ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪

১লা জানুয়ারি থেকে তীব্র আন্দোলন

উৎকণ্ঠার পারদ সর্বোচ্চ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৮:৪০:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩
  • / ১১৪ বার পড়া হয়েছে

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল/কিছু দূর যেয়ে মর্দ রওনা হইল/লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার/শুমার করিয়া দেখে পঞ্চাশ হাজার’। মধ্যযুগীয় এক কবির সংঘর্ষে ভরা এই কবিতার মতোই চলছে বাংলাদেশ। রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন, আইনের শাসন, উন্নয়ন, অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত মধ্যযুগীয় কবিতার মতোই চলছে। চোখ ধাঁধাঁনো উন্নয়ন অথচ সরকারি হিসেবেই দেশে প্রতিবছর গরীবের সংখ্যা বাড়ছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণায় উঠে এসেছে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় লাখ লাখ পরিবার খাবার কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশ অথচ জনগণ ভোট দিতে পারে না দীর্ঘ দেড় দশক থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন এবং অধিকার রক্ষায় শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে। এসব নীতির মাধ্যমে দেশটি নিষেধাজ্ঞা ও ‘বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা’ দেয়ার আগাম বার্তা দিয়েছে।

দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোয় সাম্ভাব্য ‘বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা’ উদ্বেগ প্রকাশ করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। কিন্তু কোনো কিছুই ধর্তব্যে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বরং যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে চীন-রাশিয়া-ভারতের ওপর ভর করে ২০১৪ সালের ১৫৩ সালে বিনা ভোটে এমপি হওয়া এবং ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটে’ নির্বাচিত হওয়ার মতোই এবার ‘ডামি প্রার্থী’ নির্বাচন করতে যাচ্ছে। এদিকে রাজনৈতিক অবস্থা টলটলায়মান। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি এবং পাতানো নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলনে মাঠে রয়েছে বিএনপি। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলটির সঙ্গে আন্দোলনের জোট গঠন করতে যাচ্ছে সুসংগঠিত দল জামায়াত। এদের সঙ্গে থাকছে ডান-বাম-মধ্যপন্থি আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন (৭ জানুয়ারি ২০২৪) যতই ঘনিয়ে আসছে ততই রাজপথের আন্দোলনের গতি বাড়ছে।

এরই মধ্যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে ‘অসহযোগ আন্দোলন’। এ অবস্থায় পহেলা জানুয়ারি থেকে শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘটসহ ‘অল আউট’ কর্মসূচিতে যাচ্ছে। এতোদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে আন্দোলন ঠেকাতে বিরোধী দলগুলোর নেতাদের গ্রেপ্তার, জুলুম-নির্যাতন করা হলেও এখন সে সুযোগ কমে গেছে। কারণ নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী নির্বাচনী কাজে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ব্যবহৃত হচ্ছেন। নির্বাচনের নিরাপত্তা কার্যক্রম থেকে তুলে এনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা দূরূহ হয়ে যাবে।
বিএনপির বর্জনের মুখে নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র শ্রমনীতির ব্যপারে খুবই কঠোর। রাজনীতিবিদদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তেমন সাড়া না পাওয়ায় এবার ব্যবসা-বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ তৈরি করা হলে বাজারে দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। ব্যবসায়ীরা চাপে পড়লে গার্মেন্টস, শিল্প-কারখানা বন্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যার প্রভাব সরাসরি সাধারণ জনগণের ওপর পড়তে পারে। জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে বলেছেন, ‘দেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। সেটা আসার সম্ভাবনা প্রবল। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি সেটা আরোপ করেই তাহলে জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার হয়ে যাবে। তার ফলে যে অ্যাপারেল বা আমাদের রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টর আছে সেটা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।’

জানতে চাইলে সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আগ বাড়িয়ে কিছু করে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে নির্বাচন ইস্যুতে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এখন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে পাতানো নির্বাচনের পথে হাটছে। এই পাতানো নির্বাচন করলেই মার্কিন স্যাংশন, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসবেই। তখন দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যাবে লাখ লাখ গার্মেন্টসকর্মী বেকার হবে। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যে নির্বাচনটা হতে যাচ্ছে, এটা কোনো নির্বাচনই না। নির্বাচনের যে সংজ্ঞা তার মধ্যেই এটা পড়ে না। নির্বাচনের যে গ্রামার-বিকল্প থেকে বেছে নেয়ার সুযোগ, সেটাও নেই। আওয়ামী লীগ আসন ভাগাভাগি করছে অন্যের কিছু সিট দেয়ার জন্য। নিজেদের অনুগত দলগুলোকে তারা কিছু সিট দিতে চায়। একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গেও তারা সিট ভাগাভাগি করেছে।

