে নিজ বাড়িতে ছোট পরিসরে একটি পাঠাগার তৈরি করেছি। তবে এখনও ইচ্ছানুযায়ী বই সংগ্রহ করতে পারিনি। প্রতি মাসে যে অবসর ভাতা পাই তা দিয়ে কিছু কিছু বই কিনে পাঠাগারটি সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, আমার অনেক ছাত্র-ছাত্রী বর্তমানে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় বড় কর্মকর্তা হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। আমার বিশ্বাস তাদের কাছে পাঠাগারের ব্যাপারে সহযোগিতা চাইলে তারা না করবে না। কিন্তু আমি তো লজ্জায় তাদের সাথে বলতে পারি না। আমি চাই এলাকার বিত্তবানদের পাশাপাশি আমার হাতে গড়া ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে আসুক। বর্তমানে পাঠাগারটি নিয়েই আমার যত স্বপ্ন- সাধনা। আমার মৃত্যুর পরও আমি পাঠাগার ও পাঠকের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

জীবননগরে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছেন স্কুলশিক্ষক নুরুল ইসলাম

অবসরের টাকায় নিজ বাড়িতে গড়েছেন লাইব্রেরি

আপলোড টাইম : ০১:০৭:০০ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ অক্টোবর ২০২৪

জীবননগর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের থানাপাড়ার রাজনগর গ্রাম। পৌর শহর থেকে এ গ্রামের দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার। এই গ্রামে দুই-তিন হাজার মানুষের বসবাস। গ্রামটি পৌর শহরে অবস্থিত হলেও এখানকার মানুষের জীবনমানের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি বললেই চলে। তবে গ্রামে শিক্ষার আলো ছড়াতে কাজ করছেন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নুরু স্যার। তিনি উপজেলাব্যাপী ও শিক্ষার্থীদের নিকট ব্যাপকভাবে নুরু স্যার হিসেবে পরিচিত হলেও তার পুরো নাম নুরুল ইসলাম। জীবননগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী দৌলৎগঞ্জ সরকারি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘসময় শিক্ষকতা করার পর ২০০৭ সালে তিনি অবসর নিয়েছেন।
দীর্ঘ শিক্ষকতার জীবনে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে তিনি জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর ২০০৭ সালে অবসর নেওয়ার পর ২০০৯ সালে নিজ বাড়িতে একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন একটি লাইব্রেরি। তার লাইব্রেরিতে দুই সহস্রাধিকের মতো বই রয়েছে। তার লাইব্রেরিতে ধর্মীয়ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সংক্রান্ত বইয়ের সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিশু-কিশোর ও নারী শিক্ষা, রান্ন বিষয়ক বই তার লাইব্রেরিতে রয়েছে। তবে ঘরে বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা এবং এ বই নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট নন। আর্থিক অনটনের কারণে তিনি ভালো ব্যবস্থা করতে পারছেন না। তবে তার প্রবল ইচ্ছা লাইব্রেরিটি উন্নত পরিবেশ ও বইয়ে বইয়ে ভরে ওঠার।
নুরু স্যার জানান, প্রতি মাসে অবসর ভাতা পেলেই কিছু বই কিনে বাড়ি ফিরেন। এমনও দিন গেছে বাজারের ব্যাগ নিয়ে গেছেন বাজার করতে কিন্তু বাজার করা হয়নি, কারণ এসময় তার বই পছন্দ হওয়ায় বই কিনে বাড়ি ফিরেছেন, বাজার করেননি।
তিনি জানান, তার দৃষ্টিতে লাইব্রেরির বইগুলো তার সন্তানের মতো। অন্যান্য লাইব্রেরির চেয়ে তার লাইব্রেরিটি ব্যতিক্রমধর্মী। তার পাঠাগারে সকাল-বিকেল শিশু থেকে বৃদ্ধরা বই পড়তে আসে। তবে সেখানে বসার জন্য নেই কোনো চেয়ার-টেবিল। অনেক পাঠক তাদের পছন্দ মতো তার লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে যায় এবং পড়া শেষে আবার বইটি ফেরত দিয়ে যান। তবে তিনি কারও নিকট থেকে কোনো টাকা-পয়সা নেন না। তবে কেউ ইচ্ছা করলে খুশি হয়ে দু-একটি বই কিনে দিতে পারেন। তিনি ভালো কোনো বইয়ের সন্ধান পেলে তা কিনতে অস্থির হয়ে পড়েন। তিনি ধার-দেনা করে হলেও সেই বই কেনেন।
পাঠাগারের নিয়মিত কয়েকজন পাঠক বলেন, ‘আমরা নুরু স্যারের ছাত্র। আমাদের এলাকায় জ্ঞান অন্বেষণের জন্য কোনো পাঠাগার নেই। তবে স্যারের একক প্রচেষ্টায় তার বাড়িতে লাইব্রেরি গড়ে তোলা লাইব্রেরিতে ছাত্র-ছাত্রীদের পাশাপাশি নারী-পুরুষ ও শিশু-কিশোরেরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। আমরা তার পাঠাগারে নিয়মিত পাঠক।
তারা আরও বলেন, অনেক সময় বই নিয়ে যায় এবং পড়া শেষে তা ফেরত দেয়। তবে নুরু স্যার বিনিময়ে কোনো টাকা-পয়সা কারও নিকট থেকে নেন না। স্যারকে কেউ যদি সহযোগিতা করতেন তাহলে তিনি আরও বই কিনে পাঠকদের জন্য পড়ার সুযোগ করে দিতে পারতেন। স্যার অভাবগ্রস্ত মানুষ। তার সাধ থাকলেও পাঠাগারটি বইয়ে বইয়ে ভরে তোলার মতো কোনো সাধ্য নেই। তবে স্যারের অনেক ছাত্র-ছাত্রী দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। তারা ইচ্ছা করলেই স্যারের শেষ জীবনের ইচ্ছাটুকু পূরণ করতে সহযোগিতার হাত বাড়াতে পারেন।
নুরুল ইসলাম নুরু স্যার আরও বলেন, ছাত্রজীবন থেকে আমার বই পড়ার ওপর প্রবল ঝোঁক ছিল। সে সময় আমি অর্থাভাবে বই কিনে পড়তে পারিনি। চাকরি জীবনেও সুযোগ পাইনি। সেসময় থেকে আমার শখ ছিল কখন যদি সুযোগ হয় ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলব। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পরই বই সংগ্রহ শুরু করি এবং বর্তমানে নিজ বাড়িতে ছোট পরিসরে একটি পাঠাগার তৈরি করেছি। তবে এখনও ইচ্ছানুযায়ী বই সংগ্রহ করতে পারিনি। প্রতি মাসে যে অবসর ভাতা পাই তা দিয়ে কিছু কিছু বই কিনে পাঠাগারটি সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, আমার অনেক ছাত্র-ছাত্রী বর্তমানে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বড় বড় কর্মকর্তা হয়ে দায়িত্ব পালন করছেন। আমার বিশ্বাস তাদের কাছে পাঠাগারের ব্যাপারে সহযোগিতা চাইলে তারা না করবে না। কিন্তু আমি তো লজ্জায় তাদের সাথে বলতে পারি না। আমি চাই এলাকার বিত্তবানদের পাশাপাশি আমার হাতে গড়া ছাত্রছাত্রীরা এগিয়ে আসুক। বর্তমানে পাঠাগারটি নিয়েই আমার যত স্বপ্ন- সাধনা। আমার মৃত্যুর পরও আমি পাঠাগার ও পাঠকের মাঝে বেঁচে থাকতে চাই।