তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি : নির্বাচনী রাজনীতিতে নতুন মাত্রা
- আপলোড টাইম : ০৪:১৮:৩০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৬ জুলাই ২০১৭
- / ৫৪৬ বার পড়া হয়েছে
সমীকরণ ডেস্ক: নতুন তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি গড়ে ওঠার খবর দেশের রাজনৈতিক নির্বাচনে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। যদিও ইতোমধ্যেই এই শক্তির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছেন এর সঙ্গে সম্পৃক্তরা; কিন্তু সেখানেই থেমে থাকছে না বিষয়টি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে অংশ নিতেই এমন শক্তি গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য কি না; নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কাজ করছে-তা নিয়ে আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। এ উদ্যোগের সঙ্গে এমন সব রাজনীতিক যুক্ত, যারা নানা কারণেই রাজনীতিতে বেশ আলোচিত ও সমালোচিত। আবার প্রজ্ঞাবান রাজনীতিকও রয়েছেন। আবার ডান ও বাম ঘরানার এসব রাজনীতিকদের এক প্লাটফর্মে এসে নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট গড়ার খবরেও রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
নির্বাচন সামনে রেখে এমন তৃতীয় শক্তি গড়ার খবর কিছুটা হলেও ভাবনায় ফেলেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকেও। বিশেষ করে আ স ম আবদুর রবের বাসায় এই জোটসংক্রান্ত ঘরোয়া আলোচনায় পুলিশের বাধাকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতাদের প্রতিবাদ ও জোটের পক্ষে পরোক্ষ সমর্থন জানানোয় প্রশ্ন উঠেছে এমন জোট গঠনের নেপথ্য কারণ নিয়েও। স্বয়ং বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পুলিশি বাধার ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানানোয় সেই প্রশ্ন আরো সামনে চলে আসছে। আওয়ামী লীগ এই জোটকে আমলে না নিলেও সতর্ক পর্যবেক্ষণে রেখেছে। পক্ষান্তরে মুখে সতর্ক থাকার কথা বললেও কিছুটা স্বস্তিতে বিএনপি। তারা মনে করছে, শেষ পর্যন্ত এই জোট সরকারবিরোধী অবস্থান নেবে ও বিএনপির মতো নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি জানাবে। তবে ওই ঘরোয়া বৈঠকে পুলিশের বাধা নিয়ে কিছুটা সমালোচনার মুখে রয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকালও বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কথা হয়েছে। এ নিয়ে গতকাল দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা হয়। তারা এই তৃতীয় রাজনৈতিক জোট গড়ার উদ্যোগকে ভালো চোখেই দেখছেন। তাদের মতে, এই নতুন জোটের সঙ্গে সম্পৃক্তরা রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবান মানুষ। রাজনৈতিক উদ্দেশের বাইরে এদের অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকার কথা নয়। তাদের দ্বারা জাতীয় রাজনীতি বা নির্বাচনে কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই।
গত বৃহস্পতিবার রাতে উত্তরায় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রবের বাসভবনে ডান ও বাম ঘরানার কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা বৈঠক করেন। বৈঠকে বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)-এর সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা বৈঠক করেন। এ ছাড়া বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত ছিলেন-স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তবে বৈঠক চলাকালে দুই দফা পুলিশের কয়েকজন সদস্য আ স ম আবদুর রবের বাসায় যান। তারা ওই বৈঠকের বিষয়ে জানতে চান। ওই সময় পুলিশকে জানানো হয়, সবাইকে রাতের খাবারের নিমন্ত্রণ করা হয়েছে।
বৈঠক সূত্রমতে, এ ফ্রন্ট রাজনৈতিক ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রার্থী দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। যথা সময়ে নতুন ফ্রন্টের ঘোষণা আসবে। শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্টে থাকবেন। সবাইকে নিয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হবে যাতে সামনে রাজনৈতিক ও নাগরিক ইস্যুতে আন্দোলন এবং জাতীয় নির্বাচনে সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করা যায়। সেসব দল ও সংগঠন জোটে আসবে তারা কমন ইস্যুতে কাজ করবে। তবে দলগুলোর নিজস্ব দলীয় কার্যক্রম হলে আলাদা। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আ স ম রব ও কাদের সিদ্দিকী বিকল্প রাজনৈতিক জোট এনডিএফের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মতো এনডিএফও নির্বাচন বর্জন করে।
