ইপেপার । আজ মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বীর তরুণেরাই হতে পারে তরুণদের স্বপ্নসারথী

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:২৮:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ অগাস্ট ২০১৬
  • / ৬৪১ বার পড়া হয়েছে

আনোয়ার হোসেন
নাট্যকর্মী
গত ১ জুলাই ২০১৬ তারিখে ঘটনাবহুল বাংলাদেশে আরেকটি নতুন ঘটনা দেশে নতুন এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করেছে। গুলশান ট্রাজেডি।  হলি আর্টিসান রেষ্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা সমগ্র বাংলাদেশকে যেমন থমকে দিয়েছে তেমনি বিশ্বময় “বাংলাদেশ” মিডিয়ার প্রধান খবর হয়ে ওঠে।  আজ আমরা নতুন এক বাংলাদেশের মুখোমুখি। যেখানে আত্মঘাতি জঙ্গি হামলায় ২ পুলিশ ও ১৮ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে জিম্মি করে হত্যা করা হয়েছে। ৬ জন জঙ্গীকে হত্যা করেছে আমাদের যৌথ বাহিনী। এরপর ঢাকার কল্যানপুর জঙ্গীদের একটি আস্তানায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এক অভিযান চালিয়ে ৬ জঙ্গীকে হত্যা করেছে। পরে বিভিন্ন আলামত দেখে বোঝা গেছে আরও একটি দুর্ঘটনা থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে। সংখ্যার বিবেচনায় আমাদের দেশে প্রতিদিন এর থেকে বেশি সংখ্যক মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। জীবন আমাদের কাছে এতটাই মূল্যহীন। কিন্তু এই মৃত্যু সমগ্র পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছে। কেননা ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস বিশ্বকে অস্থির করে তুলেছে এটি তারই অংশ।
এই জঙ্গী তৎপরতার পর সরকার, নাগরিক সমাজ, নীতি নির্ধারক, বুদ্ধিজীবি সকলে আলোচনার টেবিলে ঝড় তুলেছেন আমাদের আগামী প্রজন্ম অর্থাৎ তরুন প্রজন্মের বেড়ে ওঠা ও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু হাস্যকর হচ্ছে, যে তরুণ সমাজকে নিয়ে এই ভাবনা, সেই তরুণ সমাজকে কোন আলোচনায় আমরা দেখছি না। যার সমস্যা ও যাকে নিয়ে সমস্যা তার সাথে কিংবা তাকে নিয়ে পরিকল্পনা না করলে পৃথিবীতে কোথাও কোন পরিবর্তন আসেনি। যারা পূঁথি বিদ্যায় বিজ্ঞ তারা মনে করেন তারাই পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। সামাজিক শক্তিকে বুঝবার ক্ষমতা না থাকলে সেই সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক  পরিবর্তনের পরিকল্পনা সবই বৃথা। এখন আরেকটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে তা হলো – তথ্য প্রযুক্তি। তথ্য প্রযুক্তি বিকাশের চরম এই ক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা যদি সাধারণ একটি বিভাজন করি যে, কারা  এই সুবিধা পাচ্ছে? আমাদের দেশে পঞ্চাশোর্ধ মানুষের খুবই সীমিত অংশ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সক্ষম, চলি¬শোর্ধ থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত একটি পেশাজীবি অংশ পেশার চাপে পড়ে কম্পিউটার যতটুকু অপারেট করতে জানে, যার মাধ্যমে লেখালেখি এবং হিসাবপত্র করে থাকেন। ত্রিশোর্ধ থেকে চলি¬শের মধ্যে একটি অংশ একটু একটু ফেসবুক- টুইটারও ব্যবহার করে থাকেন। আর ভার্চুয়াল যে বিশ্বের কথা বলা হচ্ছে সেখানে প্রায় একক আধিপত্য ত্রিশের নীচে যাদের বয়স। ভার্চুয়াল পৃথিবীর এই মানুষগুলোর প্রয়োজন, সমস্যা, স্বপ্ন মাটির পৃথিবীর মানুষেরা কিভাবে বুঝবেন আর সমাধানই বা কি করবেন। সমাজ চিন্তাবিদদের কাছে অনুরোধ যখন তরুণদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহনের দিকে এগুবেন, তখন অবশ্যই সেখানে অর্ধেকের বেশি তরুন প্রতিনিধিদের অংশগ্রহনের সুযোগ করে দিন। অর্ধেকের বেশি এজন্য প্রয়োজন যেন যুক্তি-তর্কে বয়ঃজৈষ্ঠদের চাপে তাকে চুপ থাকতে না হয়।
হলি আর্টিসানে যেসব জঙ্গিরা হামলা করেছে তাদের পরিচয় বের হচ্ছে, তারা সকলে উচ্চবিত্ত পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এদেশের দরিদ্র পরিবারের তরুণেরা এবার প্রমান করেছে, দারিদ্রতার কারণে তাকে কেউ জঙ্গী তৈরি করতে পারেনি। এখন আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে উচ্চবিত্ত পরিবারের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেরা কি করে এমন জঙ্গী হয়ে উঠলো। আমার প্রশ্ন এদেশে কেউকি কাউকে সার্টিফিকেট দিয়েছে যে, এত টাকার মালিক হলে আর ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করলে সে কখনো জঙ্গী হবে না! যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সব বড় বড় বুদ্ধিজীবিরা কেন ঐসকল পরিবারের সাফাই গাইছি। আমরা এমন অনেক ধন সম্পদের মালিক পরিবারকে দেখছি যাদের চরম রক্ষনশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গী। dssএখানেও বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে, এদেশে কিছু মানুষ রাতারাতি পাহাড়সম সম্পদের মালিক হয়ে উঠছে। যাদের কাছে নৈতিকতার থেকে সম্পদের আভিজাত্য প্রকাশটা বড় ব্যাপার। তাদের কাছে সম্পদের সুরক্ষার জন্য মুক্তচিন্তার থেকে রক্ষনশীলতা ও গোয়াড় গোবিন্দ থাকা পৈতৃক সম্পদ রক্ষায় অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করা হয়। সেজন্য ঐ সকল সন্তানদের প্রাথমিক স্কুল থেকেই বিএমডাব¬ু কিংবা মার্সিটিজ গাড়িতে চড়িয়ে স্কুলে পাঠানো হয়, তাকে শেখানো হয় সে সবার থেকে আলাদা, এটা নেটিভদের দেশ, এদেশের কালচার খুবই গেঁয়ো, এদেশ তার উপযোগি না, একটু বড় হয়েই তুমি ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়া কিংবা আমেরিকায় পাড়ি জমাবে। গর্ব করে বলা হয়, ছেলেটা কিংবা মেয়েটা এত ভালো হয়েছে যে, এত বড় হয়েও ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না। ভাজা মাছটা উল্টে খেতে না পারায় তার সব থেকে বড় যোগ্যতা। কথাগুলো আমি কোন ধনী পরিবারকে কটাক্ষ করতে বলিনি কিংবা ধনীক শ্রেনীর উপর আমার কোন ক্ষোভও নেই। আমি বিশ্বাস করি ধনী হতে পারাটা যে কোন মানুষের একটি বড় যোগ্যতা। যে ধনীক পরিবারের সন্তান, তার পরিচয় কি? শুধুই একটি ধনীক পরিবারের সন্তান! যতদিন তার আত্মসম্মান বোধের জায়গাটি গড়ে না ওঠে ততদিন তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখা গেলেও যখন তার