সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আরও ‘দরিদ্র’ হয়েছে
- আপলোড টাইম : ০৯:০৯:২৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ জুন ২০২৩
- / ১০৭ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ প্রতিবেদন:
দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান ভালো না; কিন্ডারগার্টেনের সঙ্গে তুলনা করে এমনটাই মনে করেন অধিকাংশ অভিভাবক তাদের মতে, এই বিভাজন না হলেও পারত। সে সো ক্ষেত্রে উচিত ছিল পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার মান যথাযথ রাখার উদ্যোগ নেয়া। এই উদ্যোগের অভাবেই সচেতন অভিভাবকরা ঝুঁকেছেন কিন্ডারগার্টেনের দিকে। পয়সা বেশি খরচ হলেও শিক্ষার মান এখানে বেশি— এমনটাই মনে করছেন তারা। এদিকে মানসম্মত শিক্ষার অভাবে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আদতে ‘দরিদ্রের’ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে এভাবেই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর করুণ চিত্র ভেসে আসে গাইবান্ধার শিক্ষক রঞ্জিত সরকারের ভাষ্যে। আর্থিকভাবে সক্ষম অভিভাবকরা এখন তাদের সন্তানকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবর্তে উন্নত শিক্ষার জন্য কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি করান। এমনকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সন্তানকে এখানে ভর্তি করান না. বলছিলেন তিনি। শুধু গাইবান্ধায় নয়, খাতের সংশ্লিষ্টরা দেখেছেন, সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শ্রেণিকক্ষ গাদাগাদি করে বসতে হয়: আছে, দক্ষ শিক্ষক স্বল্পতা; নেই লাইব্রেরি, খেলার মাঠ, সহপাঠ্যক্রমিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ। এসব স্কুলে অর্থায়নের পরিমাণও কম। তাদের মতে, এর সবই মানসম্মত শিক্ষার প্রতিবন্ধক। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যে শিক্ষক সংকটে ভুগছে, তা উঠে এসেছে সরকারি তথ্যেও। প্রাথমিক ও গণশিক্ষাতে এখনও ৪৪,৭৯০টি পদ খালি আছে: জনসেবামূলক মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে এ সংখ্যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
চলতি বছরের এপ্রিল থেকে মে পর্যন্ত গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় পরিচালিত সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) একটি গবেষণায়ও সার্বিক প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার ভয়াবহ চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। সম্প্রতি গাইবান্ধার রাধাকৃষ্ণপুরে এসকেএস ইনে সিপিডি পরিচালিত ‘স্টেট অব প্রাইমারি স্কুল এডুকেশন : হোয়াট ক্যান উই ড্র’ শীর্ষক সংলাপে গবেষণার ফলাফল উন্মোচন করা হয়। অনুষ্ঠানে শিক্ষক, অভিভাবক, সরকারি প্রতিনিধি, শিক্ষা বিশেষজ্ঞসহ স্টেকহোল্ডাররা অংশ নেন। সিপিডির সমীক্ষায় দেখা গেছে, অপর্যাপ্ত সরকারি তহবিলের কারণে স্কুলগুলোতে পর্যাপ্ত কর্মী নিয়োগ, প্রয়োজনীয় শিক্ষণ সামগ্রী কেনা, অবকাঠামো এবং ব্যবস্থাপনার উন্নতি, সহপাঠ্যক্রমিকের শিক্ষক/প্রশিক্ষক নিয়োগ, এবং নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা ব্যবস্থা উন্নত করা সম্ভব হয় না। গবেষণায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজসহ মোট ১৩৬ জন উত্তরদাতার কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৯% প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে, ২৮% অসন্তোষ প্রকাশ করেছে।
জরিপ চালানো স্কুলগুলোর মধ্যে প্রায় ৬২% এর লাইব্রেরি নেই; অথচ সরকারি নীতি অনুযায়ী প্রতিটি স্কুলে কমপক্ষে ৫০০ বই সমৃদ্ধ লাইব্রেরি থাকতে হবে। এমনকি যেসব স্কুলে লাইব্রেরি আছে, সেখানেও মাত্র ২২% শিক্ষার্থী লাইব্রেরি ব্যবহার করে। প্রতিটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারের কাছ থেকে বার্ষিক প্রায় ৬০ হাজার টাকা বরাদ্দ পায়। প্রায় ৩৮% উত্তরদাতার মতে, শিক্ষার সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য এই অর্থ অপর্যাপ্ত। গত ১০ জুন আয়োজিত অনুষ্ঠানে সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমরা সবাই মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে একমত। কিন্তু শিক্ষা মানে শুধু শীর্ষস্থান অর্জন করা নয়। গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে কঠিন সময় পার করে। মূলত মানসম্পন্ন শিক্ষার বিষয়টি আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া অপরিহার্য। সামগ্রিক শিক্ষা বাজেটের প্রায় ২৫% থেকে ৩০% প্রাথমিক শিক্ষার জন্য বিশেষভাবে বরাদ্দ করা উচিত।
বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২১ অনুযায়ী, দেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার অধীনে আছে ২ কোটির বেশি শিক্ষার্থী। পরিসংখ্যান অনুসারে, মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় ৬৭.০৯% শিক্ষার্থী ৬৫,৫৬৬টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন সম্প্রতি বলেছেন, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ৪ লাখ ২৭ হাজারের বেশি। কিন্তু বর্তমানে মোট কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ৯০ হাজার। এদিকে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৬.৫১%, সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে হয়েছে ৪.৫৬%।
নেই জবাবদিহিতা, শিক্ষকও অপর্যাপ্ত :
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় মোট ২৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে পরিচালিত জরিপের জন্য ১০টি বিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গড়ে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে ৬৪ জন শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা আছে। জরিপে দেখা গেছে, একটি কার্যকর শ্রেণি ব্যবস্থাপনার জন্য ক্লাসে যতজন শিক্ষার্থী থাকা উচিত, তার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষার্থী ক্লাস করে প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে। বিদ্যালয়ে গড়ে ছয়জন শিক্ষক রয়েছে, যার ফলে এসব স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৫০। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের গড়ে ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই শিখন কার্যক্রম এবং শিখন দক্ষতার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, ৮১% শিক্ষার্থী মনে করে শিক্ষকদের পাঠদান কার্যকর। ১১% শিক্ষার্থী শিক্ষকদের পাঠদানকে কার্যকর বলে মনে করে না।
একটি স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি আসাদুজ্জামান হিমু বলেন, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ম্যানেজিং শিক্ষা কর্মকর্তাদের দখলে থাকেন। তাকে প্রতিনিয়ত উপজেলা ও জেলার মধ্যে যাতায়াত করতে হয়, সহকারি শিক্ষকদের মনিটর করার জন্য খুব কম সময় থাকে তার। শিক্ষা প্রশাসনের কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে, অপর্যাপ্ত জনবলের কারণে তারা নিয়মিত স্কুলগুলোতে পরিদর্শন করতে পারেন না। এদিকে, সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত স্কুলের সময় বর্ধিত করার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শিক্ষক এবং অভিভাবকরা। এত দীর্ঘ সময় ধরে স্কুলে থাকা শিশুদের পক্ষে চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে বলে জানান তারা।
উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়াতে হবে :
জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৫৫% উত্তরদাতা শিক্ষার্থীদের জন্য বর্তমানে বরাদ্দ সরকারি বৃত্তির পরিমাণ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু প্রায় অর্ধেকই এ পরিমাণ নিয়ে অসন্তুষ্ট। বিভিন্ন স্কুলের উত্তরদাতা আরও বলেছেন, করোনা পরবর্তী পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা কার্যক্রমে যে ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে নিতে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া, জরিপের আওতাধীন সব স্কুল এবং অন্যান্য উত্তরদাতা শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের নিয়ম চালু করার গুরুত্ব তুলে ধরেন। সংলাপ চলাকালে সুন্দরগঞ্জের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, এই এলাকায় দারিদ্র্যের হার প্রায় ৭০%-৮০%। চ্যালেঞ্জিং অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অভিভাবকরা শিক্ষার চেয়ে তাদের পরিবারের মৌলিক চাহিদা পূরণকেই অগ্রাধিকার দেন। সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, শিক্ষার অবকাঠামো, পাঠদানের উপকরণ এবং দক্ষ শিক্ষকের অভাব শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণে উল্লেখযোগ্য বাধা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিডির বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান।