রেমিটেন্সের পালে হাওয়া
আগস্টে রেমিটেন্স এসেছে ২৫ হাজার কোটি টাকা, দূর হবে ডলার সংকট- আপলোড টাইম : ০২:৫৯:০৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ অগাস্ট ২০২৪
- / ২০ বার পড়া হয়েছে
চলতি আগস্ট মাসে প্রবাসীরা বৈধ পথে রেকর্ড পরিমাণ ২০৭ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশী মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, রেমিটেন্সের পালে নতুন হাওয়া লেগেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের এই ধারা অব্যাহত থাকলে আশা করা হচ্ছে, শীঘ্রই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বা রিজার্ভ সংকট দূর হবে। বাড়বে ডলারের সরবরাহ এবং গতি ফিরবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে। বিশেষ করে যে কোনা আমদানিতে সহজে ঋণপত্র বা এলসি খোলার সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। শক্তিশালী হবে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের পরই রেমিটেন্সে সুবাতাস বইতে শুরু করে। এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় তাঁদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে জুলাই মাসে প্রবাসীরা রেমিটেন্স না পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়েছিল। ১৯-২৩ জুলাই পর্যন্ত ব্যাংক বন্ধ থাকা অন্যদিকে রেমিটেন্স শাটডাউনের কারণে গত মাসে রেমিটেন্স প্রবাহে যে ভাটা পড়েছিল তা আগস্টে এসে অনেকটাই কেটে গেছে বলে মনে করেন ব্যাংকখাত সংশ্লিষ্টরা। উল্লেখ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটির বেশি প্রবাসী (বাংলাদেশী) কাজ করছেন। প্রবাসীদের কাছ থেকে বছরে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলার রেমিটেন্স আদায় হয়ে থাকে। রেমিটেন্সের এই অর্থে রিজার্ভ বাড়ে এবং শক্তিশালী হয় দেশের অর্থনীতি। কিন্তু বৈশ্বিক সংকটের কারণে গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে রিজার্ভ কমে যাওয়ায় চাপের মুখে রয়েছে দেশের অর্থনীতি।
এ ছাড়া বিগত সময়ে ব্যাংকিং খাতে ব্যাপক লুটপাট, দুর্নীতি এবং ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বজায় না থাকায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। তবে বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের এই সময়ে প্রবাসী এবং দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করেছে। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের পর প্রবাসীদের রেমিটেন্স পাঠানোর পরিমাণ অনেক বেড়েছে। অর্থাৎ তাঁদের আস্থা ফিরে এসেছে। এখন এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে দ্রুত দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট কেটে যাবে বলে মনে করেন তাঁরা। এ জন্য সর্বক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ, খেলাপি ঋণ আদায় এবং বিগত দিনে যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে তাদের আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করারও তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, আগস্টের ২৮ দিনে বৈধ পথে ২০৭ কোটি ১০ লাখ (২.৭ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিটেন্স এসেছে। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২৪ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। রেমিটেন্সের এ অঙ্ক আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৪৫ শতাংশ বেশি এসেছে। গত বছরের (২০২৩) আগস্টে ২৮ দিনে রেমিটেন্স এসেছিল ১৪৩ কোটি ১০ লাখ ডলার। এর আগে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে ১৯১ কোটি ৩৫ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার রেমিটেন্স আসে, যা আগের ১০ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স এসেছিল ১৩৩ কোটি ডলার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাইয়ে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ, আগস্টে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ, সেপ্টেম্বরে ১৩৩ কোটি ৪৩ লাখ, অক্টোবরে ১৯৭ কোটি ১৪ লাখ, নভেম্বরে ১৯৩ কোটি, ডিসেম্বরে ১৯৯ কোটি ১২ লাখ, জানুয়ারিতে ২১১ কোটি ৩১ লাখ, ফেব্রুয়ারিতে ২১৬ কোটি ৪৫ লাখ, মার্চে ১৯৯ কোটি ৭০ লাখ, এপ্রিলে ২০৪ কোটি ৪২ লাখ, মে মাসে ২২৫ কোটি ৩৮ লাখ এবং জুন মাসে এসেছিল ২৫৪ কোটি ১৬ লাখ মার্কিন ডলার রেমিটেন্স। এদিকে রেমিটেন্স বাড়ায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আগস্ট মাসের রিজার্ভের এ তথ্য প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস বা মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫৬৫ কোটি মার্কিন ডলার (২৫.৬৫ বিলিয়ন)। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ এখন দুই হাজার ৬০ কোটি ডলার (২০.৬০ বিলিয়ন)।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে দ্রুত স্বাভাবিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে বাজেট এবং ঋণ সহায়তা চাচ্ছে অন্তর্র্বতী সরকার। সম্প্রতি অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে বাজেট সহায়তা চেয়েছেন। একইভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর আইএমএফের কাছে তিন বিলিয়ন ডলার চাইবেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঋণের জন্য ইতোমধ্যে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘ঋণ নিয়ে আলোচনার জন্য আইএমএফের স্টাফ মিশন আগামী মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ সফর করতে পারে। তখন বাড়তি ঋণ চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আইএমএফের কাছে চিঠি দেওয়া হবে। এ ছাড়া আাইএমএফ কর্মকর্তারা অর্থ মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়েছেন, বিদ্যমান কোটার বাইরে গিয়ে তারা বাংলাদেশকে কত টাকা ঋণ দিতে পারে তা মূল্যায়ন করছে।
অন্যদিকে, ব্যাংকিং খাতের জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বাজেট সহায়তার জন্য এটি উন্নয়নে সহযোগীদের দীর্ঘদিনের পরামর্শ রয়েছে বলে মনে করা হয়। এদিকে রেমিটেন্সের গতি বাড়লেও ডলার সংকট পুরোপুরি দূর হতে আরও সময় লাগবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ জন্য ডলারের সর্বোচ্চ দর ১২০ টাকা বেঁধে দিয়েছেন ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি প্রধানরা। এর আগে ক্রলিংপেগ পদ্ধতিতে ১১৭ টাকা ডলারের রেট নির্ধারণ করে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দেশের অধিকাংশ ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখন থেকে কোনো ব্যাংক ডলার কেনাবেচায় ১২০ টাকার বেশি চার্জ করতে পারবে না। ট্রেজারি প্রধানরা সম্প্রতি আলোচনার মাধ্যমে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তারা ঘোষণা করেছেন, ব্যাংকগুলো রেমিটেন্স ডলারের জন্য সর্বোচ্চ ১২০ টাকা উদ্ধৃত করবে এবং এ হার আন্তঃব্যাংক ও আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। রপ্তানি আয় নগদায়নের জন্য ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুসরণ করবে।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, ক্রলিংপেগ এক্সচেঞ্জ রেট মেকানিজম অনুসারে ১১৭ টাকার মধ্যবর্তী দরের সঙ্গে ২ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যান্ড যোগ করে ব্যাংকগুলো ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে। সেই অনুযায়ী ডলার লেনদেনের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো প্রতি ডলারে ১২০ টাকা পর্যন্ত চার্জ করতে পারে।