আত্মসম্মানবোধ ধীরে ধীরে জেগে ওঠে  তখন সে এই পরিচয়ে আর স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না। কখনও কখনও এই পরিচয় তার জন্য বোঝা হয়ে ওঠে, তার আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তখন সে কি করবে? এই পেক্ষাপটে একটি দরিদ্র কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা যখন নিজ গুণেই নিজের আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে পারে তার কাছে ঐ ধনীক পরিবারের পরিচয় ¤্রয়িমান হয়ে যায়।
বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সূচকে ধনী-দরিদ্র, উচু-নিচু, জাত-পাত থাকবেই। আমার এই লেখা সেখানে কোন পরিবর্তনই আনতে পারবে না, আর সেটা আমি আশাও করিনা। তবে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষের বেড়ে ওঠার জমিনে বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থা থাকলে, রাষ্ট্রের সে বৈষম্য তরুনদেরকে বিভাজিত করবেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যে, সকল বাবা-মা তার সন্তানকে সকলের মধ্যে সেরা হিসাবে দেখতে চায়। আজ শিক্ষার্থীরা নাচে না, গায় না, ক্রিকেট খেলে না, ফুটবল খেলে না, সিনেমা দেখে না, রাজনীতি করেনা, পাড়ায় ক্লাব-সংগঠন করে না – শুধুই পড়ে আর ভার্চুয়াল পৃথিবীতে চলাচল করে। মাটির পৃথিবীর সাথে তার যোগাযোগ খুবই কম। লক্ষ্য একটাই গোল্ডেন পেতে হবে। একসময় কেউ কেউ গোল্ডেন পেয়ে বাবা-মার স্বপ্নপূরণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু একটি বিরাট সংখ্যায় বাবা-মার স্বপ্নভঙ্গ হয়। বাবা-মার স্বপ্নপূরণ বা স্বপ্নভঙ্গ যায় হোক, শেষমেষ ছেলে কিংবা মেয়েটা কি চেয়েছিলো- আর কি পেলো তার খোঁজ আর কেউ রাখে না। বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, সাংবাদিক আরও কত কত পেশাজীবি গড়ে ওঠে। পরে আমরাই সেই ডাক্তারকে কসাই বলি, ইঞ্জিনিয়ারকে বালু চোর বলি, উকিলকে জোঁক বলি, সাংবাদিককে ধান্ধাবাজ বলি, আরও কত কত পেশার মানুষকে কত কত বিশেষনে বিশেষায়িত করি। তারমধ্যেও কেউ কেউ আমাদের আদর্শ হয়ে ওঠে, আমাদের নতুন সম্ভাবনার পথে নিয়ে চলে। আর যারা সাধারন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠি, দীর্ঘ শিক্ষা জীবন শেষ করে বাংলা আর ভাংগা ভাংগা ইংরেজি পড়তে ও লিখতে শিখেছি, সাথে যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগটাও রপ্ত করতে পেরেছি। ১৫-২০ বছরে এই অর্জনটুকু অনেক তরুনকে শেষ পর্যন্ত স্বস্তি দেয় না, মানসিক প্রশান্তি দেয়না।
আজ যে তরুনদের নিয়ে আমরা ভাবছি সেই তরুণদের একটি বড় সংখ্যা এমন মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে মাদকাসক্ত হচ্ছে, জঙ্গী হচ্ছে সর্বোপরি জীবনের প্রতি কেমন যেন বিতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে। তারই সুযোগ নিচ্ছে তালেবান, আল-কায়দা, জামায়েতুল মুজাহিদ্বীন, হরকাতুল জিহাদ আরও কত কত নাম, সর্বশেষ সংস্করণ আইএস। এই সব জঙ্গীগোষ্ঠিকে আমরা যে সকল অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখি তা পৃথিবীর পারমানবিক শক্তিধর দেশগুলোর সেনাবাহিনী ব্যবহার করে। কোথা থেকে আসে সেগুলো, কারা তাদেরকে সেইসব অস্ত্র সরবরাহ করে! সবকিছুর মধ্যে আন্তর্জাতিকতার একটি গন্ধ আছে, যা এইসব তরুণদের প্রলুব্ধ করে। জীবনের প্রতি বিতশ্রদ্ধ এমন তরুণদের জীবনের ওপারের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করা সহজ হয়ে উঠেছে তাদের জন্য, যারা পৃথিবীতে এই সন্ত্রাস কায়েম করে আধিপত্য বিস্তার করতে চায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর ও রাষ্ট্রিয় সম্পদের উপর।
তরুণরাই আজকের পৃথিবীকে নতুন নতুন ধারণা ও প্রযুক্তি দিয়ে বদলে দিচ্ছে। পৃথিবীকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেখবার সুযোগ করে দিচ্ছে তরুণেরা। সেজন্য জাকারবার্গ, পিচাইরা হচ্ছে তরুণদের আইডল। শাহরুখ, সাকিব, শচীনরা হচ্ছে প্রেরণা। এরাই হচ্ছে আজকের তরুণদের কাছে বীর। সময় হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রের সকল স্তর থেকে বীর তরুণদের চিহ্নিতে কাজ করার  ক্রিকেট থেকে এমন অনেক বীর আমরা পেয়েছি, যার সর্বশেষ মুস্তাফিজ। মুস্তাফিজ আমাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে, আস্তাকুঁড়ে থেকেও রাজপুত্র হওয়া যায়। আমি রাজপুত্র দেখিনি-মুস্তাফিজ আমার রাজপুত্র। শুধু ক্রিকেটের মধ্যে আটকে থাকলে হবে না, তরুণদের মধ্যে থেকে এমন অনেক অনেক বীরকে খুঁজে বের করতে হবে, রাষ্ট্রকে তাদের মাথায় বীরের মুকুট পরিয়ে দিতে হবে, রাষ্ট্রকে তাদের পরম যতেœ লালন করতে হবে, যা কোটি তরুণকে স্বপ্নের সিঁড়িতে পা দিতে সাহস যোগাবে। আমাদের রাষ্ট্র সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সব তরুণকে সমান সুযোগ নিয়ে বেড়ে উঠতে সুযোগ দিতে হবে। ক্ষমতার বলয় টিকিয়ে রাখার জন্য তারা আর ঢাল হয়ে থাকবে না।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

বীর তরুণেরাই হতে পারে তরুণদের স্বপ্নসারথী

আপলোড টাইম : ১০:২৮:১১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৫ অগাস্ট ২০১৬

আনোয়ার হোসেন
নাট্যকর্মী
গত ১ জুলাই ২০১৬ তারিখে ঘটনাবহুল বাংলাদেশে আরেকটি নতুন ঘটনা দেশে নতুন এক কালো অধ্যায়ের সূচনা করেছে। গুলশান ট্রাজেডি।  হলি আর্টিসান রেষ্টুরেন্টে জঙ্গি হামলা সমগ্র বাংলাদেশকে যেমন থমকে দিয়েছে তেমনি বিশ্বময় “বাংলাদেশ” মিডিয়ার প্রধান খবর হয়ে ওঠে।  আজ আমরা নতুন এক বাংলাদেশের মুখোমুখি। যেখানে আত্মঘাতি জঙ্গি হামলায় ২ পুলিশ ও ১৮ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে জিম্মি করে হত্যা করা হয়েছে। ৬ জন জঙ্গীকে হত্যা করেছে আমাদের যৌথ বাহিনী। এরপর ঢাকার কল্যানপুর জঙ্গীদের একটি আস্তানায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এক অভিযান চালিয়ে ৬ জঙ্গীকে হত্যা করেছে। পরে বিভিন্ন আলামত দেখে বোঝা গেছে আরও একটি দুর্ঘটনা থেকে দেশ রক্ষা পেয়েছে। সংখ্যার বিবেচনায় আমাদের দেশে প্রতিদিন এর থেকে বেশি সংখ্যক মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। জীবন আমাদের কাছে এতটাই মূল্যহীন। কিন্তু এই মৃত্যু সমগ্র পৃথিবীকে নাড়া দিয়েছে। কেননা ধর্মের নামে যে সন্ত্রাস বিশ্বকে অস্থির করে তুলেছে এটি তারই অংশ।
