ইপেপার । আজ শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ আজ, বঙ্গভবনে নজর

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:২০:৫০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ অগাস্ট ২০২৪
  • / ৩৫ বার পড়া হয়েছে

অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরা শপথ নেবেন আজ বৃহস্পতিবার। বঙ্গভবনের দরবার হলে রাত ৮টায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শপথ পাঠ করাবেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে তিনি এই মুহূর্তে দেশে নেই, ফিরবেন আজ দুপুরে। ফিরেই তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের সঙ্গেও আলোচনা করবেন। এরপর শপথ নেয়ার জন্য বঙ্গভবনে যাবেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শপথের পর তার পরিষদের উপদেষ্টাদের শপথ অনুষ্ঠিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে ১৭ থেকে ২০ জনের মতো সদস্য থাকতে পারেন। শপথের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে উপদেষ্টাদের দপ্তর বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ২৫টি নতুন গাড়ি প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের কাছে ২৫টি গাড়ি ও ড্রাইভার চাওয়া হয়েছে। ২৫টি পতাকাও সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এছাড়া গাড়িচালকদের নাম ও নম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে পরিবহন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর গতকাল বলেন, (আজ) বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের চিঠি পেয়েছি। নতুন সরকারের উপদেষ্টাদের জন্য ২৫টি গাড়ি প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। পরিবহন পুল থেকে বরাদ্দ দেয়া গাড়িগুলো সকালেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
গতকাল বুধবার বিকেলে সেনাসদরে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) রাত ৮টায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হতে পারে। এর আগে তিনি বিদেশ থেকে আসবেন। আমি তাকে বিমানবন্দরে রিসিভ করব। এক প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, আগামীকাল শপথ অনুষ্ঠানের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। একটা প্রস্তাব ছিল বিকেলে করার। সেটা অত্যন্ত টাইট শিডিউল হয়ে যায়। কারণ, ড. মুহাম্মদ ইউনুস ২টা ১০ মিনিটের দিকে দেশে আসবেন। এর পরপর আয়োজন করা কঠিন। এ জন্য রাত ৮টার দিকে আয়োজন করতে পারি। মোট ৪০০ জন লোকের আয়োজন থাকবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আকার কেমন হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ধারণা আপাতত ১৫ জনের মতো হতে পারে। তারপরও দুই-একজন যোগ হতে পারে। তিনি আরও জানান, ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সব ধরনের সহায়তা করবে সশস্ত্র বাহিনী। গতকাল (মঙ্গলবার) রাতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এদিকে ডয়চেভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, অন্তর্ভুক্তি সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজ কোনটি তা আমি জানি না। তবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কাজ করে এটুকু বুঝতে পারি, তিনি অত্যন্ত গুছিয়ে কাজ করেন। তার কাজের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। যেহেতু তিনি সারাবিশ্বে সম্মানিত একজন মানুষ। তার ওপর আমাদের অনেক আত্মবিশ্বাস আছে। দেশ পরিচালনার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হবে। তারপরও নতুন অভিজ্ঞতা বলতে পারেন না। কারণ তিনি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ছিলেন। তিনি বলেন, সবার প্রত্যাশা হচ্ছে সংস্কার। বাংলাদেশের মানুষ যে নির্মম শাসন প্রত্যক্ষ করেছে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানকে, পুলিশকে, দুদককে, আদালতকে, যেভাবে জিম্মি করা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ সেসব থেকে মুক্তি চায়। মিথ্যা এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে বছরের পর বছর যে সম্পদ লুট করা হয়েছে, বিদেশে পাচার করা হয়েছে, মানুষকে গুম করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে- এগুলোর অবসান চায়।
অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশকে যদি ভালোবাসেন, তাহলে এখানে বিরোধের জায়গা নেই। এখানে কী কী সংস্কার হবে- সে বিষয় নিয়ে অনেকেই ভাবতে পারেন, এটা খুব কঠিন একটা কাজ। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, সংস্কারের চিন্তা আমরা বহু আগে থেকে করেছি। ১৯৯১ সালে তিন দলের সংস্কারের রূপরেখা আছে। এরপর বিভিন্ন সময় নাগরিক সংগঠনের মাধ্যমে সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। তারপর সর্বশেষ ১-১১ সরকারের সময় কিছু কমিশন হয়েছিল। সেগুলোতো আমাদের সামনে আছে পথপ্রদর্শক হিসেবে। এই সরকারের মেয়াদ কতদিনের হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। সেনাপ্রধানের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। সেনাপ্রধান যেসব সংস্কারের কথা বলেছেন আমাদের নাগরিক সমাজ তা বহু আগে থেকেই বলেছেন। এছাড়াও ছাত্রদের যে আন্দোলন হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অংশগ্রহণ আছে। এখন তাদের একটা চাওয়া থাকবে, আমরা যদি ভোট পাই, তাহলে ক্ষমতায় আসব।
