প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে পাঁচটি দল ও দুটি জোটের সংলাপ
বিএনপি নির্বাচনের রোড ম্যাপ, জামায়াত চায় সংস্কার- আপলোড টাইম : ০৩:১০:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০২৪
- / ৮৪ বার পড়া হয়েছে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপে নির্বাচন কবে হবে সে বিষয়ে একটি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। তবে, সংলাপে নির্বাচনের আগে মৌলিক সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিতে বলেছে জামায়াতে ইসলামী, দলটি সরকারের কাছে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে দুটি রোডম্যাপ চেয়েছে। গতকাল শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে দল দুটি এই দাবি জানিয়েছে। সংলাপে ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও ছিলেন।
অন্যদিকে, সংলাপে অংশ নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা এবং নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, তারা কেবল নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছেন না, দেশে যেন ফ্যাসিবাদ আর ফিরে আসতে না পারে সে জন্য সংস্কার প্রয়োজন। চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ‘আনুপাতিক হার’ ব্যবস্থার নির্বাচন চেয়েছে, একইসঙ্গে আরো নয়টি সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে দলটি। আর, বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা সংলাপে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ এবং আইনশৃঙ্খরা স্বাভাবিক করতে না পারায় উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।
সরকার গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের অগ্রগতি অবহিত করতে ও এবিষয়ে মতামত নিতে এবং দেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গতকাল থেকে সংলাপ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল প্রথম দিনে মোট পাঁচটি রাজনৈতিক দল এবং দুটি জোটের নেতারা সংলাপে অংশ নেন। দলগুলো হলো- বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি। আর সংলাপে অংশ নেওয়া দুটি জোট হচ্ছে- গণতন্ত্র মঞ্চ ও বাম গণতান্ত্রিক জোট
দুপুর আড়াইটায় বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের মধ্যদিয়ে এই সংলাপ শুরু হয়। বিএনপির সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা করেন ড. ইউনূসের নেতৃত্বে উপস্থিত উপদেষ্টারা। এরপর পর্যায়ক্রমে জামায়াত, গণতন্ত্র মঞ্চ, বাম গণতান্ত্রিক জোট, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং এবি পার্টির সঙ্গে সংলাপ হয়। উল্লেখ্য, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকার দুই দফা সংলাপ করে। গতকাল তৃতীয় দফায় সংলাপ শুরু করেছে অন্তর্র্বতী সরকার।
সরকার বলেছে নির্বাচন এক নম্বর অগ্রাধিকার: মির্জা ফখরুল
সংলাপ শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যমুনার সামনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বলেছেন, নির্বাচন করা অন্তর্বর্তী সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার, এটি প্রধান উপদেষ্টা তাদের জানিয়েছেন। বৈঠকে প্রধান আলোচনা ছিল নির্বপ্রণ সংক্রান্ত এবং নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার ও কমিশন নিয়ে। সংলাপে আবারও নির্বাচনের রোডম্যাপের দাবি তুলে ধরার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। কবে নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। জাতীয় পরিচয়পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে দেওয়ার যে আইন করা হয়েছে বিগত সরকারের সময়ে, সেটিও বাতিল চেয়েছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেন, বিতর্কিত কোনো ব্যক্তি যাতে নির্বাচন সংস্কার কমিটিতে না থাকে, সেটিও তারা চেয়েছেন। ফ্যাসিবাদের সময় গঠিত সব ইউনিয়ন পরিষদ বাতিলের দাবিও জানিয়েছেন তারা। বিএনপির মহাসচিব জানান, ২০১৪ সাল থেকে পরপর তিনটি বিতর্কিত ও ভুয়া নির্বাচন করেছে যেসব নির্বাচন কমিশন (ইসি), সেই কমিশনগুলোর প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ (সিইসি) অন্যদের আইনের আওতায় আনার কথা বলেছেন তারা। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হককেও আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা মনে করি, বিচারপতি খায়রুল হক নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করার মূল হোতা। কারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দিয়ে এই বিচারপতি নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংসের মূল ভূমিকা পালন করেন। তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে। বিএনপির মহাসচিব বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অনেকে দোসর হয়ে কাজ করেছে এবং লুটপাট ও মানুষের ওপর নির্যাতনে সহায়তা করেছে। এছাড়া গুম, খুন ও গণহত্যায় সহায়তাকারীদের অনেকেই এখনো নিজ নিজ জায়গায় বহাল আছে, অবিলম্বে তাদের সরিয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সেসব পদে নিয়োগ করার দাবিও তারা জানিয়েছেন। মির্জা ফখরুল বলেন, জেলা প্রশাসকদের নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তাদের নিয়োগ বাতিল করতে বলেছি। চুক্তিভিত্তিক কিছু নিয়োগ বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছি। তিনি বলেন, বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যেও দুই-একজন আছেন যারা এই গণ-অভ্যুত্থানের বিপ্লবের যে স্পিরিট, সেটাকে ব্যাহত করছেন, তাদের সরানোর কথা বলেছি। তিনি বলেন, হাইকোর্ট বিভাগে এখনো পরিবর্তন হয়নি, বেশিরভাগ নিয়োগ ছিল দলীয় ভিত্তিতে। এদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলেছি। অতিদ্রুত পিপি ও জিপি নতুন নিয়োগের কথা বলেছি। তিনি বলেন, যাদের সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তাদের জামিন দেওয়া হচ্ছে। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিষয়টা আমরা দেখার জন্য বলেছি। ২০০৭ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আমলে দায়েরকৃত সব মিথ্যা মামলা; গায়েবি, ভুয়া ও সাজানো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা মামলা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নিতে বলেছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, কিছু আমলা, কিছু পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তি এবং মন্ত্রীরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে। কার সহযোগিতায় পালাচ্ছে, সেবিষয়ে সরকারকে দেখার জন্য বলেছি। আরেকটা বিষয় জোর দিয়ে বলেছি, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ভারতে আছেন। ভারতে থেকে তার মাধ্যমে যেসমস্ত প্রচারণা চলছে, এই বিষয়টাতে ভারতের সরকারের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য; অন্তর্বর্তী সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে কথা বলবে। এছাড়া গুম-খুনের সঙ্গে যারা জড়িত তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে, জাতিসংঘের একটি দল এসেছে, তাদের সেভাবে সহযোগিতা করছে না, দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে কিছু মানুষ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানি দিচ্ছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে; এসব প্রসঙ্গ সংলাপে তুলে ধরেছেন বলে জানান বিএনপির মহাসচিব।
বিএনপির মহাসচিবের নেতৃত্বে সংলাপে অংশ নেওয়া দলটির অন্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, ড. আব্দুল মঈন খান ও সালাহ উদ্দিন আহমেদ। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ ও আদিলুর রহমান খান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে দুটি রোডম্যাপ চেয়েছি: শফিকুর রহমান
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা আলোচনা করেন জামায়াত নেতারা। সংলাপে জামায়াতের পক্ষ থেকে সংস্কারকে এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরা হয় বলে জানান দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, সংস্কারের সময় কী হবে, সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা দুটি বিষয় চেয়েছি, একটা রোডম্যাপ হবে সংস্কারের, আরেকটা নির্বাচনের। সংস্কার সফল হলে নির্বাচন সফল হবে। দুটি বিষয়ে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের আমির বলেন, ৯ অক্টোবর আপনাদের মাধ্যমে সংস্কারের ব্যাপারে আমাদের প্রস্তাবনাগুলো আমরা জাতির সামনে আমরা উন্মুক্ত করব। আমরা আমাদের চিন্তা জাতির সামনে তুলে ধরব কী কী সংস্কার এই মুহূর্তে প্রয়োজন; কী কী সংস্কার পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের লাগবে। সরকার দেশ শাসনের জন্য আসেনি, দেশ শাসনের সুষ্ঠু পথ বিনির্মাণের জন্য তারা এসেছে বলেও মন্তব্য করেন জামায়াতের আমির। তিনি বলেন, সরকারের কাজ হচ্ছে, গত তিনটি নির্বাচনে জাতি বঞ্চিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে একটা গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। এজন্য কিছু মৌলিক বিষয়ে তাদের সংস্কার করতেই হবে। কী কী মৌলিক বিষয়ে তারা সংস্কার করবে, সংলাপে আমরা সেবিষয়ে কথা বলেছি। শফিকুর রহমান জানান, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে কথা হয়েছে। জনগণ এবং সরকার একসঙ্গে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও উন্নত করতে পারে; সব ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারে, সেই বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয়েছে। আমরা আশা করছি, বর্তমান যে সরকার আছে, তারা কোনো ধরনের পক্ষ-বিপক্ষের মানসিকতা না নিয়ে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেশকে একটা ভালো পর্যায়ে নিয়ে নির্বাচন দিতে সক্ষম হবেন। জামায়াতের আমির বলেন, আমরা শুরু থেকে বলে আসছিলাম সংস্কারের জন্য সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে চাই। সেই যৌক্তিক সময়টা কী হবে? এটা নিয়ে অচিরেই আমরা কাজ করব। এটা দেরি হবে না, এভাবে আমরা সামনে এগোতে চাই। দুর্গাপূজায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখার জন্য করণীয় কী, এমন একটি প্রশ্ন এসেছিল। আমরা এবিষয়ে আলোচনা করেছি। শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে সংলাপে অংশ নেন জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, আনম শামসুল ইসলাম, মুজিবুর রহমান, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল হালিম প্রমুখ।