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, নদীর তলদেশে ট্যানেল, অসংখ্য ফ্লাইওভার চোখ ধাঁধাঁনো উন্নয়ন দেখা গেলেও অর্থনীতি কার্যত খাদের কিনারে পড়ে গেছে। দীর্ঘ দেড় বছর ধরে ডলার সংকটে আমদানি-রফতানি বিপর্যস্ত। ১৪টি ব্যাংক কার্যক্রম চালানোয় অযোগ্য হয়ে গেছে। ৫টি ইসলামী ধারার ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পথে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ তলানিতে; আইএমএফের ঋণ নিয়েও ডলার সংকটের সুরাহা করতে পারেনি সরকার। ডলার সংকট, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি দাম এবং পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়ে গেছে। অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কমে গেছে এবং গার্মেন্টস শিল্পগুলো অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেছে। এমনি সময় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক অধিকার নীতি ঘোষণা করেছে। ১৬ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমনীতি স্মারকে সই করার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘যারা শ্রমিকদের হুমকি দেয়, ভয় দেখায়, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী বা শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে তাদের আমরা জবাবদিহিতার আওতায় আনব। নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যে শাস্তি, ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো যতো বিষয় রয়েছে তার সবই ব্যবহার করা হবে।’

এ অবস্থায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে নামে। শ্রমিকদের রাজপথের আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশের গুলিতে ৩ জন শ্রমিক নিহত হয়। মালিকদের কথায় সরকার শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন ১২৫০০ টাকা বেতন নির্ধারণ করে এবং গেজেট প্রকাশ করে। কিন্তু শ্রমিকরা সে বেতন প্রত্যাখ্যান করে। তাদের দাবি সরকার যে বেতন ঘোষণা করেছে তা দিয়ে ১৫ দিন চালানো কঠিন। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করে। গতকালও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার ‘নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের পোশাক খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে শ্রমিকদের প্রতিবাদ এবং পরবর্তীতে কারখানা বন্ধসহ যাবতীয় চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে পশ্চিমা অংশীদারদের দ্বারা ‘সম্ভাব্য’ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুর্বিষহ জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। লাখ লাখ গার্মেন্টসকর্মীর জীবন জীবিকার বাস্তবতা বোঝাতে এক গার্মেন্টসকর্মীর দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের গার্মেন্টসকর্মী রুবি রফিক প্রতি রাতে তার ছোট্ট ঘরের ঠান্ডা, শক্ত মেঝেতে জেগে শুয়ে থাকে, তার পরিবার কীভাবে শীতে বাঁচবে এই চিন্তায়। একটি দাতব্য সংস্থা দ্বারা দান করা একটি বড় প্যাচওয়ার্ক কম্বলের নিচে তার পাশে কুঁকড়ে আছে তার ১৩ বছর বয়সী কন্যা মায়া। দুই সন্তানের মা চুপচাপ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে তার সন্তানদের ঘুমিয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। একটি শাল জড়িয়ে, তিনি ঢাকার উপকণ্ঠে, কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে বাজারের দিকে যান এবং পুরুষদের তার কাছে আসার জন্য অপেক্ষা করেন।’

এভাবে ক্ষুধার্ত গার্মেন্টসকর্মী রুবির জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়। বাস্তবে হাজার হাজার গার্মেন্টসকর্মীর অবস্থা ওই রুবির মতোই। কারণ দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে যে বেতন পায় তা নিয়ে কোনোভাবেই দু’বেলা পেটভরে ডাল-ভাত খাওয়া যায় না। রাজধানী ঢাকার আশপাশের সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস এলাকায় দুপুরের দিকে ঘুরলে দেখা যায় হাজার হাজার নারী রুটি কলা খাচ্ছেন। ওটাই তাদের দুপুরের খাবার। অল্পভাড়ায় সেমিপাকা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে থাকেন। বিদেশ থেকে বৈদেশিক মূদ্রা এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ভরাচ্ছেন গায়ের ঘাম ঝড়িয়ে, অথচ দু’বেলা খেতে পারছেন না। যখন পেঁয়াজের কেজি দেড়শ’ টাকা, চালের কেজি ৬৫ থেকে ৮০ টাকা, একটি ডিম ১২ টাকা তখন গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাসিক বেতন সাড়ে ১২ হাজার টাকা।

যুক্তরাষ্ট্রের নুতন শ্রমনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নির্বাচন ঘিরে বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা খাত মার্কিন নীতির কষাঘাতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা আছে, এমন অবস্থায় নতুন এই শ্রমনীতির বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার দরকার আছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও রিজার্ভ সংকটের মধ্যে পুরো বিষয়টি হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের রফতানির ৮০ শতাংশ অর্থ আসে গার্মেন্টস পণ্য রফতানির মাধ্যমে। আর এ পণ্য রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপানে রফতানি হয়। মূলত এসব দেশে গার্মেন্টস পণ্যে শতকরা ৮০ শতাংশ রফতানি হয়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষে ‘ভিসানীতি’ এবং শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন নিশ্চিত করতে ‘শ্রমনীতি’ ঘোষণা করেছে। আবার ২৭ দেশ নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক মূল্যায়ন রিপোর্টে বাংলাদেশকে নেতিবাচক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মিশন থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ওই চিঠি দিয়ে জানানো হয় শ্রম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক কারণে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। গত ১৫ ডিসেম্বর মার্কিন কংগ্রেসের ৮ সদস্যের এএএফএ’র সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী স্টিভেন ল্যামারকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য ক্রয় না করার দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। এসব বিষয় তোয়াক্কা করছেন না ক্ষমতাসীন সরকার। অথচ দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিকদের ঘণ্টায় ১৫ ডলার করে দেয়; তারা যদি সে বেতন ঘন্টায় ৪৫ ডলার দেয় আমরাও দেব।’

বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশের কিছু শর্ত ছিল। শ্রম আইন, বেজা আইনে মার্কিন যে চাওয়া ছিল তা অনেকটাই পূরণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক চাহিদা ও শ্রমিক অধিকার রক্ষা করেই তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রম-আইন ও শ্রম-অধিকারের বিষয়গুলো বেশ কিছু পালন হয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে দিলেও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। মূলত যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যেতে বিএনপিসহ অর্ধশতাধিক দলকে বাইরে রেখেই ডামি প্রার্থী দিয়ে সমঝেতার নির্বাচন করা হচ্ছে। এতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে জিএসপি বাতিল হতে পারে এমন ইংগিত প্রকাশ পেয়েছে। ফলে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন।

যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ‘বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা’ ইস্যুতে গত সাপ্তাহে সংবাদ সম্মেলন করে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পোশাক রপ্তানি করছি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শ্রমিক ইস্যু নিয়ে যেভাবে আমাদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে সেভাবে যেন দেশটি তাদের দেশের ক্রেতাদের বলে পোশাকের ন্যায্য মূল্য দিতে। আমাদের দেশে সর্বনিম্ন মজুরি ইতোমধ্যেই সকল তৈরি পোশাক কারখানায় কার্যকর করা হয়েছে।’ এই বক্তব্যের কয়েকদিন আগে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘বিদেশ (ফ্রান্স) একটি ক্রেতা কোম্পানি জানিয়েছে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য ক্রয় করব না। শুধু তাই নয় জাহাজিকরণের পর পণ্য এলে তা গ্রহণ করলেও মূল্য পরিশোধ করা হবে না।’ এদিকে রাজপথে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, পহেলা জানুয়ারি থেকে নির্বাচন প্রতিহতের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবেন।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

