ইপেপার । আজ মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫

আন্দোলনকারীদের দমানো নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম দূর করুন

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০২:৩২:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২২
  • / ৯৫ বার পড়া হয়েছে


‘বলপ্রয়োগ’ সমস্যা সমাধানের উত্তম পন্থা নয়। তাতে বরং পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়, সঙ্কট আরো বাড়ে। লাঠি ও বুলেটের জোরে আপাত শান্তি অর্জন করা যায়; কিন্তু পরিস্থিতি আসলে ছাইচাপা আগুনের মতো থেকে যায়। যতই চাপা দিন, একসময় না একসময় সেটি জ্বলে উঠবেই। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আমরা সাঁড়াশি পুলিশি অভিযান দেখলাম। সেখানে কর্তৃপক্ষের মদদে পুলিশ গুলি, কাঁদানে গ্যাস ও মুহুর্মুহু সাউন্ডগ্রেনেড চালিয়েছে। এমন জবরদস্তিমূলক পুলিশি অ্যাকশন বিগত বছরগুলোতে রাজপথেও দেখা গেছে। সরকার অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে বিরোধী রাজনীতি দমিয়ে দিতে পেরেছে। শাবিপ্রবিতে একই ধরনের অভিযান চালাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এভাবে কিছুই অর্জিত হয়নি।
কয়েকদিন ধরে শাবিপ্রবির ছাত্ররা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিকার চান তারা। দেখা গেল, কর্তৃপক্ষ উত্থাপিত অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বদলে তাদের দমানোর চেষ্টা করছে। প্রথমে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে আন্দোলন ভণ্ডুলের চেষ্টা করা হয়। ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালায়। ছাত্রীদের মারধর করে, লাঞ্ছিত করে। আমাদের নৈতিক অবস্থান ও বিবেকের ভূমিধস পতন হয়েছে। আগে কোনো ছাত্রী শ্লীলতাহানি কিংবা লাঞ্ছিত হলে চার দিক থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠত। এ জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করতে কেউ কুণ্ঠিত হতো না। নারীবাদীরা একযোগে প্রতিবাদী সুর মেলাতেন। এখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের এ ধরনের অপরাধ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না।
শাবিপ্রবিতে প্রশাসন ও ছাত্রলীগের এ গাঁটছড়া দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন গড়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নৈতিক অবস্থান এখন একেবারেই তলানিতে। বিগত এক দশকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিকার আদায়ের ন্যায্য আন্দোলনের প্রায় প্রত্যেকটিতে প্রশাসন ও ছাত্রলীগের দুষ্টচক্রের সমান্তরাল ভূমিকা দেখা গেছে। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে তারা সাধারণ ছাত্রদের ওপর নৃশংস কায়দায় হামলা করেছে। এবার শাবিপ্রবির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ ডেকে আনে। তবে কখনো দেখা যায় না ছাত্রলীগের অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নৈতিকতাবিবর্জিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া তো দূর অস্ত। এখন বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন পদে প্রশাসক নিয়োগে দলীয় আনুগত্য সর্বোচ্চ মানদণ্ড বিবেচিত হয়। ফলে শিক্ষার মতো মহৎ সেক্টরে বহু বিতর্কিত ও অপরাধীকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। শাবিপ্রবির বর্তমান দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়া ভিসিও একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। এ ধরনের ব্যক্তিরা শিক্ষা-দীক্ষার দিকে মনোযোগ দেয়ার বদলে নিজেদের আখের গোছানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সে জন্যই আমাদের শিক্ষার মানে এ অধঃপতন।
শাবিপ্রবিতে আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত একটি হলের প্রাধ্যক্ষকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ছাত্ররা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ অবস্থায় ছাত্ররা তাদের তিন দফা আন্দোলন বাদ দিয়ে এখন এক দফা দাবিতে অনড়। তারা এখন শুধু ভিসির পদত্যাগ চান। প্রশাসনের সিদ্ধান্তের পরোয়া না করে তারা হলে অবস্থান করেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
একটি দেশে নানা ধরনের অন্যায়-অনিয়ম ও দুর্নীতি থাকতে পারে; সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রশাসনে তার কোনো স্থান হয় না। বিশেষ করে উন্নত ও সভ্য দেশগুলোতে তা দেখা যায় না। আমাদের দেশে দুর্নীতিতে অন্যান্য সব সেক্টরের মতো শিক্ষা খাতও সয়লাব হয়ে গেছে। শাবিপ্রবির ছাত্রদের প্রতিবাদ তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তারা ওই সব অনিয়মের প্রতিকার চান। অন্য দিকে অনিয়মের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের লোকেরা সেখানে প্রভাবশালী। তাই তারা ছাত্রদের দাবি মানতে রাজি নন। তারা কোনো-না-কোনোভাবে আন্দোলন দমাতে চান। এ ধরনের সমস্যা শুধু শাবিপ্রবিতে নয়, দেশের প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা মনে করি, এমন অবস্থার পরিবর্তন দরকার। এভাবে অন্যায়-অনিয়ম অব্যাহত চললে জাতি সব দিক থেকেই দেউলিয়া হয়ে যাবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

আন্দোলনকারীদের দমানো নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়ম দূর করুন

আপলোড টাইম : ০২:৩২:০০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২২


‘বলপ্রয়োগ’ সমস্যা সমাধানের উত্তম পন্থা নয়। তাতে বরং পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়, সঙ্কট আরো বাড়ে। লাঠি ও বুলেটের জোরে আপাত শান্তি অর্জন করা যায়; কিন্তু পরিস্থিতি আসলে ছাইচাপা আগুনের মতো থেকে যায়। যতই চাপা দিন, একসময় না একসময় সেটি জ্বলে উঠবেই। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) আমরা সাঁড়াশি পুলিশি অভিযান দেখলাম। সেখানে কর্তৃপক্ষের মদদে পুলিশ গুলি, কাঁদানে গ্যাস ও মুহুর্মুহু সাউন্ডগ্রেনেড চালিয়েছে। এমন জবরদস্তিমূলক পুলিশি অ্যাকশন বিগত বছরগুলোতে রাজপথেও দেখা গেছে। সরকার অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে বিরোধী রাজনীতি দমিয়ে দিতে পেরেছে। শাবিপ্রবিতে একই ধরনের অভিযান চালাতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, এভাবে কিছুই অর্জিত হয়নি।
কয়েকদিন ধরে শাবিপ্রবির ছাত্ররা বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিকার চান তারা। দেখা গেল, কর্তৃপক্ষ উত্থাপিত অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বদলে তাদের দমানোর চেষ্টা করছে। প্রথমে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিয়ে আন্দোলন ভণ্ডুলের চেষ্টা করা হয়। ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালায়। ছাত্রীদের মারধর করে, লাঞ্ছিত করে। আমাদের নৈতিক অবস্থান ও বিবেকের ভূমিধস পতন হয়েছে। আগে কোনো ছাত্রী শ্লীলতাহানি কিংবা লাঞ্ছিত হলে চার দিক থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠত। এ জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করতে কেউ কুণ্ঠিত হতো না। নারীবাদীরা একযোগে প্রতিবাদী সুর মেলাতেন। এখন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের এ ধরনের অপরাধ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করে না।
শাবিপ্রবিতে প্রশাসন ও ছাত্রলীগের এ গাঁটছড়া দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন গড়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নৈতিক অবস্থান এখন একেবারেই তলানিতে। বিগত এক দশকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিকার আদায়ের ন্যায্য আন্দোলনের প্রায় প্রত্যেকটিতে প্রশাসন ও ছাত্রলীগের দুষ্টচক্রের সমান্তরাল ভূমিকা দেখা গেছে। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে তারা সাধারণ ছাত্রদের ওপর নৃশংস কায়দায় হামলা করেছে। এবার শাবিপ্রবির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ ডেকে আনে। তবে কখনো দেখা যায় না ছাত্রলীগের অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নৈতিকতাবিবর্জিত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া তো দূর অস্ত। এখন বিশ্ববিদ্যালয়সহ উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন পদে প্রশাসক নিয়োগে দলীয় আনুগত্য সর্বোচ্চ মানদণ্ড বিবেচিত হয়। ফলে শিক্ষার মতো মহৎ সেক্টরে বহু বিতর্কিত ও অপরাধীকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে। শাবিপ্রবির বর্তমান দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ পাওয়া ভিসিও একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। এ ধরনের ব্যক্তিরা শিক্ষা-দীক্ষার দিকে মনোযোগ দেয়ার বদলে নিজেদের আখের গোছানো নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সে জন্যই আমাদের শিক্ষার মানে এ অধঃপতন।
শাবিপ্রবিতে আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত একটি হলের প্রাধ্যক্ষকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ছাত্ররা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ অবস্থায় ছাত্ররা তাদের তিন দফা আন্দোলন বাদ দিয়ে এখন এক দফা দাবিতে অনড়। তারা এখন শুধু ভিসির পদত্যাগ চান। প্রশাসনের সিদ্ধান্তের পরোয়া না করে তারা হলে অবস্থান করেই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
একটি দেশে নানা ধরনের অন্যায়-অনিয়ম ও দুর্নীতি থাকতে পারে; সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রশাসনে তার কোনো স্থান হয় না। বিশেষ করে উন্নত ও সভ্য দেশগুলোতে তা দেখা যায় না। আমাদের দেশে দুর্নীতিতে অন্যান্য সব সেক্টরের মতো শিক্ষা খাতও সয়লাব হয়ে গেছে। শাবিপ্রবির ছাত্রদের প্রতিবাদ তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে। তারা ওই সব অনিয়মের প্রতিকার চান। অন্য দিকে অনিয়মের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের লোকেরা সেখানে প্রভাবশালী। তাই তারা ছাত্রদের দাবি মানতে রাজি নন। তারা কোনো-না-কোনোভাবে আন্দোলন দমাতে চান। এ ধরনের সমস্যা শুধু শাবিপ্রবিতে নয়, দেশের প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমরা মনে করি, এমন অবস্থার পরিবর্তন দরকার। এভাবে অন্যায়-অনিয়ম অব্যাহত চললে জাতি সব দিক থেকেই দেউলিয়া হয়ে যাবে।