ইপেপার । আজ শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

ঢাকায় গুলিতে নিহত সাব্বির ও প্রকৌশলী রাকিবের মায়ের কান্না যেন থামছেই না

ঝিনাইদহে দুই পরিবারের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার

আসিফ কাজল, ঝিনাইদহ:
  • আপলোড টাইম : ০৯:৫২:০৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ জুলাই ২০২৪
  • / ৭৯ বার পড়া হয়েছে

সাব্বির হোসেন (২৩) ও প্রকৌশলী রাকিবুল হাসানের (২৯) মায়ের কান্না যেন থামছেই না। ছেলে হারানোর শোকে তাঁদের চোখে নিদ্রা নেই। প্রতিটা রাত যেন দুই পরিবারের কাছে অবসানহীন অপেক্ষার প্রতিচ্ছবি। সারাক্ষণ তাঁরা নিহত ছেলেদের স্মৃতি নিয়ে আহাজারি করছেন। পেশায় দুজনই বেসরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। কোটা আন্দোলনের সময় ঢাকায় পৃথক স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তারা। এরমধ্যে শৈলকুপা উপজেলার মীর্জাপুর গ্রামের আমোদ আলীর ছেলে সাব্বির হোসেন গত ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় ওষুধ কিনতে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরদিন ১৯ জুলাই সাব্বিরের লাশ সকাল ১০টার দিকে মীর্জাপুর গ্রামে দাফন করা হয়।
সাব্বিরের চাচাতো ভাই তরিকুল জানান, উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে অর্গান লিমিটেড কেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন সাব্বির। ঘটনার সময় তিনি ওষুধ কিনতে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তিনি আরও জানান, সংসারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ২৩ বছরের যুবক সাব্বিরকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ তাদের পরিবার। একমাত্র বোন সুমাইয়া খাতুন জানান, তার ভাই তো কোনো দল করতেন না। তিনি চাকরি করে তাদের সংসার চালাতেন। তাহলে কেন এই নিরীহ ছেলেটিকে মারা হলো? এখন কে তাদের সংসার চালাবে? কার কাছে বিচার চাইবেন তারা?
মা রাশিদা খাতুন জানান, সাব্বিরের পিতা এখন কাজ করতে পারে না। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সাব্বির সংসারের হাল ধরেছিলেন। সাব্বিরের মৃত্যুতে গোটা পরিবার এখন অহসায়। তিনি সন্তান হত্যার বিচার চান।
পিতা আমোদ আলী বলেন, তাঁর ছেলে কোনো রাজনীতি করতেন না। বাঁচার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন চাকরি করতে। সেখানেও সাব্বির কোনো মিছিল-মিটিংয়ে যায়নি। জ্বর হওয়ায় অসুস্থ শরীরে ওষুধ কিনতে বাইরে যান। তিনি তো আন্দোলনে ছিলেন না। তাকে কেন গুলি করে মারা হলো?
এদিকে, ঝিনাইদহ শহরের চাকলাপাড়ার সাবেক বিমান বাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার আবু বকর সিদ্দিকীর ছেলে প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান গত ১৯ জুলাই শুক্রবার রাতে গুলিতে নিহত হন। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর সেক্টর এলাকায় পথচারী এক নারীকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। মিরপুর-৬ এলাকায় ডা. আজমল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রাকিব লন্ডন ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি টাইগার রিস্ক ম্যানেজমেন্টে চাকরি করতেন।
গতকাল শনিবার ঝিনাইদহ শহরের চাকলাপাড়ায় প্রকৌশলী রাকিবুল হাসানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সুনশান নীরবতা। রাকিবুলের ব্যবহারিক জিনিসপত্র নিয়ে ক্যানসার আক্রান্ত মা হাফিজা খাতুন কান্না করছেন। পিতা আবু বকর বিমান বাহিনীর সাবেক মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার আবু বকর সিদ্দিক বাকরুদ্ধ। বড় ভাইয়ের ছেলে ছোট্ট শিশু রাফসান ‘ছোট বাবা’ ‘ছোট বাবা’ বলে সারা ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছেন চাচাকে। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে রাকিবের সঙ্গে ছোট্ট ভাজিতা রাফসানেরও কথা হয়েছিল।
নিহত হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে প্রকৌশলী রাকিবুল হাসানের সঙ্গে কথা হয় মা হাফিজার। বলেছিলেন তিনি একটি গ্যারেজের মধ্যে বসে আছেন। রাত সাড়ে ৯টার মধ্যে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তার ছেলে চিরঘুমে শায়িত হন।
গত শুক্রবার এশার নামাজ পড়ে ফোন দেন পিতা আবু বকর। কিন্তু ফোন বাজলেও আর কেউ ধরেনি। রাত ১১টার দিকে ছেলের ফোন থেকে কেউ একজন মৃত্যুর খবর জানান। ভোর রাতে রাকিবের বন্ধু ফয়সাল ও পিয়াস লাশ ঝিনাইদহ শহরের পৌঁছে দেন। মা হাফিজা বেগম জানান, তার ছোট ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। মা-বাবাকে কাছে রাখার জন্য ঢাকায় বড় ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।
প্রতিবেশী তাছলিম উদ্দীন জানান, নিহত রাকিব এলাকায় খুবই ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত। তিনি জীবনে কোনো সংগঠন করেছেন কি না, তা মহল্লাবাসীর জানা নেই। একটি ভদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে সবাই রাকিবকে চিনতেন। রাকিবের মৃত্যুতে শহরের চাকলাপাড়া ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলার বাসিদেবপুর গ্রামের মানুষ শোকে স্তদ্ধ হয়ে আছেন। মৃত্যুর ৮ দিন পরও সরকারিভাবে পরিবারটির কেউ খোঁজ নেয়নি বলে জানান রাকিবের পিতা আবু বকর।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

