জাবি ক্যাম্পাসে ডেকে স্বামীকে হলে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণ
অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাসহ আটক ৪, জড়িতদের বিচারের দাবিতে উত্তাল ক্যাম্পাস, বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা ও ক্ষোভ
- আপলোড টাইম : ১০:৫৪:৩৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ৪৪ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ প্রতিবেদন:
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বহিরাগত এক দম্পতিকে কৌশলে ক্যাম্পাসে ডেকে এনে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে পাশের জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে এক ছাত্রলীগ নেতা ও তার এক সহযোগীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী নারীর স্বামী বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধনী/০৩) এর ৯(৩) ধারায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। মামলার পর ধর্ষণে প্রধান অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাসহ চার জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবিতে দিনভর মানববন্ধন, মশাল মিছিল ও উত্তাল বিক্ষোভ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
জানা গেছে, গত শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলসংলগ্ন জঙ্গলে ধর্ষণের এই ঘটনা ঘটে। গতকাল রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় আশুলিয়া থানায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অবস) আব্দুল্লাহিল কাফি এসব বিষয় নিশ্চিত করেন। মামলার আসামিরা হলেন-ভুক্তভোগীর পূর্ব পরিচিত মো. মামুনুর রশিদ মামুন (৪৫) ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রহমান। এছাড়া হল থেকে অভিযুক্তদের পালাতে সহযোগিতা করেছেন-এমন অভিযোগে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাসানুজ্জামান, একই বিভাগের ৪৬তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো. মুরাদ ও সাগর সিদ্দিকী এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সাব্বির হোসেনকেও আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে, মোস্তাফিজুর রহমান, সাব্বির হাসান সাগর, সাগর সিদ্দিকী ও হাসানুজ্জামানকে গ্রেফতার করেছে আশুলিয়া থানাপুলিশ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। এছাড়া হাসানুজ্জামান ছাড়া অন্যরা ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী ও মীর মশাররফ হোসেন হল কমিটির পদপ্রত্যাশী।
ভুক্তভোগীর ভাষ্য অনুযায়ী, পূর্বপরিচিত হওয়ায় ঐ দম্পতিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেকে আনে মামুন। পরে তার স্বামীকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ‘এ’ ব্লকের ৩১৭ নম্বর কক্ষে আটকে রাখে অভিযুক্তরা। পরে স্বামীর কাছে নেওয়ার কথা বলে পেছনের জঙ্গলে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করা হয়।
ভুক্তভোগী ওই নারী বলেন, ‘মামুন আমাদের বাসায় ভাড়া থাকতেন। পূর্বপরিচিত হওয়ায় তিনি প্রথমে আমার স্বামীকে ডেকে নিয়ে যান। এরপর কিছু জিনিসপত্র নিয়ে যেতে বললে আমি ক্যাম্পাসে যাই। তার সঙ্গে মোস্তাফিজ ছিল। তখন তারা আমার স্বামীকে হলে আটকে রেখে কৌশলে আমাকে হলের পাশের জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। সেখানে তারা আমাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।’
উত্তাল বিক্ষোভ-মানববন্ধন: এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে গতকাল রবিবার বেলা ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন চার শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। পরে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। এ সময় তিন দিনের মধ্যে অছাত্রদের হল থেকে বের করাসহ তিন দফা দাবি জানান শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী বলেন, ‘একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বামীকে হলে জিম্মি করে তার স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে গজব নাজিল হওয়া উচিত, আমাদের সবার ধ্বংস হয়ে যাওয়া উচিত। এই সভ্যতার বিশ্ববিদ্যালয় কোনো দরকার নেই। যতদিন প্রশাসনের মদতে এই ক্যাম্পাসে অছাত্র, অবৈধ ছাত্র অবস্থান করবে, ছাত্রলীগ নামধারী অছাত্ররা নিয়োগবাণিজ্য করবে, চাঁদাবাজি করবে ততদিন এই ক্যাম্পাস থেকে অপরাধ দূর করা সম্ভব নয়।’
এ সময় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সোহেল আহমেদ, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ারুল্লা ভূঁইয়া, বাংলা বিভাগের অধ্যাপক শামীমা সুলতানা, ফার্মেসী বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাফরুহী সাত্তার ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আনিছা পারভীন জলি প্রমুখ।
এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সঙ্গে দেখা করেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তখন দ্রুত সময়ের মধ্যে দাবিগুলো বাস্তবায়নে জন্য উপাচার্যকে আলটিমেটাম দেন তারা। পরে দুপুর ২টায় ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এরপর বিকাল ৪টায় একই দাবিতে মানববন্ধন করেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও তার অনুসারী এবং সাধারণ সম্পাদকের অংশের বিদ্রোহী নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি ও আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ’। এছাড়া ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবি এবং দায়িত্বে অবহেলার কারণে প্রক্টর ও হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগসহ চার দফা দাবিতে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় মশাল মিছিল করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল বলেন, ‘ঘটনা শুনেই আমরা মোস্তাফিজের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছি। এছাড়া আমাদের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ থেকেও স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া দ্রুত সময়ের মধ্যে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই।’
সাভার মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) নয়ন কারকুন বলেন, ‘রবিবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে মূল অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমানকে আটক করা হয়। এর আগে, শনিবার রাতে মোস্তাফিজকে পালাতে সহযোগিতা করায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সহযোগিতায় মীর মশাররফ হল থেকে তিন জনকে আটক করা হয়।’ তিন দিনের রিমান্ড : এদিকে ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ গ্রেফতার চার জনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল পুলিশ আসামিদের আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করলে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাবেয়া বেগম এ রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
একাডেমিক সনদ স্থগিত: অন্যদিকে, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের একাডেমিক সনদ স্থগিত করা হয়েছে। গতকাল বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমের সভাপত্বিতে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেটের এক জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে, মোস্তাফিজুর রহমান ও শাহ পরানের সনদ স্থগিত এবং মো. মুরাদ হোসেন, সাগর সিদ্দিকী, সাব্বির হাসান সাগর ও হাসানুজ্জামানের সনদ স্থগিত ছাড়াও তাদের হল থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়েছে।
বিভিন্ন সংগঠনের নিন্দা, ক্ষোভ : এদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন নারী ও মানবাধিকার সংগঠন গভীর উদ্বেগ, তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। একই সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং নির্যাতনের শিকার নারী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দাবি জানানো হয়। গতকাল রবিবার গণমাধ্যমকে পাঠানো লিখিত বিবৃতিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো পবিত্র স্থানে এ ধরনের অপরাধ কোনোভাবেই কাম্য নয়। অন্যদিকে, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম ও সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু স্বাক্ষরিত এক লিখিত বিবৃতিতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিসহ নির্যাতনের শিকার নারী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। এছাড়া আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক ফারুখ ফয়সল এক বিবৃতিতে বলেন, সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে-এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে যাদের রুখে দাঁড়ানোর কথা সেই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ উঠেছে। এদিকে এই ঘটনায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল সাক্ষরিত এক লিখিত বিবৃতিতে বলা হয়, সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এহেন ধর্ষণের ঘটনায় মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) তীব্র নিন্দা ও গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করছে।