এই জঙ্গী তৎপরতার পর সরকার, নাগরিক সমাজ, নীতি নির্ধারক, বুদ্ধিজীবি সকলে আলোচনার টেবিলে ঝড় তুলেছেন আমাদের আগামী প্রজন্ম অর্থাৎ তরুন প্রজন্মের বেড়ে ওঠা ও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু হাস্যকর হচ্ছে, যে তরুণ সমাজকে নিয়ে এই ভাবনা, সেই তরুণ সমাজকে কোন আলোচনায় আমরা দেখছি না। যার সমস্যা ও যাকে নিয়ে সমস্যা তার সাথে কিংবা তাকে নিয়ে পরিকল্পনা না করলে পৃথিবীতে কোথাও কোন পরিবর্তন আসেনি। যারা পূঁথি বিদ্যায় বিজ্ঞ তারা মনে করেন তারাই পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন। সামাজিক শক্তিকে বুঝবার ক্ষমতা না থাকলে সেই সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক  পরিবর্তনের পরিকল্পনা সবই বৃথা। এখন আরেকটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে তা হলো – তথ্য প্রযুক্তি। তথ্য প্রযুক্তি বিকাশের চরম এই ক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা যদি সাধারণ একটি বিভাজন করি যে, কারা  এই সুবিধা পাচ্ছে? আমাদের দেশে পঞ্চাশোর্ধ মানুষের খুবই সীমিত অংশ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সক্ষম, চলি¬শোর্ধ থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত একটি পেশাজীবি অংশ পেশার চাপে পড়ে কম্পিউটার যতটুকু অপারেট করতে জানে, যার মাধ্যমে লেখালেখি এবং হিসাবপত্র করে থাকেন। ত্রিশোর্ধ থেকে চলি¬শের মধ্যে একটি অংশ একটু একটু ফেসবুক- টুইটারও ব্যবহার করে থাকেন। আর ভার্চুয়াল যে বিশ্বের কথা বলা হচ্ছে সেখানে প্রায় একক আধিপত্য ত্রিশের নীচে যাদের বয়স। ভার্চুয়াল পৃথিবীর এই মানুষগুলোর প্রয়োজন, সমস্যা, স্বপ্ন মাটির পৃথিবীর মানুষেরা কিভাবে বুঝবেন আর সমাধানই বা কি করবেন। সমাজ চিন্তাবিদদের কাছে অনুরোধ যখন তরুণদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা কিংবা সিদ্ধান্ত গ্রহনের দিকে এগুবেন, তখন অবশ্যই সেখানে অর্ধেকের বেশি তরুন প্রতিনিধিদের অংশগ্রহনের সুযোগ করে দিন। অর্ধেকের বেশি এজন্য প্রয়োজন যেন যুক্তি-তর্কে বয়ঃজৈষ্ঠদের চাপে তাকে চুপ থাকতে না হয়।
হলি আর্টিসানে যেসব জঙ্গিরা হামলা করেছে তাদের পরিচয় বের হচ্ছে, তারা সকলে উচ্চবিত্ত পরিবারের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। এদেশের দরিদ্র পরিবারের তরুণেরা এবার প্রমান করেছে, দারিদ্রতার কারণে তাকে কেউ জঙ্গী তৈরি করতে পারেনি। এখন আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে উচ্চবিত্ত পরিবারের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ছেলেরা কি করে এমন জঙ্গী হয়ে উঠলো। আমার প্রশ্ন এদেশে কেউকি কাউকে সার্টিফিকেট দিয়েছে যে, এত টাকার মালিক হলে আর ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করলে সে কখনো জঙ্গী হবে না! যদি তা না হয়ে থাকে, তাহলে আমরা সব বড় বড় বুদ্ধিজীবিরা কেন ঐসকল পরিবারের সাফাই গাইছি। আমরা এমন অনেক ধন সম্পদের মালিক পরিবারকে দেখছি যাদের চরম