সতর্ক আ. লীগ, স্বস্তিতে বিএনপি : মুখে এই জোট গঠনের বিষয়কে আমলে নিচ্ছে না বললেও ভেতরে ভেতরে এই জোট গঠনপ্রক্রিয়া ও এর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণে রাখছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দলের নেতাদের মতে, এই জোটের উদ্যোক্তারা রাজনীতিতে কিংবা ভোটের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব রাখেন, তাই নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগেও দেখা গেছে, সম্ভাব্য এই জোটের অনেক নেতাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একাধিক জোট কিংবা মোর্চা কিংবা আলাদাভাবে ভোটের মাঠে নেমেছিলেন। বিশেষ করে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, অধ্যাপক ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা, আ স ম আবদুর রবের জেএসডি ও কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ অন্য দলগুলোর প্রার্থীরা কত ভোট পেয়েছিলেন তা সবাই জানেন। অনেকেরই জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত শুক্রবার দলীয় ফোরামের এক যৌথসভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, নতুন এ জোট গঠনের উদ্যোগ ইতিবাচক দিক। নির্বাচনের আগে অনেকেই এমন জোট করে। তবে কি হবে না হবে, সেটি দেখার জন্য শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
অন্যদিকে, বিএনপি মনে করছে, শেষ পর্যন্ত এই জোট নির্বাচনে সরকারবিরোধী অবস্থান নেবে। এই জোটের নেতাদের দীর্ঘদিন ধরেই ২০ দলীয় জোটে নিতে চাইছে বিএনপি। এ নিয়ে বেশ কয়েকবার বৈঠকও হয়েছে। অনেকে ইতিবাচক সাড়াও দিয়েছেন। সর্বশেষ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ইফতার পার্টিতেও অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কিছু আলাপ-আলোচনাও করেছেন তারা। এরই মধ্যে ভিন্ন প্ল্যাটফর্মে এমন জোট গঠনের খবরে কিছুটা সতর্ক পর্যবেক্ষণ করছে দলটি। তবে বিএনপি স্বস্তি পাচ্ছে এই মনে করে যে, এই জোট শেষ পর্যন্ত সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে এগোবে। এমনও আশা করছে যে, এই জোটও বিএনপির মতো করে একটি নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবে। বিএনপি মনে করছে, নতুন জোট হলে সেটি শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গেই ‘নির্বাচনী সমঝোতা’ করবে। এ ব্যাপারে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এই জোট কি করবে, তা এখনো বলার সময় আসেনি। তবে নির্বাচনের আগে দল নির্বাচনী জোটের বিষয়টি গুরুত্ব দেবে।
ভালো চোখেই দেখছেন বিশ্লেষকরা : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জোট গঠনের উদ্যোগের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা সবাই গভীরভাবে রাজনীতির মানুষ। তাদের রাজনীতির বাইরে তাদের অন্য আকাক্সক্ষা থাকার কথা নয়। তারা রাজনীতির সঙ্গে থাকতে চান। নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চান। প্রজ্ঞাবান মানুষ তারা। সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে চান। মনমতো রাজনৈতিক ফ্রন্ট না পাওয়ায় নিজেরাই আলাদা কিছু করতে চান। বি চৌধুরীসহ আরো যাদের নাম শোনা যাচ্ছে, তারা নোংরামিতে যাওয়ার মতো মানুষ নন। নির্বাচনে খারাপ কিছু হোক, তা তারা চাইবেন না। তারা নির্বাচনে দাঁড়ালে, নির্বাচিত হলে ভালো হবে। ‘মনে হয় না এই জোটের পেছনে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল বা কারো কোনো ইঙ্গিত আছে’-উল্লেখ করে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, এদের অনেকেই তিক্ত অভিজ্ঞাতা নিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়েছে। আবার বিএনপিতে জামায়াত থাকায় সেখানেও তাদের অনীহা। সুতরাং জাতীয় পর্যায়ে ইতিবাচক রাজনীতির চিন্তাভাবনা থেকেই তারা এই জোট করতে চাইছেন। যদি হয়, তা হলে ভালো হবে। নির্বাচনী মাঠটা ভালো হবে। ভোটাররা ভালো মানুষ পাবে। মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে ভালো ভাবনার জাগ্রত হবে।
‘তবে ওই বৈঠকে পুলিশের বাধা অনাকাক্সিক্ষত’ বলেও মন্তব্য করেন অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। তার মতে, সেখানে ষড়যন্ত্র হতে পারে, এমন চিন্তা আনাটাই উচিত হয়নি। এমন ভাবনা পরিত্যাগ করা উচিত ছিল।
একইভাবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, আ স ম আবদুর রবের বাসায় সেদিন তারা কেন সভা করতে চেয়েছিলেন, তা আমরা এখনো জানতে পারিনি। তারা ভদ্রলোক। নিশ্চয় ভালো কিছুই হবে। তবে এত আগে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাচ্ছে না। বিষয়টা নির্ভর করে জনগণ বা ভোটারের ওপর। দুই দলের জোটের বাইরে কোনো জোটকে পছন্দ হলে তারা ভোট দেবেন। তবে ওই সভায় পুলিশের বাধা দেওয়ার মধ্য দিয়ে কিছু প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে-মন্তব্য করেন এই বিশ্লেষক। তার মতে, পুলিশ সভা, সমাবেশ করতে না দিলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিভাবে ও কেমন হবে, সেসব প্রশ্নও সামনে আসে। সংবিধানে রাজনৈতিক দলগুলোর সভা, সমাবেশ, মিছিলের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ আছে। এটা সরকারকে রক্ষা করতে হবে। সরকার হয়তো মনে করছে, রাজনীতিতে তৃতীয় কোনো জোট হলে তাদের অসুবিধা হতে পারে, পরেরবারও ক্ষমতায় থাকতে চায় তারা। ক্ষমতায় থাকার জন্য যেকোনো পন্থা অবল¤॥^ন করতে পারে সরকার, ঘটনাটির মধ্য দিয়ে এরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। পুলিশের এমন ব্যবহার গণতান্ত্রিক সমাজে কাম্য নয়।