হঠাৎ অশান্ত পাহাড়, ভয়াবহ দাঙ্গার শঙ্কা
- আপলোড টাইম : ০৩:০০:২৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪
- / ১৭ বার পড়া হয়েছে
ফের রক্তাক্ত পাহাড়। এবার ভিন্ন আঙ্গিকে; পাহাড়ি-বাঙালি দাঙ্গা। খাগড়াছড়ি জেলা সদরে মোটরসাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে এক যুবককে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে অশান্ত হয়ে উঠেছে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। দফায় দফায় সংঘর্ষ, গোলাগুলি, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি জেলায়। দুই জেলায় চারজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জেলা দুটিতে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। মোতায়েন করা হয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ সেনাবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি সদস্য। তবে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষের ঘটনা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ-মূল) সন্ত্রাসীদের ইন্ধনে পরিস্থিতি বেশি খারাপের দিকে যাচ্ছে। দ্রুতই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে সংঘর্ষের এই ঘটনা ৩ পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা। পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি, সৌহার্দ ও সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়া এবং ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত না হওয়ার জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ঘটনার সূত্রপাত থেকে সংঘর্ষে রূপ নেয়ার বিষয়ে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে জানানো হয়েছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলা সদরে মোটরসাইকেল চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে মো. মামুন (৩০) নামে একজন যুবক নিহত হয়। পরবর্তী সময়ে সদর থানা পুলিশ নিহতের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরদিন গত বৃহস্পতিবার বিকেলে দীঘিনালা কলেজ থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি দীঘিনালার বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় ইউপিডিএফের (মূল) সন্ত্রাসীরা মিছিলের ওপর হামলা করে ও ২০-৩০ রাউন্ড গুলি ছুড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষুব্ধ জনতা বোয়ালখালী বাজারের কয়েকটি দোকানে অগ্নিসংযোগ করে।
সংঘর্ষ চলাকালে উভয় পক্ষের ৬ জন আহত হলে তাদের চিকিৎসার জন্য দীঘিনালা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর টহল দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে এবং ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় জনসাধারণের সহায়তায় আগুন নেভায়। উপরোক্ত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা, পানছড়ি ও আশপাশের এলাকাসমূহে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেসঙ্গে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে ক্রমেই পরিস্থিতিকে আরো উত্তেজনাকর করে তুলে। দ্রুততার সঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে জরুরি ভার্চুয়াল সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, দীঘিনালা ও পানছড়িসহ সব উপজেলায় যৌথভাবে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সমন্বয়ে টহল দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন কমিউনিটি লিডারদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সব পক্ষকে সহিংস কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেয়া হয়। ওই রাতেই সেনা সদস্যরা একজন মুমূর্ষ রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য স্থানান্তরের সময় খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীরা বাধা দেয়। সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহল দলের সদস্যদের ওপর গুলি করে এবং আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনী পাল্টা গুলি চালায়। এই গোলাগুলির ঘটনায় ৩ জন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। একই ঘটনার ধারাবাহিকতায় খাগড়াছড়ি জেলার পানছড়িতে স্থানীয় কয়েকজন যুবকের মোটরসাইকেল থামিয়ে তাদের ওপর হামলা ও লাঠিপেটা করে সন্ত্রাসীরা। সেসঙ্গে ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বে ফায়ার সার্ভিস অফিসে ভাঙচুর চালানো হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ কর্তৃক রাঙ্গামাটি জেলা সদরে ‘সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন’ এর ব্যানারে স্থানীয় জনসাধারণ রাঙ্গামাটি জিমনেশিয়াম এলাকায় সমবেত হয়। এ সময় হাজারখানেক লোক একটি মিছিল বের করে বনরূপা এলাকার দিকে অগ্রসর হয় এবং বনরূপা বাজার মসজিদ, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সিএনজি-অটোরিকশা, মোটরসাইকেল এবং বেশ কিছু দোকানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে উভয় পক্ষের বেশ কিছু লোকজন আহত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে রাঙ্গামাটি জেলা সদরে ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা প্রশাসন।
আইএসপিআর জানায়, এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চলমান উত্তেজনা তিন পার্বত্য জেলায় ভয়াবহ দাঙ্গায় রূপ নিতে পারে। অনতিবিলম্বে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের চলমান উত্তেজনা প্রশমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য অনুরোধ জানানো যাচ্ছে। যথাযথ তদন্ত কার্যক্রম সম্পাদনের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শনাক্তপূর্বক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিন পার্বত্য জেলায় শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখতে সর্বসাধারণকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
এদিকে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির সংঘর্ষের জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতভর জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনায় পুরো জেলায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। রাতের গোলাগুলি ও বিকালের সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)।
এ ঘটনার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকালে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এ সময় পাহাড়িরা মিছিলে বাধা দেন বলে অভিযোগ। তখন সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। একপর্যায়ে পাহাড়িদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পাহাড়িরা ঘরবাড়ি ছেড়ে গহীন পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যান। বোয়ালখালী বাজার এলাকার বাসিন্দা মো. লোকমান হোসেন বলেন, মামুন হত্যার বিচারের দাবিতে শান্তিপূর্ণভাবে তারা মিছিল বের করেছিলেন। পরে পাহাড়িরা এসে বাধা দিয়েছেন। এ জন্য ঝামেলার সৃষ্টি হয়েছে। লোকমান বলেন, এভাবে ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হবে, এটা ভাবিনি। লারমা স্কয়ার এলাকার বাসিন্দা রিপন চাকমা বলেন, মিছিলে পাহাড়িরা কেউ বাধা দেননি। মিছিল থেকেই অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়ে আগুন দেয়া হয়েছে।
এ ঘটনার পর খাগড়াছড়ি শহরে পাহাড়ি ও বাঙালিদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। এর জের ধরে বৃহস্পতিবার রাতে শহরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। রাতভর সেখানে আতঙ্ক বিরাজ করে। সীমিত করে দেয়া হয় ইন্টারনেট সেবা। সদরের বাসিন্দারা অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান বলেন, রাতে গোলাগুলি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মোহাম্মদ সহিদুজ্জামান আরো বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে খাগড়াছড়িতে গতকাল দুপুর ২টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
খাগড়াছড়িতে ‘পাহাড়ি-বাঙালি’ সংঘর্ষ ও মৃত্যুর ঘটনার জেরে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে আরেক পার্বত্য শহর রাঙ্গামাটিতেও। সেখানে সংঘর্ষে মারা গেছেন একজন, আহত হয়েছেন অন্তত ৫০ জন। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পর বেলা দেড়টা থেকে রাঙ্গামাটি পৌর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোশাররফ হোসেন। স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষ ও মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে সকালে শহরের জিমনেসিয়াম চত্বর থেকে কয়েক হাজার পাহাড়ির একটি মিছিল বের হয়। তারা শহরের বনরূপা এলাকায় গেলে সেখানে মিছিলে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে- এমন অভিযোগ করে বাঙালিদের বেশ কিছু দোকানপাট ও বনরূপা মসজিদে ভাঙচুর করা হয়। এসময় সড়কে চলাচলকারী বেশ কিছু বাস-ট্রাক-অটোরিকশাও ভাঙচুর করে মিছিলকারীরা। এরপরই লাঠিসোটা হাতে পাহাড়িদের ধাওয়া করে বাঙালিরা। শুরু হয় ধাওয়া-পালটা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ।
শাহবাগ মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ :
খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় দুই পক্ষের সংঘর্ষের পর সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যরা। গতকাল শুক্রবার বেলা পৌনে ১২টার পর এ অবরোধ শুরু হয়। এতে শাহবাগ এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য এলাকায় বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন তারা। দীঘিনালায় বাঙালি-পাহাড়ি সংঘর্ষের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও সামরিকায়ন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন তারা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে ৭২ ঘণ্টা অবরোধ ঘোষণা :
খাগড়াছড়ির দিঘীনালায় পাহাড়িদের ওপর হামলা, বাড়িঘর ও দোকানে আগুন দেয়া ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে তিনজন নিহতের প্রতিবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৭২ ঘণ্টা অবরোধের ডাক দিয়েছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। আজ শনিবার সকাল ছয়টা থেকে নৌ ও সড়ক পথে এ অবরোধ পালন করা হবে। শাহবাগ মোড়ে অবরোধ কর্মসূচি শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক ছাত্র নভাংশু চাকমা এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এসময় বক্তব্য দেন ড. আজয় প্রকাশ চাকমা, রুবাইয়া শ্রেষ্ঠা তঞ্চঙ্গ্যা, মানবাধিকার কর্মী ইলিরা দেওয়ান, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অংকন চাকমা, ছাত্রনেতা অজেল ত্রিপুরা প্রমুখ। ছাত্র-জনতার সমাবেশ থেকে সাত দফা দাবি জানানো হয়।