ইপেপার । আজ শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পৈশাচিক দুই হত্যাকাণ্ড ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:০৪:২৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৫ বার পড়া হয়েছে

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই যুবককে পৈশাচিকভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দুটি হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সারা দেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। দেশের শীর্ষ দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এমন অমানবিক আচরণ মেনে নিতে পারছেন না কেউ। দ্রুত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি উঠেছে। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অপরাধীদের বিচারের আশ্বাস দিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বিচারের কথা বললেও এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
গত বুধবার বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দুই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের মাঠে অপরিচিত এক যুবককে দেখে আটক করে কয়েক জন শিক্ষার্থী। তাকে ধরে হলের গেস্ট রুমে নিয়ে যায়। সেখানে এক দফা তাকে পেটানো হয়। এরপর তাকে রাতের খাবার খাইয়ে আরেক দফা নৃশংশভাবে পেটানো হয়। একপর্যায়ে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। ঐ যুবকের নাম তোফাজ্জল হোসেন। তার বাড়ি বরগুনায়। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে গণপিটুনি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির হাতে তুলে দেয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের হেফাজতে থাকা অবস্থায়ও তার ওপর কয়েক দফা হামলা ও নির্যাতন হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিত্সকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢাবির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে। আর তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে জাবি কর্তৃপক্ষ।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. তালেবুর রহমান বলেন, এটি তদন্তের বিষয়। তদন্তের মাধ্যমে পুরো ঘটনা বেরিয়ে আসবে। পাঁচ শিক্ষার্থীকে ঢাবির প্রক্টরিয়াল বডি আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের ডিবি কাজ করছে। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। আশাকরি দ্রুতই রহস্য উন্মোচন হবে।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাবুদ্দিন শাহীন পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন। আটক শিক্ষার্থীরা হলেন হল ছাত্রলীগের সাবেক উপবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের জালাল আহমেদ; মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের মোহাম্মদ সুমন; পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মোত্তাকিন সাকিন, গণিত বিভাগের আহসান উল্লাহ (২৪) এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের আল হোসাইন সাজ্জাদ।

যেভাবে এই হত্যাকাণ্ড :
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গত বুধবার বিকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে দেখতে পান কয়েক জন শিক্ষার্থী। পরে তাকে কয়েক দফা পিটিয়ে প্রক্টর অফিসে নেওয়া হয়। সেখানেও কয়েক দফা মারধরের শিকার হন শামীম। পরে তাকে আশুলিয়া থানার পুলিশের হাতে তুলে দিলে গুরুতর আহত অবস্থায় গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে রাত ১১টার দিকে তিনি মারা যান। নিহত শামীম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, গত ১৫ জুলাই রাতে উপাচারে‌্যর বাসভবনে অবস্থানরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শামীম। একইদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত তোফাজ্জলের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলি ইউনিয়নে। বুধবার সন্ধ্যায় চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটকের পর গেস্টরুমে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাকে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করে শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে ঐ যুবককে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর পুনরায় মারধর করা হয়। পরে রাত ১২টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান কয়েক শিক্ষার্থী। সেখানে চিকিৎসক তোফাজ্জলকে মৃত ঘোষণা করলে ঐ শিক্ষার্থীরা মরদেহ রেখেই পালিয়ে ক্যাম্পাসে চলে আসেন বলে কয়েক জন ছাত্র জানিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ক্যাম্পাসের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। কেউ চুরি করতে আসলেও তাকে পিটিয়ে হত্যার অধিকার কারো নেই। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ও ভিডিও দেখে দায়ীদের শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় হলের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হবে।

তোফাজ্জলের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি:

ঢাবিতে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জলের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তোফাজ্জলের মামাতো বোন তানিয়া। তিনি জানান, তোফাজ্জলের মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই। রাত ১১টার সময় আমার বাবাকে ফোন দেওয়া হয়েছে। ও প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘আপনি কি তোফাজ্জলের মামা? আমার আব্বা ফোন ধরছে। তখন বলছে, ওরে (তোফাজ্জল) আমরা আটকাইছি, হলেই আছে, ওরে নিতে হলে টাকা দিতে হবে ৩৫ হাজার। ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে ওরে ছাড়িয়ে নেন, না হলে আমরা ওরে ছাড়ব না, আরো মারব।’

ঢাবিতে বিক্ষোভ, তদন্ত কমিটি:
মব জাস্টিসের নামে হত্যা বন্ধ এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্করে‌্যর সামনে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ব্যানারসহ সেখানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল কর্তৃপক্ষ সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আলমগীরকে। এছাড়া নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যানারেও প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমেও চলছে তীব্র প্রতিবাদ।

জাহাঙ্গীরনগরে প্রতিবাদ মিছিল:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল বিক্ষোভ মিছিল করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দিক প্রদক্ষিণ শেষে রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে গিয়ে মিছিল শেষ করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নানা স্লোগান দেন। পাশাপাশি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানান। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম জানান, শামীম মোল্লাকে যখন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখন সে হেঁটেই গাড়িতে উঠে। তবে কিছুক্ষণ পর পুলিশের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুর বিষয়টি জানানো হয়। তিনি বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের তদন্ত সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার করা হবে।

ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ:
ক্যাম্পাসে দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তারা এই আহ্বান জানান। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব। তিনি বলেন, চোর সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে আটকে রেখে তোফাজ্জলকে বেশি মারধর করেছেন ছাত্রলীগের সদ্য পদত্যাগ করা উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক জালাল আহমেদসহ একদল শিক্ষার্থী। তিনি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেন।
এদিকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সাদেক আব্দুল্লাহ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং ছাত্র-জনতাকে সকল প্রকার মব জাস্টিস বা মব কিলিং বন্ধ করতে উদাত্ত আহ্বান জানান।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

পৈশাচিক দুই হত্যাকাণ্ড ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে

আপলোড টাইম : ০৮:০৪:২৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই যুবককে পৈশাচিকভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। দুটি হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর সারা দেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। দেশের শীর্ষ দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের এমন অমানবিক আচরণ মেনে নিতে পারছেন না কেউ। দ্রুত অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার দাবি উঠেছে। ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অপরাধীদের বিচারের আশ্বাস দিয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বিচারের কথা বললেও এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।
গত বুধবার বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে এই দুই হত্যাকাণ্ড ঘটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের মাঠে অপরিচিত এক যুবককে দেখে আটক করে কয়েক জন শিক্ষার্থী। তাকে ধরে হলের গেস্ট রুমে নিয়ে যায়। সেখানে এক দফা তাকে পেটানো হয়। এরপর তাকে রাতের খাবার খাইয়ে আরেক দফা নৃশংশভাবে পেটানো হয়। একপর্যায়ে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। ঐ যুবকের নাম তোফাজ্জল হোসেন। তার বাড়ি বরগুনায়। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে একই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে গণপিটুনি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির হাতে তুলে দেয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকদের হেফাজতে থাকা অবস্থায়ও তার ওপর কয়েক দফা হামলা ও নির্যাতন হয়। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিত্সকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ঢাবির ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছে। আর তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে জাবি কর্তৃপক্ষ।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. তালেবুর রহমান বলেন, এটি তদন্তের বিষয়। তদন্তের মাধ্যমে পুরো ঘটনা বেরিয়ে আসবে। পাঁচ শিক্ষার্থীকে ঢাবির প্রক্টরিয়াল বডি আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের আইনের আওতায় আনতে আমাদের ডিবি কাজ করছে। ইতিমধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। আশাকরি দ্রুতই রহস্য উন্মোচন হবে।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাবুদ্দিন শাহীন পাঁচ জনকে আটক করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন। আটক শিক্ষার্থীরা হলেন হল ছাত্রলীগের সাবেক উপবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক ও পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের জালাল আহমেদ; মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের মোহাম্মদ সুমন; পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মোত্তাকিন সাকিন, গণিত বিভাগের আহসান উল্লাহ (২৪) এবং ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের আল হোসাইন সাজ্জাদ।

যেভাবে এই হত্যাকাণ্ড :
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গত বুধবার বিকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদকে দেখতে পান কয়েক জন শিক্ষার্থী। পরে তাকে কয়েক দফা পিটিয়ে প্রক্টর অফিসে নেওয়া হয়। সেখানেও কয়েক দফা মারধরের শিকার হন শামীম। পরে তাকে আশুলিয়া থানার পুলিশের হাতে তুলে দিলে গুরুতর আহত অবস্থায় গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিলে রাত ১১টার দিকে তিনি মারা যান। নিহত শামীম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, গত ১৫ জুলাই রাতে উপাচারে‌্যর বাসভবনে অবস্থানরত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শামীম। একইদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেন নামে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত তোফাজ্জলের বাড়ি বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলি ইউনিয়নে। বুধবার সন্ধ্যায় চোর সন্দেহে তোফাজ্জলকে আটকের পর গেস্টরুমে নিয়ে যান শিক্ষার্থীরা। সেখানে তাকে রাত ১০টা পর্যন্ত দফায় দফায় মারধর করে শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে ঐ যুবককে ক্যান্টিনে বসিয়ে ভাতও খাওয়ানো হয়। এরপর পুনরায় মারধর করা হয়। পরে রাত ১২টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যান কয়েক শিক্ষার্থী। সেখানে চিকিৎসক তোফাজ্জলকে মৃত ঘোষণা করলে ঐ শিক্ষার্থীরা মরদেহ রেখেই পালিয়ে ক্যাম্পাসে চলে আসেন বলে কয়েক জন ছাত্র জানিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ক্যাম্পাসের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যাবে না। কেউ চুরি করতে আসলেও তাকে পিটিয়ে হত্যার অধিকার কারো নেই। ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ও ভিডিও দেখে দায়ীদের শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় হলের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হবে।

তোফাজ্জলের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি:

ঢাবিতে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত তোফাজ্জলের পরিবারের কাছে মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন তোফাজ্জলের মামাতো বোন তানিয়া। তিনি জানান, তোফাজ্জলের মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই। রাত ১১টার সময় আমার বাবাকে ফোন দেওয়া হয়েছে। ও প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘আপনি কি তোফাজ্জলের মামা? আমার আব্বা ফোন ধরছে। তখন বলছে, ওরে (তোফাজ্জল) আমরা আটকাইছি, হলেই আছে, ওরে নিতে হলে টাকা দিতে হবে ৩৫ হাজার। ৩৫ হাজার টাকা দিয়ে ওরে ছাড়িয়ে নেন, না হলে আমরা ওরে ছাড়ব না, আরো মারব।’

ঢাবিতে বিক্ষোভ, তদন্ত কমিটি:
মব জাস্টিসের নামে হত্যা বন্ধ এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্করে‌্যর সামনে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ব্যানারসহ সেখানে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। এরই মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল কর্তৃপক্ষ সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. আলমগীরকে। এছাড়া নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের ব্যানারেও প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমেও চলছে তীব্র প্রতিবাদ।

জাহাঙ্গীরনগরে প্রতিবাদ মিছিল:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল বিক্ষোভ মিছিল করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি বের করা হয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দিক প্রদক্ষিণ শেষে রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে গিয়ে মিছিল শেষ করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নানা স্লোগান দেন। পাশাপাশি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুততম সময়ে আইনের আওতায় আনারও দাবি জানান। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম জানান, শামীম মোল্লাকে যখন পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখন সে হেঁটেই গাড়িতে উঠে। তবে কিছুক্ষণ পর পুলিশের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুর বিষয়টি জানানো হয়। তিনি বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের তদন্ত সাপেক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার করা হবে।

ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ:
ক্যাম্পাসে দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়েছে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তারা এই আহ্বান জানান। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব। তিনি বলেন, চোর সন্দেহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের অতিথিকক্ষে আটকে রেখে তোফাজ্জলকে বেশি মারধর করেছেন ছাত্রলীগের সদ্য পদত্যাগ করা উপ-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক জালাল আহমেদসহ একদল শিক্ষার্থী। তিনি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেন।
এদিকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সাদেক আব্দুল্লাহ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন এবং ছাত্র-জনতাকে সকল প্রকার মব জাস্টিস বা মব কিলিং বন্ধ করতে উদাত্ত আহ্বান জানান।