ঢাকায় গুলিতে নিহত সাব্বির ও প্রকৌশলী রাকিবের মায়ের কান্না যেন থামছেই না

ঝিনাইদহে দুই পরিবারের স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার

আপলোড টাইম : ০৯:৫২:০৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ জুলাই ২০২৪

সাব্বির হোসেন (২৩) ও প্রকৌশলী রাকিবুল হাসানের (২৯) মায়ের কান্না যেন থামছেই না। ছেলে হারানোর শোকে তাঁদের চোখে নিদ্রা নেই। প্রতিটা রাত যেন দুই পরিবারের কাছে অবসানহীন অপেক্ষার প্রতিচ্ছবি। সারাক্ষণ তাঁরা নিহত ছেলেদের স্মৃতি নিয়ে আহাজারি করছেন। পেশায় দুজনই বেসরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। কোটা আন্দোলনের সময় ঢাকায় পৃথক স্থানে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন তারা। এরমধ্যে শৈলকুপা উপজেলার মীর্জাপুর গ্রামের আমোদ আলীর ছেলে সাব্বির হোসেন গত ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় ওষুধ কিনতে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরদিন ১৯ জুলাই সাব্বিরের লাশ সকাল ১০টার দিকে মীর্জাপুর গ্রামে দাফন করা হয়।
সাব্বিরের চাচাতো ভাই তরিকুল জানান, উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে অর্গান লিমিটেড কেয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন সাব্বির। ঘটনার সময় তিনি ওষুধ কিনতে বের হয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তিনি আরও জানান, সংসারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ২৩ বছরের যুবক সাব্বিরকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ তাদের পরিবার। একমাত্র বোন সুমাইয়া খাতুন জানান, তার ভাই তো কোনো দল করতেন না। তিনি চাকরি করে তাদের সংসার চালাতেন। তাহলে কেন এই নিরীহ ছেলেটিকে মারা হলো? এখন কে তাদের সংসার চালাবে? কার কাছে বিচার চাইবেন তারা?
মা রাশিদা খাতুন জানান, সাব্বিরের পিতা এখন কাজ করতে পারে না। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সাব্বির সংসারের হাল ধরেছিলেন। সাব্বিরের মৃত্যুতে গোটা পরিবার এখন অহসায়। তিনি সন্তান হত্যার বিচার চান।
পিতা আমোদ আলী বলেন, তাঁর ছেলে কোনো রাজনীতি করতেন না। বাঁচার জন্য ঢাকায় গিয়েছিলেন চাকরি করতে। সেখানেও সাব্বির কোনো মিছিল-মিটিংয়ে যায়নি। জ্বর হওয়ায় অসুস্থ শরীরে ওষুধ কিনতে বাইরে যান। তিনি তো আন্দোলনে ছিলেন না। তাকে কেন গুলি করে মারা হলো?
এদিকে, ঝিনাইদহ শহরের চাকলাপাড়ার সাবেক বিমান বাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার আবু বকর সিদ্দিকীর ছেলে প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান গত ১৯ জুলাই শুক্রবার রাতে গুলিতে নিহত হন। ঘটনার দিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে মিরপুর ১০ নম্বর সেক্টর এলাকায় পথচারী এক নারীকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। মিরপুর-৬ এলাকায় ডা. আজমল হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। রাকিব লন্ডন ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি টাইগার রিস্ক ম্যানেজমেন্টে চাকরি করতেন।
গতকাল শনিবার ঝিনাইদহ শহরের চাকলাপাড়ায় প্রকৌশলী রাকিবুল হাসানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সুনশান নীরবতা। রাকিবুলের ব্যবহারিক জিনিসপত্র নিয়ে ক্যানসার আক্রান্ত মা হাফিজা খাতুন কান্না করছেন। পিতা আবু বকর বিমান বাহিনীর সাবেক মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার আবু বকর সিদ্দিক বাকরুদ্ধ। বড় ভাইয়ের ছেলে ছোট্ট শিশু রাফসান ‘ছোট বাবা’ ‘ছোট বাবা’ বলে সারা ঘর খুঁজে বেড়াচ্ছেন চাচাকে। মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে রাকিবের সঙ্গে ছোট্ট ভাজিতা রাফসানেরও কথা হয়েছিল।
নিহত হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে প্রকৌশলী রাকিবুল হাসানের সঙ্গে কথা হয় মা হাফিজার। বলেছিলেন তিনি একটি গ্যারেজের মধ্যে বসে আছেন। রাত সাড়ে ৯টার মধ্যে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই তার ছেলে চিরঘুমে শায়িত হন।
গত শুক্রবার এশার নামাজ পড়ে ফোন দেন পিতা আবু বকর। কিন্তু ফোন বাজলেও আর কেউ ধরেনি। রাত ১১টার দিকে ছেলের ফোন থেকে কেউ একজন মৃত্যুর খবর জানান। ভোর রাতে রাকিবের বন্ধু ফয়সাল ও পিয়াস লাশ ঝিনাইদহ শহরের পৌঁছে দেন। মা হাফিজা বেগম জানান, তার ছোট ছেলেকে নিয়ে কত স্বপ্ন ছিল। মা-বাবাকে কাছে রাখার জন্য ঢাকায় বড় ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে।
প্রতিবেশী তাছলিম উদ্দীন জানান, নিহত রাকিব এলাকায় খুবই ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত। তিনি জীবনে কোনো সংগঠন করেছেন কি না, তা মহল্লাবাসীর জানা নেই। একটি ভদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবে সবাই রাকিবকে চিনতেন। রাকিবের মৃত্যুতে শহরের চাকলাপাড়া ও হরিণাকুণ্ডু উপজেলার বাসিদেবপুর গ্রামের মানুষ শোকে স্তদ্ধ হয়ে আছেন। মৃত্যুর ৮ দিন পরও সরকারিভাবে পরিবারটির কেউ খোঁজ নেয়নি বলে জানান রাকিবের পিতা আবু বকর।