রক্ষনশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গী। dssএখানেও বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে, এদেশে কিছু মানুষ রাতারাতি পাহাড়সম সম্পদের মালিক হয়ে উঠছে। যাদের কাছে নৈতিকতার থেকে সম্পদের আভিজাত্য প্রকাশটা বড় ব্যাপার। তাদের কাছে সম্পদের সুরক্ষার জন্য মুক্তচিন্তার থেকে রক্ষনশীলতা ও গোয়াড় গোবিন্দ থাকা পৈতৃক সম্পদ রক্ষায় অনেক বেশি নিরাপদ বলে মনে করা হয়। সেজন্য ঐ সকল সন্তানদের প্রাথমিক স্কুল থেকেই বিএমডাব¬ু কিংবা মার্সিটিজ গাড়িতে চড়িয়ে স্কুলে পাঠানো হয়, তাকে শেখানো হয় সে সবার থেকে আলাদা, এটা নেটিভদের দেশ, এদেশের কালচার খুবই গেঁয়ো, এদেশ তার উপযোগি না, একটু বড় হয়েই তুমি ইউরোপ, অষ্ট্রেলিয়া কিংবা আমেরিকায় পাড়ি জমাবে। গর্ব করে বলা হয়, ছেলেটা কিংবা মেয়েটা এত ভালো হয়েছে যে, এত বড় হয়েও ভাজা মাছটাও উল্টে খেতে জানে না। ভাজা মাছটা উল্টে খেতে না পারায় তার সব থেকে বড় যোগ্যতা। কথাগুলো আমি কোন ধনী পরিবারকে কটাক্ষ করতে বলিনি কিংবা ধনীক শ্রেনীর উপর আমার কোন ক্ষোভও নেই। আমি বিশ্বাস করি ধনী হতে পারাটা যে কোন মানুষের একটি বড় যোগ্যতা। যে ধনীক পরিবারের সন্তান, তার পরিচয় কি? শুধুই একটি ধনীক পরিবারের সন্তান! যতদিন তার আত্মসম্মান বোধের জায়গাটি গড়ে না ওঠে ততদিন তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখা গেলেও যখন তার আত্মসম্মানবোধ ধীরে ধীরে জেগে ওঠে  তখন সে এই পরিচয়ে আর স্বাচ্ছন্দ বোধ করে না। কখনও কখনও এই পরিচয় তার জন্য বোঝা হয়ে ওঠে, তার আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। তখন সে কি করবে? এই পেক্ষাপটে একটি দরিদ্র কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা যখন নিজ গুণেই নিজের আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে পারে তার কাছে ঐ ধনীক পরিবারের পরিচয় ¤্রয়িমান হয়ে যায়।
বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক সূচকে ধনী-দরিদ্র, উচু-নিচু, জাত-পাত থাকবেই। আমার এই লেখা সেখানে কোন পরিবর্তনই আনতে পারবে না, আর সেটা আমি আশাও করিনা। তবে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষের বেড়ে ওঠার জমিনে বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থা থাকলে, রাষ্ট্রের সে বৈষম্য তরুনদেরকে বিভাজিত করবেই। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যে, সকল বাবা-মা তার সন্তানকে সকলের মধ্যে সেরা হিসাবে দেখতে চায়। আজ শিক্ষার্থীরা নাচে না, গায় না, ক্রিকেট খেলে না, ফুটবল খেলে না, সিনেমা দেখে না, রাজনীতি করেনা, পাড়ায় ক্লাব-সংগঠন করে না – শুধুই পড়ে আর ভার্চুয়াল পৃথিবীতে চলাচল করে। মাটির পৃথিবীর সাথে তার যোগাযোগ খুবই কম। লক্ষ্য একটাই গোল্ডেন পেতে হবে। একসময় কেউ কেউ গোল্ডেন পেয়ে বাবা-মার স্বপ্নপূরণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু একটি বিরাট সংখ্যায় বাবা-মার স্বপ্নভঙ্গ হয়। বাবা-মার স্বপ্নপূরণ বা স্বপ্নভঙ্গ যায় হোক, শেষমেষ ছেলে কিংবা মেয়েটা কি চেয়েছিলো- আর কি পেলো তার খোঁজ আর কেউ রাখে না। বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, সাংবাদিক আরও কত কত পেশাজীবি গড়ে ওঠে। পরে আমরাই সেই ডাক্তারকে কসাই বলি, ইঞ্জিনিয়ারকে বালু চোর বলি, উকিলকে জোঁক বলি, সাংবাদিককে ধান্ধাবাজ বলি, আরও কত কত পেশার মানুষকে কত কত বিশেষনে বিশেষায়িত করি। তারমধ্যেও কেউ কেউ আমাদের আদর্শ হয়ে ওঠে, আমাদের নতুন সম্ভাবনার পথে নিয়ে চলে। আর যারা সাধারন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠি, দীর্ঘ শিক্ষা জীবন শেষ করে বাংলা আর ভাংগা ভাংগা ইংরেজি পড়তে ও লিখতে শিখেছি, সাথে যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগটাও রপ্ত করতে পেরেছি। ১৫-২০ বছরে এই অর্জনটুকু অনেক তরুনকে শেষ পর্যন্ত স্বস্তি দেয় না, মানসিক প্রশান্তি দেয়না।
আজ যে তরুনদের নিয়ে আমরা ভাবছি সেই তরুণদের একটি বড় সংখ্যা এমন মানসিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে মাদকাসক্ত হচ্ছে, জঙ্গী হচ্ছে সর্বোপরি জীবনের প্রতি কেমন যেন বিতশ্রদ্ধ হয়ে উঠছে। তারই সুযোগ নিচ্ছে তালেবান, আল-কায়দা, জামায়েতুল মুজাহিদ্বীন, হরকাতুল জিহাদ আরও কত কত নাম, সর্বশেষ সংস্করণ আইএস। এই সব জঙ্গীগোষ্ঠিকে আমরা যে সকল অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখি তা পৃথিবীর পারমানবিক শক্তিধর দেশগুলোর সেনাবাহিনী ব্যবহার করে। কোথা থেকে আসে সেগুলো, কারা তাদেরকে সেইসব অস্ত্র সরবরাহ করে! সবকিছুর মধ্যে আন্তর্জাতিকতার একটি গন্ধ আছে, যা এইসব তরুণদের প্রলুব্ধ করে। জীবনের প্রতি বিতশ্রদ্ধ এমন তরুণদের জীবনের ওপারের স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করা সহজ হয়ে উঠেছে তাদের জন্য, যারা পৃথিবীতে এই সন্ত্রাস কায়েম করে আধিপত্য বিস্তার করতে চায় বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর ও রাষ্ট্রিয় সম্পদের উপর।
তরুণরাই আজকের পৃথিবীকে নতুন নতুন ধারণা ও প্রযুক্তি দিয়ে বদলে দিচ্ছে। পৃথিবীকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দেখবার সুযোগ করে দিচ্ছে তরুণেরা। সেজন্য জাকারবার্গ, পিচাইরা হচ্ছে তরুণদের আইডল। শাহরুখ, সাকিব, শচীনরা হচ্ছে প্রেরণা। এরাই হচ্ছে আজকের তরুণদের কাছে বীর। সময় হয়েছে আমাদের রাষ্ট্রের সকল স্তর থেকে বীর তরুণদের চিহ্নিতে কাজ করার  ক্রিকেট থেকে এমন অনেক বীর আমরা পেয়েছি, যার সর্বশেষ মুস্তাফিজ। মুস্তাফিজ আমাদের বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে, আস্তাকুঁড়ে থেকেও রাজপুত্র হওয়া যায়। আমি রাজপুত্র দেখিনি-মুস্তাফিজ আমার রাজপুত্র। শুধু ক্রিকেটের মধ্যে আটকে থাকলে হবে না, তরুণদের মধ্যে থেকে এমন অনেক অনেক বীরকে খুঁজে বের করতে হবে, রাষ্ট্রকে তাদের মাথায় বীরের মুকুট পরিয়ে দিতে হবে, রাষ্ট্রকে তাদের পরম যতেœ লালন করতে হবে, যা কোটি তরুণকে স্বপ্নের সিঁড়িতে পা দিতে সাহস যোগাবে। আমাদের রাষ্ট্র সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সব তরুণকে সমান সুযোগ নিয়ে বেড়ে উঠতে সুযোগ দিতে হবে। ক্ষমতার বলয় টিকিয়ে রাখার জন্য তারা আর ঢাল হয়ে থাকবে না।