ইপেপার । আজ সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নেতা-কর্মীরা দিশাহারা, রাজনীতি ছাড়তে চান অনেকে

বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের হাল ধরবে কে?

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৭:৪১:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ৯ বার পড়া হয়েছে

দেশে গত ২৩ জুন ঘটা করে দলের ৭৫ বছর পূর্তি পালন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেদিন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সমাবেশে নেতা-কর্মীর উপস্থিতি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। অথচ মাত্র ২ মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। শীর্ষ নেতারাও অনেকে দেশ ছেড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেউ কেউ ‘দেশ ছাড়ার চেষ্টাকালে’ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর বাইরে নেতাদের মধ্যে এখনও যারা দেশে অবস্থান করছেন, তাদের প্রায় সবাই ‘আত্মগোপন’ করেছেন। এমন অবস্থায় গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে চরম নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দিয়েছে। এতে সাংগঠনিকভাবে দলটি রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। তাদের অনেকেই এখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কথা বলার সময় কেউ নামও প্রকাশ করতে চাননি।
আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, আমাদের দলের এখন দিশাহারা বিপর্যস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। ১ মাস হয়ে গেলো অথচ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নেতা-কর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন।
একজন আওয়ামী লীগ কর্মী বলেন, আওয়ামী লীগের এখনকার যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সেটার জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের দায়ী করছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। ক্ষমতা হারালে এমন অবস্থা যে হতে পারে, সেটা তো নেতাদের অজানা থাকার কথা না। তারাই তো এর জন্য দায়ী। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এলাকা ছেড়ে ১ মাস আগে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ক্রিম খাইলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানাইলো তারা; আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হইতেছে আমাদের মতো তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের।
গত ৫ আগস্টের পর গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বেশ সক্রিয় অবস্থান দেখা গেলেও এখন আর সেটি চোখে পড়ছে না। অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথ অভিযান শুরু করার পর তারা ‘একটু চাপে’ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন। গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেকে রাতে বাড়িতে থাকছেন না বলেও জানা গেছে। তবে পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, আওয়ামী লীগ আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলে জানাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতারা।
দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা, যিনি বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ’৭১ সালে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই দেশ যতদিন থাকবে, আমাদের দলও থাকবে। আমরা আবারও ঘুরে দাঁড়াবো। দল ক্ষমতা হারানোর পর গত ১ মাসে ঢাকাসহ অনেক জেলাতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, লালমনিরহাটসহ বেশ কয়েকটি জেলায় গণপিটুনি ও আগুনে পুড়ে বেশ কয়েকজন প্রাণও হারান। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যারা বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তারা এখনও এলাকায় ফিরতে পারেননি। আওয়ামী লীগের মধ্যমসারির এক নেতা বলেন, ১ মাস হয়ে গেলো আমরা বাড়ি-ঘরে যেতে পারছি না, পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কবে এলাকায় ফিরতে পারব, তাও জানি না।
পেশায় অটোচালক ওই ব্যক্তি জানান, সংসার চালাতে না পেরে তার স্ত্রী প্রায়ই ফোন করে কান্নাকাটি করে। তিনি বলেন, টাকা-পয়সা যা রেখে আসছিলাম সব এই কয়দিনে শেষ হয়ে গেছে। এখন বাজার করার মতো অবস্থাও নেই। ঘরে ছোট ছোট দু’টো ছেলে, তারা কী খাবে? মোবাইল করে আমার বউ ডেইলি কান্নাকাটি করে। এ অবস্থায় সপ্তাহখানেক আগে সন্তানদের নিয়ে তার স্ত্রী বাবার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন ওই আওয়ামী লীগ কর্মী। তিনি বলেন, কিন্তু এভাবে কতদিন থাকবে? ভাবতে গেলেই কান্না আসে। মনে হচ্ছে, রাজনীতি করাই পাপ হয়েছে। তাই আর রাজনীতি করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিছি।
কর্মীদের মধ্যে আরো অনেকেই এমন সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের এক নেতা। দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলার অন্যতম শীর্ষ নেতা বলেন, অনেকেই খুব হতাশ হয়ে পড়েছে। রাজনীতি ছেড়ে দিবে এমন কথাও কয়েকজন আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছে। আমার জায়গা থেকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু পরে কী হবে জানি না।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে একটি গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে শেখ হাসিনা পলায়ন করেছেন। তখন এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছিলেনে, শেখ হাসিনা পালায় না। গত ২৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, শেখ হাসিনা নাই, শেখ হাসিনা চলে গেছে; শেখ হাসিনা পালায় না। অথচ এই ঘটনার ঠিক ১০ দিন পরে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসার পর গত ৫ আগস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান, যা এখনও মানতে পারছেন না দলটির নেতা-কর্মীরা।
আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলার এক নেতা বলেন, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না। আপা পালাইছে, মানতেই কষ্ট হয়। শেখ হাসিনাকে যারা চেনেন, জানেন। যারা কাছ থেকে তাকে দেখেছেন, তারা কেউই এটা মানতে পারবে না। কারণ উনি মোটেও পালিয়ে যাওয়ার মানুষ না। আওয়ামী লীগ সভাপতির দেশ ছেড়ে না গেলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো বলেও জানিয়েছেন তিনি। ঢাকা জেলার ওই নেতা বলেন, আপা দেশে থাকলে নেতা-কর্মীরা মনে বল পেতেন। ফলে দলে অন্তত এখনকার মতো বিপর্যয় দেখতে হতো না।
একই কথা বলেছেন তৃণমূলের আরেক নেতা। তিনি বলেন, ক্ষমতা হারানোর পর খালেদা জিয়া ছাড়েননি, এমনকি এরশাদের মতো স্বৈরাচারও পালায়নি। সেখানে নেত্রী কেন দেশ ছাড়লো, সেটাই আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। বিচারের মুখোমুখি হতে হলেও এখন শেখ হাসিনার দেশে ফেরা উচিৎ বলেও মনে করছেন তারা। ঢাকা জেলার আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, আমি মনে করি, আপার দ্রুত দেশে ফিরে আসা উচিৎ। উনি দেশের মাটিতে পা রাখলেই দেখবেন নেতা-কর্মীরা আবার সব জেগে উঠেছে।
পালিয়ে থাকা অবস্থাতেই একের পর এক মামলায় আসামি হচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই সারা দেশে শতাধিক মামলা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই হত্যা মামলা। ওইসব মামলার আসামির তালিকায় তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকের নাম রয়েছে।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিন পর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় জানিয়েছিলেন যে, তার মার আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমি- আমাদের যথেষ্ট হয়েছে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য তার কণ্ঠে ভিন্ন সুর শোনা যায়। আরেকটি সাক্ষাৎকারে জয় বলেন, অবশ্যই তিনি (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশে ফিরবেন, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় বহু নেতারাও ‘আত্মগোপনে’ রয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেকে। ফলে নেতৃত্বশূন্যতা অনুভব করছেন বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। এমন অবস্থার মধ্যে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বে কারা আসছেন, সেটি নিয়েও নানা আলোচনা শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, এসব সবই অপপ্রচার। কমিটি পরিবর্তনের ওইরকম কোনো সিদ্ধান্তই হয়নি।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

