‘কোটাব্যবস্থা বাতিল’ দাবিতে উত্তাল শিক্ষাঙ্গন
৩০ জুন শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম- আপলোড টাইম : ০৮:২৫:১৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১০ জুন ২০২৪
- / ৮৮ বার পড়া হয়েছে
২০১৮ সালের ১২ এপ্রিল জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিতে ‘কোটা ব্যবস্থা বাতিল’ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘আমি বলে দিয়েছি কোটা থাকবে না। ‘সেই থাকবে না’ কীভাবে কার্যকর করা যায়, সে জন্য ক্যাবিনেট সেক্রেটারিকে দিয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে, যাতে এটা বাস্তবায়ন করা যায়।’ ওই বছরের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিয়েগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি সংশোধন করে। আদালতের এক রায়ের পর ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বিক্ষোভ করছেন। তারা ৩০ জুন পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এ সময়ের মধ্যে ‘কোটা পদ্ধতি বাতিল’ কার্যকর না হলে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলছেন, সংসদে প্রধানমন্ত্রীর ‘কোটা পদ্ধতি বাতিল’ ঘোষণা এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনের পর ফের কেন কোটা পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে? কেনই বা বিষয়টি ফের আদালতে উঠলো?
দেশের প্রশাসনে মেধাবী ও যোগ্য লোকের খুবই অভাব। মেধাহীন এবং দলদাসে ভরে গেছে প্রশাসন। অথচ বাংলাদেশের মেধাবীরা বিদেশে গিয়ে সাফল্য দেখাচ্ছেন। কোটা পদ্ধতি চালু রাখার কারণে দেশের প্রশাসনে মেধাবীরা সরকারি চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্ছিত হচ্ছেন। পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ (বিসিএস) সরকারের বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতির কারণে মেধাবী ও যোগ্য ছেলে-মেয়েরা সুযোগ পাচ্ছেন না। অথচ কম মেধাবী এবং ক্লাসের পিছনের সারির ছেলে-মেয়েরা নিয়োগ পরীক্ষায় অনেক কম নম্বর পেয়েও মুক্তিযোদ্ধার কোঠায় তারা সরকারি চাকরি পাচ্ছেন। এতে একদিকে রাষ্ট্রের প্রশাসনে মেধাহীন লোকজন চাকরি পাওয়ায় সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হচ্ছে; যারা খেসারত দিতে হচ্ছে নাগরিককে। অন্যদিকে মেধাবীরা দেশে প্রত্যাশিত চাকরি না পেয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন এবং বিদেশে মেধার স্বাক্ষর রেখে কাজ করছেন।
সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রায়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক প্রফেসর ড. আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন যৌক্তিক। হাইকোর্ট কোনো বিষয়ে রায় দিলেই সে বিষয়টা ন্যায়সঙ্গত হবে এমন মনে করার কারণ নেই। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বের আদালতের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের চেয়ে জাতীয় সংসদ অনেক বেশি পাওয়ারফুল। সেখানেই আইন প্রণয়ন করা হয় এবং আদালতে তা বাস্তবায়ন করা হয়। সুতরাং এই বিষয়টা জাতীয় সংসদে সমাধান হওয়া উচিত।
হাইকোর্টের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের রায়ের প্রতিবাদে ফের উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। গতকাল ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার সরকারি ৭ কলেজ ও বরিশাল বিএম কলেজ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়ে কলাভবন, মলচত্বর, ভিসি চত্বর, টিএসসি হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে সন্ত্রাসবিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশ করে। এসময় শিক্ষার্থীরা ‘সংবিধানের/মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে’, ‘আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’, ‘লেগেছে রে লেগেছে, রক্তে আগুন লেগেছে’, ‘ কোটা প্রথা, বাতিল চাই বাতিল চাই’, ‘কোটা প্রথার বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’ ইত্যাদি সেøাগান দেন। শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ ৫৬ শতাংশ কোটা পুনর্বহালের আদেশ আগামী ৩০ জুনের মধ্যে বাতিল না করলে লাগাতার আন্দোলন ও প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। একই হুংকার দিয়েছে চট্টগ্রাম ও বরিশালে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঈদের পর একই দাবিতে আন্দোলনে নামার ঘোষণা দিয়েছেন।
গতকাল রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এক বিক্ষোভ মিছিল থেকে শিক্ষার্থীরা আগামী ৩০ জুনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার আল্টিমেটাম দেন। সমাবেশ শেষে শিক্ষার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল হাইকোর্টে গিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বরাবর একটি স্মারকলিপি প্রদান করেন। অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুপস্থিতিতে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। আল্টিমেটাম ঘোষণা করে আন্দোলনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী মাহিন সরকার বলেন, কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা প্রয়োজনে রক্ত ঝরার মাধ্যমে শেষ হবে। তবুও এই বৈষম্যমূলক কোটা বাতিলের দাবি শিক্ষার্থীসমাজ আদায় করে ছাড়বে। আমরা আগামী ৩০ জুনের মধ্যে এই কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত বাতিলের আলটিমেটাম জানাই। যদি ৩০ তারিখের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত বাতিল না করা হয় তাহলে আমরা লাগাতার দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো। দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক একটি দূর্গ হিসেবে গড়ে আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের “আঠারোর হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার, মেধা না কোটা? মেধা, মেধা, সংবিধানের মূলকথা, সুযোগের সমতা, মুক্তিযুদ্ধের মূল কথা সুযোগের সমতা, সারা বাংলায় খবর দে, কোটা প্রথার কবর দে, কোটা প্রথা নিপাত যাক, কোটা প্রথা নিপাত যাক” ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, এই দেশে দীর্ঘদিন ধরে কোটা নামক একটা বৈষম্য চলে আসছিল। যেই বৈষম্য, যেই প্রহসন এদেশের লাখ লাখ ছাত্র সমাজের জন্য হয়ে উঠেছিল এক অভিশাপ। ২০১৮ সালে আমার ভাইয়েরা রক্ত দিয়ে সেই বৈষম্য থেকে ছাত্র সমাজকে মুক্তি দিয়েছিল। আমাদের ভাইয়েরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে যেই অধিকার আদায় করেছিল ৬ বছর পর ২০২৪ সালে এসে হাইকোর্ট তার কলমের খোঁচায় আবার সেই বৈষম্যকে পুনবার্সন করতে চাচ্ছে। আমি ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে বলতে চাই, এদেশের ছাত্র সমাজ এই বৈষম্যমূলক রায় কোনদিনও মেনে নেবে না। অবিলম্বে হাইকোর্টের এ রায় প্রত্যাহার করতে হবে। নাহলে ছাত্রসমাজ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবে। ছাত্র জনতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজপথে মাটি আঁকড়ে থাকবো। আমি রাষ্ট্রকে আহ্বান জানাবো অবিলম্বে আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে ছাত্র সমাজকে মুক্তি দেওয়া হোক, মেধাবীদের মুক্তি দেওয়া হোক।
সমাবেশে ঢাবি শিক্ষার্থী তামান্না আকতার বলেন, বাংলাদেশে কোনো কোটা থাকা উচিত নয়। আমি নারী হয়ে বলছি, আমি কোনো নারী কোটা চাই না। আমরা মেধার মাধ্যমে আমাদের দেশকে পরিচালনা করতে চাই। আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে বলতে চাই, মেধাবীদের হাতে দেশটাকে ছেড়ে দিন। আমরা মেধার মাধ্যমে আমাদের দেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আমাদের সেই সুযোগটা দিন। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ফাহিম বলেন, ২০১৮ সালে আমরা কোটার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে জয়ী হয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কোটা সংসদে বাতিল করেছিলেন। কিন্তু হাইকোর্টের দেওয়া এই সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের স্বপ্নকে ভেঙে দিয়েছে। মেধার ভিত্তিতে দেশ গড়ার স্বপ্নকে ধুলিষ্যাৎ করেছে। সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার ভঙ্গ করেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে সাম্য গড়েছিলো তা ভেঙে দিয়েছে।
ঢাবির বায়োকেমিস্টি বিভাগের শিক্ষার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমরা হাইকোর্টকে সম্মান করি, কিন্তু যে রায় আমাদের ছাত্র সমাজের বিরুদ্ধে যায় সে রায়কে আমরা গ্রহণ করতে পারি না। একই সাথে আমরা বলতে চাই, যে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন যে, কোটা প্রথা চালু থাকা জরুরি, সেই শিক্ষামন্ত্রী আমাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষামন্ত্রী নয়, তিনি ওই দুই শতাংশ শিক্ষার্থীদের শিক্ষামন্ত্রী। আমরা বলতে চাই, আমরা তাকে ওই দুই শতাংশ শিক্ষার্থীদের জন্য মন্ত্রী বানায়নি। মুক্তিযুদ্ধের যে মূল কথা, সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সমতা, এই কোটাপ্রথা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সেই মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক। এই কোটা প্রথা মেধাভিত্তিক সমাজ গঠনের অন্যতম প্রতিবন্ধক।
উচ্চ আদালতের কোটা পুনর্বহালের রায়কে সংবিধান পরিপন্থী বলে মন্তব্য করেছেন ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ কাওছার হুসাইন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সংবিধানের ২৯ এর ‘ক’ নং অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভে সকল নাগরিকের সুযোগের সমতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আদালতের এ রায় একটি অসম সমাজ গঠনের বার্তা দেয়। একই অনুচ্ছেদে দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা বলা হলেও মুক্তিযোদ্ধারা কোনোভাবেই অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর অংশে পড়ে না। কাওছার বলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে চাই সরকারি প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ লাভের সমতা। সকল সরকারি চাকরিতে পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগকার্য সম্পন্ন হলে মেধাবী, যোগ্য ও দক্ষরা দেশের সেবা করার সুযোগ পাবে এবং এদেশকে সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।