আবার সংস্কারকামী মানুষের প্রত্যাশা থাকবে, কিছু সংস্কার করে দেয়া হোক। আমরা তো আওয়ামী লীগের বদলে আরেকটা অপশাসন চাই না। দুটার মধ্যে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় যে সংস্কারটা করা দরকার, সেটা করে হয়ত অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেয়া হবে। এছাড়া ড. ইউনূসের সামাজিক কাজ আছে। তিনি চাইবেন না, দেরি করতে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার আগে সংস্কার কাজগুলো করতে হবে। সরকার গঠনের প্রক্রিয়া দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, অধ্যাপক ড. ইউনূসের একটি সার্জারি হয়েছিল। যার কারণে বাংলাদেশে আসতে দেরি হয়েছে। আজ দুপুর আড়াইটার দিকে বাংলাদেশে আসবেন। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে বসতে পারেন। এরপর তিনি শপথ নিতে পারেন। সবাইকে একটু ধৈর্য ধরার বার্তা দিয়ে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশ পথ হারাবে না। সরকারে কারা কারা থাকবেন তা জানেন না জানিয়ে তিনি বলেন, তরুণ সমাজের ইচ্ছা ও প্রত্যাশাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। আমাদের সমন্বয়করা আছেন, তাদের কথাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। তারাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছে। এই তরুণরাই ড. ইউনূসকে রাজি করিয়েছে। এই সরকারে যারা আসবে, তাদের পছন্দ হবে। শুধু জনপ্রিয় লোক নয়, দক্ষ লোকদেরও রাখা হচ্ছে। আপনারা হতাশ হবেন না।
এদিকে গতকাল বুধবার ইউনূস সেন্টার থেকে পাঠানো এক বার্তায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পাশাপাশি সব ধরনের সহিংসতা এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আমি সাহসী ছাত্রদের অভিনন্দন জানাই, যারা আমাদের দ্বিতীয় বিজয় দিবসকে বাস্তবে রূপ দিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং অভিনন্দন জানাই দেশের আপামর জনসাধারণকে যারা ছাত্রদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। আসুন আমরা আমাদের এই নতুন বিজয়ের সর্বোত্তম সদ্ব্যব্যবহার নিশ্চিত করি। তিনি বলেন, আমাদের কোনো প্রকার ভুলের কারণে এই বিজয় যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়। আমি বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাত্র ও দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে শান্ত থাকতে এবং সব ধরনের সহিংসতা এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছি।
এই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের প্রিয় এই সুন্দর ও বিপুল সম্ভাবনাপূর্ণ দেশটিকে আমাদের নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা এবং একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন আমাদের প্রধান কাজ। একটি নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে আমাদের তরুণরা প্রস্তুত। অকারণে সহিংসতা করে এই সুযোগটি আমরা হারাতে পারি না। তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সহিংসতা আমাদের সবারই শত্রু। অনুগ্রহ করে শত্রু সৃষ্টি করবেন না। সবাই শান্ত থাকুন এবং দেশ পুনর্গঠনে এগিয়ে আসুন। অনুগ্রহ করে নিজে শান্ত থাকুন এবং আপনার আশপাশের সবাইকে শান্ত থাকতে সহায়তা করুন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন নিজ পদে বহাল থাকলেও তিনি নির্বাহী বিভাগের প্রধান নন বলে নির্বাহী বিভাগ বর্তমানে নেতৃত্বহীন। ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এরই মধ্যে ‘অন্তর্বর্তী সরকারে’র রূপরেখা নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ও জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের।
বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল তথা একটি সরকার দায়িত্বভার ছেড়ে দেয়ার পর আরেকটি সরকার নির্বাচনের জন্য ১৯৯০ সালে প্রবর্তন করা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে গঠন করা হলেও এটি অনির্বাচিত একটি সরকার, যাদের প্রধান কাজ যত দ্রুত সম্ভব নতুন একটি সরকার নির্বাচিত করার জন্য নির্বাচন পরিচালনা করা। পাশাপাশি নীতি নির্ধারণী কার্যক্রম থেকে বিরত থেকে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করাও এই সরকারের কাজ। দেশের ইতিহাসে চারটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছয়টি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যত্যয়ের ঘটনাও ঘটেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব থাকলেও ২০০৬ সাল পরবর্তী সময়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দুই বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করতেও দেখা গেছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। সেই বিধান অনুযায়ী ১৯৯০ সালের পর ১৯৯৬ সাল, ২০০১ সাল ও ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল। পরে ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট এক সংক্ষিপ্ত রায়ে শর্তসাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। পরে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের যে রায় দিয়েছিলেন, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে শান্তিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলেও পর্যবেক্ষণে জানান। এর ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার বিষয়ে সংসদের অনুমতির শর্ত জুড়ে দেন।
বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, ওই সময় কোনো ধরনের রাজনৈতিক মতৈক্য ছাড়াই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। এবারে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদ পূর্ণ করে দায়িত্ব পালনের পর চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের সাত মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, সরকারের কোনো রূপরেখাও দিয়ে যেতে পারেনি শেখ হাসিনা। তবে যে ছাত্র আন্দোলনের জের ধরে সরকার পদত্যাগ করেছে, তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও জনগণের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে তাদেরই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বলা হলেও এটি কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার কারণেই সম্ভবত একে অন্তর্বর্তী সরকার বলা হচ্ছে। তবে প্রকৃতিগত দিক থেকে এ দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সবার মতামতের ভিত্তিতে এ রকম একটি সরকার গঠনেরও কোনো বিকল্প নেই। তবে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে পারেন। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজন করলে সেই নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হবে, তারা সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম ভূতাপেক্ষভাবে বৈধতা দিতে পারে। ১৯৯০ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও একইভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়েছিল।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ আজ, বঙ্গভবনে নজর

আপলোড টাইম : ০৯:২০:৫০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ অগাস্ট ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরা শপথ নেবেন আজ বৃহস্পতিবার। বঙ্গভবনের দরবার হলে রাত ৮টায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শপথ পাঠ করাবেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে তিনি এই মুহূর্তে দেশে নেই, ফিরবেন আজ দুপুরে। ফিরেই তিনি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের সঙ্গেও আলোচনা করবেন। এরপর শপথ নেয়ার জন্য বঙ্গভবনে যাবেন তিনি। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শপথের পর তার পরিষদের উপদেষ্টাদের শপথ অনুষ্ঠিত হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে ১৭ থেকে ২০ জনের মতো সদস্য থাকতে পারেন। শপথের পর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে উপদেষ্টাদের দপ্তর বণ্টন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে। এর আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে ২৫টি নতুন গাড়ি প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের কাছে ২৫টি গাড়ি ও ড্রাইভার চাওয়া হয়েছে। ২৫টি পতাকাও সরবরাহের জন্য কার্যাদেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এছাড়া গাড়িচালকদের নাম ও নম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে।
জানতে চাইলে পরিবহন কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মো. আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর গতকাল বলেন, (আজ) বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের চিঠি পেয়েছি। নতুন সরকারের উপদেষ্টাদের জন্য ২৫টি গাড়ি প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। পরিবহন পুল থেকে বরাদ্দ দেয়া গাড়িগুলো সকালেই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
গতকাল বুধবার বিকেলে সেনাসদরে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) রাত ৮টায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হতে পারে। এর আগে তিনি বিদেশ থেকে আসবেন। আমি তাকে বিমানবন্দরে রিসিভ করব। এক প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেন, আগামীকাল শপথ অনুষ্ঠানের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। একটা প্রস্তাব ছিল বিকেলে করার। সেটা অত্যন্ত টাইট শিডিউল হয়ে যায়। কারণ, ড. মুহাম্মদ ইউনুস ২টা ১০ মিনিটের দিকে দেশে আসবেন। এর পরপর আয়োজন করা কঠিন। এ জন্য রাত ৮টার দিকে আয়োজন করতে পারি। মোট ৪০০ জন লোকের আয়োজন থাকবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আকার কেমন হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ধারণা আপাতত ১৫ জনের মতো হতে পারে। তারপরও দুই-একজন যোগ হতে পারে। তিনি আরও জানান, ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সব ধরনের সহায়তা করবে সশস্ত্র বাহিনী। গতকাল (মঙ্গলবার) রাতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধান ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এদিকে ডয়চেভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, অন্তর্ভুক্তি সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক কাজ কোনটি তা আমি জানি না। তবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে কাজ করে এটুকু বুঝতে পারি, তিনি অত্যন্ত গুছিয়ে কাজ করেন। তার কাজের ক্ষেত্রে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্যায়ে দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। যেহেতু তিনি সারাবিশ্বে সম্মানিত একজন মানুষ। তার ওপর আমাদের অনেক আত্মবিশ্বাস আছে। দেশ পরিচালনার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা হবে। তারপরও নতুন অভিজ্ঞতা বলতে পারেন না। কারণ তিনি একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ছিলেন। তিনি বলেন, সবার প্রত্যাশা হচ্ছে সংস্কার। বাংলাদেশের মানুষ যে নির্মম শাসন প্রত্যক্ষ করেছে, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানকে, পুলিশকে, দুদককে, আদালতকে, যেভাবে জিম্মি করা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ সেসব থেকে মুক্তি চায়। মিথ্যা এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে, প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে বছরের পর বছর যে সম্পদ লুট করা হয়েছে, বিদেশে পাচার করা হয়েছে, মানুষকে গুম করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে- এগুলোর অবসান চায়।
অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশকে যদি ভালোবাসেন, তাহলে এখানে বিরোধের জায়গা নেই। এখানে কী কী সংস্কার হবে- সে বিষয় নিয়ে অনেকেই ভাবতে পারেন, এটা খুব কঠিন একটা কাজ। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, সংস্কারের চিন্তা আমরা বহু আগে থেকে করেছি। ১৯৯১ সালে তিন দলের সংস্কারের রূপরেখা আছে। এরপর বিভিন্ন সময় নাগরিক সংগঠনের মাধ্যমে সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। তারপর সর্বশেষ ১-১১ সরকারের সময় কিছু কমিশন হয়েছিল। সেগুলোতো আমাদের সামনে আছে পথপ্রদর্শক হিসেবে। এই সরকারের মেয়াদ কতদিনের হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই সরকারের মেয়াদ নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। সেনাপ্রধানের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। সেনাপ্রধান যেসব সংস্কারের কথা বলেছেন আমাদের নাগরিক সমাজ তা বহু আগে থেকেই বলেছেন। এছাড়াও ছাত্রদের যে আন্দোলন হয়েছে, তাতে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের অংশগ্রহণ আছে। এখন তাদের একটা চাওয়া থাকবে, আমরা যদি ভোট পাই, তাহলে ক্ষমতায় আসব।
আবার সংস্কারকামী মানুষের প্রত্যাশা থাকবে, কিছু সংস্কার করে দেয়া হোক। আমরা তো আওয়ামী লীগের বদলে আরেকটা অপশাসন চাই না। দুটার মধ্যে সমন্বয় করে প্রয়োজনীয় যে সংস্কারটা করা দরকার, সেটা করে হয়ত অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেয়া হবে। এছাড়া ড. ইউনূসের সামাজিক কাজ আছে। তিনি চাইবেন না, দেরি করতে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেয়ার আগে সংস্কার কাজগুলো করতে হবে। সরকার গঠনের প্রক্রিয়া দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, অধ্যাপক ড. ইউনূসের একটি সার্জারি হয়েছিল। যার কারণে বাংলাদেশে আসতে দেরি হয়েছে। আজ দুপুর আড়াইটার দিকে বাংলাদেশে আসবেন। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে বসতে পারেন। এরপর তিনি শপথ নিতে পারেন। সবাইকে একটু ধৈর্য ধরার বার্তা দিয়ে অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশ পথ হারাবে না। সরকারে কারা কারা থাকবেন তা জানেন না জানিয়ে তিনি বলেন, তরুণ সমাজের ইচ্ছা ও প্রত্যাশাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। আমাদের সমন্বয়করা আছেন, তাদের কথাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। তারাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছে। এই তরুণরাই ড. ইউনূসকে রাজি করিয়েছে। এই সরকারে যারা আসবে, তাদের পছন্দ হবে। শুধু জনপ্রিয় লোক নয়, দক্ষ লোকদেরও রাখা হচ্ছে। আপনারা হতাশ হবেন না।
এদিকে গতকাল বুধবার ইউনূস সেন্টার থেকে পাঠানো এক বার্তায় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশবাসীকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। পাশাপাশি সব ধরনের সহিংসতা এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের জন্য অভিনন্দন জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, আমি সাহসী ছাত্রদের অভিনন্দন জানাই, যারা আমাদের দ্বিতীয় বিজয় দিবসকে বাস্তবে রূপ দিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং অভিনন্দন জানাই দেশের আপামর জনসাধারণকে যারা ছাত্রদের এই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন। আসুন আমরা আমাদের এই নতুন বিজয়ের সর্বোত্তম সদ্ব্যব্যবহার নিশ্চিত করি। তিনি বলেন, আমাদের কোনো প্রকার ভুলের কারণে এই বিজয় যেন হাতছাড়া হয়ে না যায়। আমি বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাত্র ও দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে শান্ত থাকতে এবং সব ধরনের সহিংসতা এবং স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ বিনষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে আহ্বান জানাচ্ছি।
এই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের প্রিয় এই সুন্দর ও বিপুল সম্ভাবনাপূর্ণ দেশটিকে আমাদের নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা এবং একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন আমাদের প্রধান কাজ। একটি নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে আমাদের তরুণরা প্রস্তুত। অকারণে সহিংসতা করে এই সুযোগটি আমরা হারাতে পারি না। তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, সহিংসতা আমাদের সবারই শত্রু। অনুগ্রহ করে শত্রু সৃষ্টি করবেন না। সবাই শান্ত থাকুন এবং দেশ পুনর্গঠনে এগিয়ে আসুন। অনুগ্রহ করে নিজে শান্ত থাকুন এবং আপনার আশপাশের সবাইকে শান্ত থাকতে সহায়তা করুন।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ছাত্র আন্দোলনের পথ ধরে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে শেখ হাসিনা সরকার। সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন নিজ পদে বহাল থাকলেও তিনি নির্বাহী বিভাগের প্রধান নন বলে নির্বাহী বিভাগ বর্তমানে নেতৃত্বহীন। ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এরই মধ্যে ‘অন্তর্বর্তী সরকারে’র রূপরেখা নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আলোচনা করেছেন। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ও জানিয়েছে, শিক্ষার্থীদের প্রস্তাবনা অনুযায়ী নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করা হবে অন্তর্বর্তী সরকারের।
বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রক্ষমতার পালাবদল তথা একটি সরকার দায়িত্বভার ছেড়ে দেয়ার পর আরেকটি সরকার নির্বাচনের জন্য ১৯৯০ সালে প্রবর্তন করা হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে গঠন করা হলেও এটি অনির্বাচিত একটি সরকার, যাদের প্রধান কাজ যত দ্রুত সম্ভব নতুন একটি সরকার নির্বাচিত করার জন্য নির্বাচন পরিচালনা করা। পাশাপাশি নীতি নির্ধারণী কার্যক্রম থেকে বিরত থেকে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করাও এই সরকারের কাজ। দেশের ইতিহাসে চারটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছয়টি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ব্যত্যয়ের ঘটনাও ঘটেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব থাকলেও ২০০৬ সাল পরবর্তী সময়ে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দুই বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করতেও দেখা গেছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। সেই বিধান অনুযায়ী ১৯৯০ সালের পর ১৯৯৬ সাল, ২০০১ সাল ও ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল। পরে ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট এক সংক্ষিপ্ত রায়ে শর্তসাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন। পরে ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে এই ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের যে রায় দিয়েছিলেন, তাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করেছিলেন। তবে শান্তিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করা যেতে পারে বলেও পর্যবেক্ষণে জানান। এর ১৬ মাস পর পূর্ণাঙ্গ রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার বিষয়ে সংসদের অনুমতির শর্ত জুড়ে দেন।
বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, ওই সময় কোনো ধরনের রাজনৈতিক মতৈক্য ছাড়াই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছিল। এবারে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদ পূর্ণ করে দায়িত্ব পালনের পর চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের সাত মাসের মাথায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, সরকারের কোনো রূপরেখাও দিয়ে যেতে পারেনি শেখ হাসিনা। তবে যে ছাত্র আন্দোলনের জের ধরে সরকার পদত্যাগ করেছে, তারাই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও জনগণের উদ্দেশে দেয়া ভাষণে জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে তাদেরই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার বলা হলেও এটি কার্যত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই। সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ার কারণেই সম্ভবত একে অন্তর্বর্তী সরকার বলা হচ্ছে। তবে প্রকৃতিগত দিক থেকে এ দুইয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সবার মতামতের ভিত্তিতে এ রকম একটি সরকার গঠনেরও কোনো বিকল্প নেই। তবে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আইনি বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে পারেন। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজন করলে সেই নির্বাচনে যে সরকার গঠিত হবে, তারা সংসদে বিল পাসের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম ভূতাপেক্ষভাবে বৈধতা দিতে পারে। ১৯৯০ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও একইভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়েছিল।