নেতা-কর্মীরা দিশাহারা, রাজনীতি ছাড়তে চান অনেকে

বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের হাল ধরবে কে?

আপলোড টাইম : ০৭:৪১:৪৯ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দেশে গত ২৩ জুন ঘটা করে দলের ৭৫ বছর পূর্তি পালন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেদিন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সমাবেশে নেতা-কর্মীর উপস্থিতি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। অথচ মাত্র ২ মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। গত ৫ আগস্ট গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। শীর্ষ নেতারাও অনেকে দেশ ছেড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেউ কেউ ‘দেশ ছাড়ার চেষ্টাকালে’ গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর বাইরে নেতাদের মধ্যে এখনও যারা দেশে অবস্থান করছেন, তাদের প্রায় সবাই ‘আত্মগোপন’ করেছেন। এমন অবস্থায় গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে চরম নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দিয়েছে। এতে সাংগঠনিকভাবে দলটি রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতারা। তাদের অনেকেই এখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কথা বলার সময় কেউ নামও প্রকাশ করতে চাননি।
আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একজন নেতা বলেন, আমাদের দলের এখন দিশাহারা বিপর্যস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। ১ মাস হয়ে গেলো অথচ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতা-কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নেতা-কর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবছেন।
একজন আওয়ামী লীগ কর্মী বলেন, আওয়ামী লীগের এখনকার যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, সেটার জন্য দলের সিনিয়র নেতাদের দায়ী করছেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। ক্ষমতা হারালে এমন অবস্থা যে হতে পারে, সেটা তো নেতাদের অজানা থাকার কথা না। তারাই তো এর জন্য দায়ী। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এলাকা ছেড়ে ১ মাস আগে ঢাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। ক্রিম খাইলো নেতারা, কোটি কোটি টাকা বানাইলো তারা; আর তাদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হইতেছে আমাদের মতো তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের।
গত ৫ আগস্টের পর গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বেশ সক্রিয় অবস্থান দেখা গেলেও এখন আর সেটি চোখে পড়ছে না। অস্ত্র উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যৌথ অভিযান শুরু করার পর তারা ‘একটু চাপে’ রয়েছেন বলে জানিয়েছেন। গ্রেপ্তার আতঙ্কে অনেকে রাতে বাড়িতে থাকছেন না বলেও জানা গেছে। তবে পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, আওয়ামী লীগ আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলে জানাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতারা।
দলের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা, যিনি বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ’৭১ সালে এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজেই দেশ যতদিন থাকবে, আমাদের দলও থাকবে। আমরা আবারও ঘুরে দাঁড়াবো। দল ক্ষমতা হারানোর পর গত ১ মাসে ঢাকাসহ অনেক জেলাতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, লালমনিরহাটসহ বেশ কয়েকটি জেলায় গণপিটুনি ও আগুনে পুড়ে বেশ কয়েকজন প্রাণও হারান। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যারা বাড়িঘর ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তারা এখনও এলাকায় ফিরতে পারেননি। আওয়ামী লীগের মধ্যমসারির এক নেতা বলেন, ১ মাস হয়ে গেলো আমরা বাড়ি-ঘরে যেতে পারছি না, পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কবে এলাকায় ফিরতে পারব, তাও জানি না।
পেশায় অটোচালক ওই ব্যক্তি জানান, সংসার চালাতে না পেরে তার স্ত্রী প্রায়ই ফোন করে কান্নাকাটি করে। তিনি বলেন, টাকা-পয়সা যা রেখে আসছিলাম সব এই কয়দিনে শেষ হয়ে গেছে। এখন বাজার করার মতো অবস্থাও নেই। ঘরে ছোট ছোট দু’টো ছেলে, তারা কী খাবে? মোবাইল করে আমার বউ ডেইলি কান্নাকাটি করে। এ অবস্থায় সপ্তাহখানেক আগে সন্তানদের নিয়ে তার স্ত্রী বাবার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন ওই আওয়ামী লীগ কর্মী। তিনি বলেন, কিন্তু এভাবে কতদিন থাকবে? ভাবতে গেলেই কান্না আসে। মনে হচ্ছে, রাজনীতি করাই পাপ হয়েছে। তাই আর রাজনীতি করবো না বলে সিদ্ধান্ত নিছি।
কর্মীদের মধ্যে আরো অনেকেই এমন সিদ্ধান্তের দিকে এগোচ্ছেন বলে জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের এক নেতা। দক্ষিণবঙ্গের একটি জেলার অন্যতম শীর্ষ নেতা বলেন, অনেকেই খুব হতাশ হয়ে পড়েছে। রাজনীতি ছেড়ে দিবে এমন কথাও কয়েকজন আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেছে। আমার জায়গা থেকে আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু পরে কী হবে জানি না।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার বেশ কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে একটি গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে শেখ হাসিনা পলায়ন করেছেন। তখন এর প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেছিলেনে, শেখ হাসিনা পালায় না। গত ২৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে, শেখ হাসিনা নাই, শেখ হাসিনা চলে গেছে; শেখ হাসিনা পালায় না। অথচ এই ঘটনার ঠিক ১০ দিন পরে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসার পর গত ৫ আগস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগ সভাপতি হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান, যা এখনও মানতে পারছেন না দলটির নেতা-কর্মীরা।
আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলার এক নেতা বলেন, আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না। আপা পালাইছে, মানতেই কষ্ট হয়। শেখ হাসিনাকে যারা চেনেন, জানেন। যারা কাছ থেকে তাকে দেখেছেন, তারা কেউই এটা মানতে পারবে না। কারণ উনি মোটেও পালিয়ে যাওয়ার মানুষ না। আওয়ামী লীগ সভাপতির দেশ ছেড়ে না গেলে পরিস্থিতি অন্যরকম হতো বলেও জানিয়েছেন তিনি। ঢাকা জেলার ওই নেতা বলেন, আপা দেশে থাকলে নেতা-কর্মীরা মনে বল পেতেন। ফলে দলে অন্তত এখনকার মতো বিপর্যয় দেখতে হতো না।
একই কথা বলেছেন তৃণমূলের আরেক নেতা। তিনি বলেন, ক্ষমতা হারানোর পর খালেদা জিয়া ছাড়েননি, এমনকি এরশাদের মতো স্বৈরাচারও পালায়নি। সেখানে নেত্রী কেন দেশ ছাড়লো, সেটাই আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। বিচারের মুখোমুখি হতে হলেও এখন শেখ হাসিনার দেশে ফেরা উচিৎ বলেও মনে করছেন তারা। ঢাকা জেলার আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, আমি মনে করি, আপার দ্রুত দেশে ফিরে আসা উচিৎ। উনি দেশের মাটিতে পা রাখলেই দেখবেন নেতা-কর্মীরা আবার সব জেগে উঠেছে।
পালিয়ে থাকা অবস্থাতেই একের পর এক মামলায় আসামি হচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই সারা দেশে শতাধিক মামলা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই হত্যা মামলা। ওইসব মামলার আসামির তালিকায় তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অনেকের নাম রয়েছে।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার কিছুদিন পর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় জানিয়েছিলেন যে, তার মার আর রাজনীতিতে ফিরবেন না। বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমি- আমাদের যথেষ্ট হয়েছে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য তার কণ্ঠে ভিন্ন সুর শোনা যায়। আরেকটি সাক্ষাৎকারে জয় বলেন, অবশ্যই তিনি (শেখ হাসিনা) বাংলাদেশে ফিরবেন, যখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় বহু নেতারাও ‘আত্মগোপনে’ রয়েছেন। গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেকে। ফলে নেতৃত্বশূন্যতা অনুভব করছেন বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। এমন অবস্থার মধ্যে সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, শিগগিরই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে নতুন নেতৃত্বে কারা আসছেন, সেটি নিয়েও নানা আলোচনা শোনা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, এসব সবই অপপ্রচার। কমিটি পরিবর্তনের ওইরকম কোনো সিদ্ধান্তই হয়নি।