ইপেপার । আজ বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

বেঘোরে মৃত্যুর কারণ প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার; বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত গুরুত্বপূর্ণ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:৫২:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ অগাস্ট ২০২৪
  • / ৭০ বার পড়া হয়েছে

কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ দমনে বাংলাদেশে সরকারি বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে দেশে-বিদেশে ঘোরতর প্রশ্ন উঠেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি বাহিনীকে এই ধরনের অস্ত্র প্রয়োগ করতে দেখা গেছে। নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে এ তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। আন্দোলন দমনে সরকারি বাহিনীর বেপরোয়া বলপ্রয়োগ আগেও ছিল। এবার বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপক ব্যবহার হওয়ায় সারা বিশ্বের সামনে তা উন্মোচিত হলো। মৃত্যুর কারণগুলো যখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট তখন পুলিশের মামলা ও তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে একে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। প্রাণহানির তদন্ত ও বিচারকাজকে এ নীতি ব্যাঘাত ঘটাবে। বাংলাদেশকে একটি বিকশিত গণতান্ত্রিক যাত্রায় সামনে চলতে হলে ছাত্র হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও নিরপেক্ষ বিচার হতে হবে।

একটি দৈনিকের হিসাবে গতকাল পর্যন্ত ২১২ জনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে প্রাপ্ত নথি, নিহতদের আঘাতের ধরন ও আত্মীয়স্বজনের সাথে আলোচনা করে তাদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করেছে ওই পত্রিকাটি। তাতে দেখা যায়, বেশির ভাগের শরীরে একটি করে গুলির ক্ষত রয়েছে। কারো ক্ষেত্রে গুলির দু’টি ক্ষত রয়েছে। বিক্ষোভে যেমন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তেমনি নিহত ব্যক্তিদের কেউ কেউ নিজের বাসায়, বারান্দায় ও ছাদে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ১৭৫ জনের মৃত্যু বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৩৭ জনের শরীরে প্রাণঘাতী গুলি ও ২২ জনের শরীরে ছররা গুলির চিহ্ন ছিল। ১০ জনের শরীরে ছিল মারধর ও আঘাতের চিহ্ন। চারজনের মৃত্যু হয়েছে গাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনায় দেয়া আগুনে পুড়ে। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দু’জনের।
আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সবাই একই ধরনের কথা বলছেন। রাস্তার বিক্ষোভ দমনে একটি স্বীকৃত নিয়ম রয়েছে। সাধারণত গরম পানি, ঠাণ্ডা পানি, রঙিন পানি ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। এ ধরনের ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়। তাদের জন্য সর্বশেষ অস্ত্র হচ্ছে বন্দুকের গুলি বা শটগান। তবে এর পাল্লা স্বল্প থাকায় দূরের মানুষের ওপর প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে না। লক্ষণীয়, ছাত্র বিক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা হয়েছে দূরপাল্লার রাইফেল। টার্গেট করে এর প্রয়োগ হওয়ায় বহু দূরের মানুষও প্রাণ হারিয়েছেন। বেশ দূরে থাকা বিক্ষোভকারী, ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বাসাবাড়িতে থাকা কিংবা ছাদে থাকা মানুষ বেঘোরে এতে প্রাণ হারিয়েছেন।

তবে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ভিন্ন বয়ান দেয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পত্রিকাটি পুলিশের দায়ের করা ৬৪ মামলার ৩৪টির তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছে, সবক’টিতে প্রায় একই বক্তব্য দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত আবু সাঈদ হত্যার প্রাথমিক তদন্তে এ ধরনের মিথ্যাচার দেখা গেছে। যদিও পুলিশের গুলিতে তিনি মারা গেছেন, তা বিশ্ববাসী জেনেছেন।
বিক্ষোভ দমনের স্বীকৃত নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সামান্য ধৈর্যের পরিচয়ও দেননি। পুলিশকে সহযোগিতা করতে এসে রাষ্ট্রীয় অন্যান্য বাহিনীও একই ধরনের নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে। দাবি আদায়ে সংগঠিত হওয়া ছাত্র-জনতার ওপর দেশীয় বাহিনী কেন শত্রুর মতো আচরণ করবে? এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। এজন্য একটি অবাধ নিরপেক্ষ বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত দরকার। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ধরনের তদন্তে যুক্ত হতে চায়। সরকার দায়মুক্ত হতে একটি সুষ্ঠু তদন্তের পথ সুগম করবে, এটি সবার চাওয়া।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

বেঘোরে মৃত্যুর কারণ প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার; বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত গুরুত্বপূর্ণ

আপলোড টাইম : ০৮:৫২:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২ অগাস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ দমনে বাংলাদেশে সরকারি বাহিনীর প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে দেশে-বিদেশে ঘোরতর প্রশ্ন উঠেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে সরকারি বাহিনীকে এই ধরনের অস্ত্র প্রয়োগ করতে দেখা গেছে। নিহত ব্যক্তিদের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে এ তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। আন্দোলন দমনে সরকারি বাহিনীর বেপরোয়া বলপ্রয়োগ আগেও ছিল। এবার বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপক ব্যবহার হওয়ায় সারা বিশ্বের সামনে তা উন্মোচিত হলো। মৃত্যুর কারণগুলো যখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট তখন পুলিশের মামলা ও তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে একে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। প্রাণহানির তদন্ত ও বিচারকাজকে এ নীতি ব্যাঘাত ঘটাবে। বাংলাদেশকে একটি বিকশিত গণতান্ত্রিক যাত্রায় সামনে চলতে হলে ছাত্র হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও নিরপেক্ষ বিচার হতে হবে।

একটি দৈনিকের হিসাবে গতকাল পর্যন্ত ২১২ জনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে প্রাপ্ত নথি, নিহতদের আঘাতের ধরন ও আত্মীয়স্বজনের সাথে আলোচনা করে তাদের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করেছে ওই পত্রিকাটি। তাতে দেখা যায়, বেশির ভাগের শরীরে একটি করে গুলির ক্ষত রয়েছে। কারো ক্ষেত্রে গুলির দু’টি ক্ষত রয়েছে। বিক্ষোভে যেমন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তেমনি নিহত ব্যক্তিদের কেউ কেউ নিজের বাসায়, বারান্দায় ও ছাদে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ১৭৫ জনের মৃত্যু বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৩৭ জনের শরীরে প্রাণঘাতী গুলি ও ২২ জনের শরীরে ছররা গুলির চিহ্ন ছিল। ১০ জনের শরীরে ছিল মারধর ও আঘাতের চিহ্ন। চারজনের মৃত্যু হয়েছে গাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনায় দেয়া আগুনে পুড়ে। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দু’জনের।
আন্দোলন দমনে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সবাই একই ধরনের কথা বলছেন। রাস্তার বিক্ষোভ দমনে একটি স্বীকৃত নিয়ম রয়েছে। সাধারণত গরম পানি, ঠাণ্ডা পানি, রঙিন পানি ব্যবহার করে তাদের ছত্রভঙ্গ করা হয়। এ ধরনের ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ ও রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়। তাদের জন্য সর্বশেষ অস্ত্র হচ্ছে বন্দুকের গুলি বা শটগান। তবে এর পাল্লা স্বল্প থাকায় দূরের মানুষের ওপর প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে না। লক্ষণীয়, ছাত্র বিক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা হয়েছে দূরপাল্লার রাইফেল। টার্গেট করে এর প্রয়োগ হওয়ায় বহু দূরের মানুষও প্রাণ হারিয়েছেন। বেশ দূরে থাকা বিক্ষোভকারী, ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বাসাবাড়িতে থাকা কিংবা ছাদে থাকা মানুষ বেঘোরে এতে প্রাণ হারিয়েছেন।

তবে পুলিশের দায়ের করা মামলায় ভিন্ন বয়ান দেয়া হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, সন্ত্রাসী বা দুষ্কৃতকারীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পত্রিকাটি পুলিশের দায়ের করা ৬৪ মামলার ৩৪টির তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছে, সবক’টিতে প্রায় একই বক্তব্য দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত আবু সাঈদ হত্যার প্রাথমিক তদন্তে এ ধরনের মিথ্যাচার দেখা গেছে। যদিও পুলিশের গুলিতে তিনি মারা গেছেন, তা বিশ্ববাসী জেনেছেন।
বিক্ষোভ দমনের স্বীকৃত নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সামান্য ধৈর্যের পরিচয়ও দেননি। পুলিশকে সহযোগিতা করতে এসে রাষ্ট্রীয় অন্যান্য বাহিনীও একই ধরনের নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে। দাবি আদায়ে সংগঠিত হওয়া ছাত্র-জনতার ওপর দেশীয় বাহিনী কেন শত্রুর মতো আচরণ করবে? এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।
সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। এজন্য একটি অবাধ নিরপেক্ষ বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত দরকার। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ ধরনের তদন্তে যুক্ত হতে চায়। সরকার দায়মুক্ত হতে একটি সুষ্ঠু তদন্তের পথ সুগম করবে, এটি সবার চাওয়া।