১লা জানুয়ারি থেকে তীব্র আন্দোলন

উৎকণ্ঠার পারদ সর্বোচ্চ

আপলোড টাইম : ০৮:৪০:০০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩

সমীকরণ প্রতিবেদন:
ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল/কিছু দূর যেয়ে মর্দ রওনা হইল/লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার/শুমার করিয়া দেখে পঞ্চাশ হাজার’। মধ্যযুগীয় এক কবির সংঘর্ষে ভরা এই কবিতার মতোই চলছে বাংলাদেশ। রাজনীতি, গণতন্ত্র, নির্বাচন, আইনের শাসন, উন্নয়ন, অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত মধ্যযুগীয় কবিতার মতোই চলছে। চোখ ধাঁধাঁনো উন্নয়ন অথচ সরকারি হিসেবেই দেশে প্রতিবছর গরীবের সংখ্যা বাড়ছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণায় উঠে এসেছে ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় লাখ লাখ পরিবার খাবার কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। গণতান্ত্রিক দেশ অথচ জনগণ ভোট দিতে পারে না দীর্ঘ দেড় দশক থেকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন এবং অধিকার রক্ষায় শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে। এসব নীতির মাধ্যমে দেশটি নিষেধাজ্ঞা ও ‘বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা’ দেয়ার আগাম বার্তা দিয়েছে।

দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলোয় সাম্ভাব্য ‘বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা’ উদ্বেগ প্রকাশ করে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। কিন্তু কোনো কিছুই ধর্তব্যে নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বরং যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে চীন-রাশিয়া-ভারতের ওপর ভর করে ২০১৪ সালের ১৫৩ সালে বিনা ভোটে এমপি হওয়া এবং ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোটে’ নির্বাচিত হওয়ার মতোই এবার ‘ডামি প্রার্থী’ নির্বাচন করতে যাচ্ছে। এদিকে রাজনৈতিক অবস্থা টলটলায়মান। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি এবং পাতানো নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলনে মাঠে রয়েছে বিএনপি। বর্তমানে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দলটির সঙ্গে আন্দোলনের জোট গঠন করতে যাচ্ছে সুসংগঠিত দল জামায়াত। এদের সঙ্গে থাকছে ডান-বাম-মধ্যপন্থি আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন (৭ জানুয়ারি ২০২৪) যতই ঘনিয়ে আসছে ততই রাজপথের আন্দোলনের গতি বাড়ছে।

এরই মধ্যে ঘোষণা দেয়া হয়েছে ‘অসহযোগ আন্দোলন’। এ অবস্থায় পহেলা জানুয়ারি থেকে শ্রমিক সংগঠনগুলো ধর্মঘটসহ ‘অল আউট’ কর্মসূচিতে যাচ্ছে। এতোদিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে আন্দোলন ঠেকাতে বিরোধী দলগুলোর নেতাদের গ্রেপ্তার, জুলুম-নির্যাতন করা হলেও এখন সে সুযোগ কমে গেছে। কারণ নির্বাচন কমিশনের চাহিদা অনুযায়ী নির্বাচনী কাজে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ব্যবহৃত হচ্ছেন। নির্বাচনের নিরাপত্তা কার্যক্রম থেকে তুলে এনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা দূরূহ হয়ে যাবে।
বিএনপির বর্জনের মুখে নির্বাচনের আয়োজন নিয়ে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র শ্রমনীতির ব্যপারে খুবই কঠোর। রাজনীতিবিদদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তেমন সাড়া না পাওয়ায় এবার ব্যবসা-বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ তৈরি করা হলে বাজারে দৃশ্যমান প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে। ব্যবসায়ীরা চাপে পড়লে গার্মেন্টস, শিল্প-কারখানা বন্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যার প্রভাব সরাসরি সাধারণ জনগণের ওপর পড়তে পারে। জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে বলেছেন, ‘দেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পক্ষ থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। সেটা আসার সম্ভাবনা প্রবল। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন যদি সেটা আরোপ করেই তাহলে জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার হয়ে যাবে। তার ফলে যে অ্যাপারেল বা আমাদের রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টর আছে সেটা মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে।’

জানতে চাইলে সাবেক কূটনীতিক সাকিব আলী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আগ বাড়িয়ে কিছু করে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে নির্বাচন ইস্যুতে ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। এখন দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সেটাকে গুরুত্ব না দিয়ে পাতানো নির্বাচনের পথে হাটছে। এই পাতানো নির্বাচন করলেই মার্কিন স্যাংশন, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসবেই। তখন দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যাবে লাখ লাখ গার্মেন্টসকর্মী বেকার হবে। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যে নির্বাচনটা হতে যাচ্ছে, এটা কোনো নির্বাচনই না। নির্বাচনের যে সংজ্ঞা তার মধ্যেই এটা পড়ে না। নির্বাচনের যে গ্রামার-বিকল্প থেকে বেছে নেয়ার সুযোগ, সেটাও নেই। আওয়ামী লীগ আসন ভাগাভাগি করছে অন্যের কিছু সিট দেয়ার জন্য। নিজেদের অনুগত দলগুলোকে তারা কিছু সিট দিতে চায়। একমাত্র বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সঙ্গেও তারা সিট ভাগাভাগি করেছে।

পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, নদীর তলদেশে ট্যানেল, অসংখ্য ফ্লাইওভার চোখ ধাঁধাঁনো উন্নয়ন দেখা গেলেও অর্থনীতি কার্যত খাদের কিনারে পড়ে গেছে। দীর্ঘ দেড় বছর ধরে ডলার সংকটে আমদানি-রফতানি বিপর্যস্ত। ১৪টি ব্যাংক কার্যক্রম চালানোয় অযোগ্য হয়ে গেছে। ৫টি ইসলামী ধারার ব্যাংক বন্ধ হওয়ার পথে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ তলানিতে; আইএমএফের ঋণ নিয়েও ডলার সংকটের সুরাহা করতে পারেনি সরকার। ডলার সংকট, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি দাম এবং পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়ে গেছে। অসংখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কমে গেছে এবং গার্মেন্টস শিল্পগুলো অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেছে। এমনি সময় যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক অধিকার নীতি ঘোষণা করেছে। ১৬ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমনীতি স্মারকে সই করার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ‘যারা শ্রমিকদের হুমকি দেয়, ভয় দেখায়, যারা ইউনিয়ন নেতা, শ্রমিক অধিকার রক্ষাকারী বা শ্রমিক সংগঠনকে আক্রমণ করে তাদের আমরা জবাবদিহিতার আওতায় আনব। নিষেধাজ্ঞা, বাণিজ্যে শাস্তি, ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো যতো বিষয় রয়েছে তার সবই ব্যবহার করা হবে।’

এ অবস্থায় বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে নামে। শ্রমিকদের রাজপথের আন্দোলন ঠেকাতে পুলিশের গুলিতে ৩ জন শ্রমিক নিহত হয়। মালিকদের কথায় সরকার শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন ১২৫০০ টাকা বেতন নির্ধারণ করে এবং গেজেট প্রকাশ করে। কিন্তু শ্রমিকরা সে বেতন প্রত্যাখ্যান করে। তাদের দাবি সরকার যে বেতন ঘোষণা করেছে তা দিয়ে ১৫ দিন চালানো কঠিন। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র নতুন শ্রমনীতি ঘোষণা করে। গতকালও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরার ‘নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের পোশাক খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে শ্রমিকদের প্রতিবাদ এবং পরবর্তীতে কারখানা বন্ধসহ যাবতীয় চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে বাংলাদেশে পশ্চিমা অংশীদারদের দ্বারা ‘সম্ভাব্য’ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা ব্যক্ত করা হয়।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গার্ডিয়ানে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের দুর্বিষহ জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। লাখ লাখ গার্মেন্টসকর্মীর জীবন জীবিকার বাস্তবতা বোঝাতে এক গার্মেন্টসকর্মীর দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের গার্মেন্টসকর্মী রুবি রফিক প্রতি রাতে তার ছোট্ট ঘরের ঠান্ডা, শক্ত মেঝেতে জেগে শুয়ে থাকে, তার পরিবার কীভাবে শীতে বাঁচবে এই চিন্তায়। একটি দাতব্য সংস্থা দ্বারা দান করা একটি বড় প্যাচওয়ার্ক কম্বলের নিচে তার পাশে কুঁকড়ে আছে তার ১৩ বছর বয়সী কন্যা মায়া। দুই সন্তানের মা চুপচাপ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে তার সন্তানদের ঘুমিয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। একটি শাল জড়িয়ে, তিনি ঢাকার উপকণ্ঠে, কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে বাজারের দিকে যান এবং পুরুষদের তার কাছে আসার জন্য অপেক্ষা করেন।’

এভাবে ক্ষুধার্ত গার্মেন্টসকর্মী রুবির জীবনচিত্র তুলে ধরা হয়। বাস্তবে হাজার হাজার গার্মেন্টসকর্মীর অবস্থা ওই রুবির মতোই। কারণ দ্রব্যমূল্যে ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে যে বেতন পায় তা নিয়ে কোনোভাবেই দু’বেলা পেটভরে ডাল-ভাত খাওয়া যায় না। রাজধানী ঢাকার আশপাশের সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস এলাকায় দুপুরের দিকে ঘুরলে দেখা যায় হাজার হাজার নারী রুটি কলা খাচ্ছেন। ওটাই তাদের দুপুরের খাবার। অল্পভাড়ায় সেমিপাকা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে থাকেন। বিদেশ থেকে বৈদেশিক মূদ্রা এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ভরাচ্ছেন গায়ের ঘাম ঝড়িয়ে, অথচ দু’বেলা খেতে পারছেন না। যখন পেঁয়াজের কেজি দেড়শ’ টাকা, চালের কেজি ৬৫ থেকে ৮০ টাকা, একটি ডিম ১২ টাকা তখন গার্মেন্টস শ্রমিকদের মাসিক বেতন সাড়ে ১২ হাজার টাকা।

যুক্তরাষ্ট্রের নুতন শ্রমনীতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা নিয়ে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। নির্বাচন ঘিরে বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা খাত মার্কিন নীতির কষাঘাতে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা আছে, এমন অবস্থায় নতুন এই শ্রমনীতির বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখার দরকার আছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও রিজার্ভ সংকটের মধ্যে পুরো বিষয়টি হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।

বাংলাদেশের রফতানির ৮০ শতাংশ অর্থ আসে গার্মেন্টস পণ্য রফতানির মাধ্যমে। আর এ পণ্য রফতানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে ১৮ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, জাপানে রফতানি হয়। মূলত এসব দেশে গার্মেন্টস পণ্যে শতকরা ৮০ শতাংশ রফতানি হয়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষে ‘ভিসানীতি’ এবং শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন নিশ্চিত করতে ‘শ্রমনীতি’ ঘোষণা করেছে। আবার ২৭ দেশ নিয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক মূল্যায়ন রিপোর্টে বাংলাদেশকে নেতিবাচক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। গত ২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের মিশন থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ওই চিঠি দিয়ে জানানো হয় শ্রম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর রাজনৈতিক কারণে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। গত ১৫ ডিসেম্বর মার্কিন কংগ্রেসের ৮ সদস্যের এএএফএ’র সভাপতি ও প্রধান নির্বাহী স্টিভেন ল্যামারকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য ক্রয় না করার দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। এসব বিষয় তোয়াক্কা করছেন না ক্ষমতাসীন সরকার। অথচ দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিকদের ঘণ্টায় ১৫ ডলার করে দেয়; তারা যদি সে বেতন ঘন্টায় ৪৫ ডলার দেয় আমরাও দেব।’

বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কিছু দেশের কিছু শর্ত ছিল। শ্রম আইন, বেজা আইনে মার্কিন যে চাওয়া ছিল তা অনেকটাই পূরণ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক চাহিদা ও শ্রমিক অধিকার রক্ষা করেই তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রম-আইন ও শ্রম-অধিকারের বিষয়গুলো বেশ কিছু পালন হয়েছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে দিলেও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। মূলত যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যেতে বিএনপিসহ অর্ধশতাধিক দলকে বাইরে রেখেই ডামি প্রার্থী দিয়ে সমঝেতার নির্বাচন করা হচ্ছে। এতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে জিএসপি বাতিল হতে পারে এমন ইংগিত প্রকাশ পেয়েছে। ফলে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন।

যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ‘বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা’ ইস্যুতে গত সাপ্তাহে সংবাদ সম্মেলন করে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পোশাক রপ্তানি করছি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে শ্রমিক ইস্যু নিয়ে যেভাবে আমাদের ওপর চাপ দেওয়া হচ্ছে সেভাবে যেন দেশটি তাদের দেশের ক্রেতাদের বলে পোশাকের ন্যায্য মূল্য দিতে। আমাদের দেশে সর্বনিম্ন মজুরি ইতোমধ্যেই সকল তৈরি পোশাক কারখানায় কার্যকর করা হয়েছে।’ এই বক্তব্যের কয়েকদিন আগে বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘বিদেশ (ফ্রান্স) একটি ক্রেতা কোম্পানি জানিয়েছে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয়া হলে বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য ক্রয় করব না। শুধু তাই নয় জাহাজিকরণের পর পণ্য এলে তা গ্রহণ করলেও মূল্য পরিশোধ করা হবে না।’ এদিকে রাজপথে আন্দোলনরত রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বলছেন, পহেলা জানুয়ারি থেকে নির্বাচন প্রতিহতের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবেন।