উচ্চশিক্ষায় কমছে বাংলাচর্চা
- আপলোড টাইম : ০৯:২৪:১৬ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
- / ১৪২ বার পড়া হয়েছে
জ্ঞানার্জনের মাধ্যম হোক মাতৃভাষা
বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে মাতৃভাষার জন্য অনেক কিছু করলেও গত কয়েক দশক ধরে সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়েছে বলেই মনে হয়। এ কথা বলার কারণ, দেশে উচ্চশিক্ষায় বাংলার চর্চা দিন দিন কমছে। এটি আমাদের জাতীয় জীবনে একটি বড় ব্যর্থতার নজির। অথচ সবার জানা, বিশ্বের কোনো দেশই মাতৃভাষার চর্চা না করে এগোতে পারেনি। যেমন জার্মান, ফরাসি, জাপানি, চীনা সবাই মাতৃভাষার মাধ্যমে জ্ঞানার্জন করেই আজ উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে। আমরাও মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষা ও প্রতিষ্ঠায় বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে রক্ত দিয়েছি। মূলত রক্তের বিনিময়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলা ভাষার মর্যাদা। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষায় জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে এ ভূখণ্ডের জাগতিক, মানসিক বিকাশ বা উন্নয়ন। কিন্তু বর্তমান অবস্থা একুশের চেতনার সাথে কতটুকু সঙ্গতিপূর্ণ সেই মূল্যায়ন হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
উচ্চশিক্ষায় বাংলার ব্যবহার বাড়াতে ২০১৭ সালে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস’ এবং ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ নামের দু’টি বিষয় যোগ করার সিদ্ধান্ত নেয় ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশন, ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কমপক্ষে দুই ক্রেডিট যাতে বিষয় দু’টি পড়ানো হয়, সেই নির্দেশনাও জারি করে ইউজিসি। কিন্তু বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই তা মানছে না। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র সাত-আটটিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে চার বছরের স্নাতক (সম্মান) কোর্স চালু রয়েছে। প্রতিটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগ থাকলেও বাংলা বিভাগ নেই। শিক্ষকরাও শ্রেণিকক্ষে ইংরেজিতে পাঠদান করেন। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, দেশের বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইংরেজিতে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিষয়েই এখনো পাঠদান হয় ইংরেজিতে। উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ রেফারেন্স বুক ইংরেজি। বাংলায় ভালোমানের বই পাওয়া দুষ্কর। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের পুরনো কিছু বিষয়ে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলায় লেখার সুযোগ রয়েছে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবই করতে হয় ইংরেজিতে। কিছু বিষয়ে দু-একটি বই যা-ও পাওয়া যায়, সেগুলো আক্ষরিক অনুবাদ। ফলে সেগুলোও তেমন কাজে আসে না। এতে করে উচ্চশিক্ষার মূল কাজ যে গবেষণা সেটি করতে গিয়ে বাংলা তথ্যসূত্র বইয়ের অভাবে শিক্ষার্থীরা গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। স্বাভাবিকভাবেই দেশে উচ্চশিক্ষা ঔৎকর্ষমণ্ডিত হচ্ছে না।
উচ্চশিক্ষায় বাংলার ব্যবহার নিশ্চিতকরণে মূল বাধা হয়ে আছে শুধু মাতৃভাষায় রেফারেন্স বইয়ের অভাবে। দেশে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই পড়ালেখা করে বাংলা মাধ্যমে। সেই শিক্ষার্থীরাই যখন উচ্চশিক্ষায় আসেন তখন বাংলা রেফারেন্স বইয়ের সঙ্কটে ভোগেন। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীকেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইংরেজি রেফারেন্স বুকের দ্বারস্থ হতে হয়। এতে অনেকেই প্রথম দিকে শিক্ষায় ঠিকমতো তাল মেলাতে পারেন না। দেশে এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৪৯ আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৭। বেশির ভাগই যেহেতু নতুন বিশ্ববিদ্যালয় এবং নতুন বিষয়, ফলে সেখানে বাংলার চর্চা খুব কম। আবার ইংরেজিভীতির কারণে অনেকেই ধার করা গবেষণাপত্র সামান্য পরিবর্তন করে নিজের বলে চালিয়ে দেন। যদিও বাংলাদেশে লাখ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় অধ্যয়নরত, তবু গবেষণা সীমাবদ্ধ থাকছে স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর মধ্যে। এ দিকে মেডিক্যাল, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বিভিন্ন বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পুরোপুরিই ইংরেজি রেফারেন্স বুকের ওপর নির্ভর করতে হয়। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নতুন বিষয়ের শিক্ষার্থীদের কাছেও ইংরেজি রেফারেন্স বুকের বিকল্প নেই।
সার্বিক দিক বিবেচনায়, অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, উচ্চশিক্ষায় বাংলার চর্চা বাড়াতে হলে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বই থাকতে হবে। এর জন্য বাংলায় মৌলিক বইয়ের পাশাপাশি অনেক অনুবাদ গ্রন্থ প্রণয়ন করতে হবে। চীন, জাপান, কোরিয়া এ ধরনের কাজ বিপুল পরিমাণে করেছে। আমাদেরও তা করতে হবে। এ খাতে সরকারকে বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে। তবেই উচ্চশিক্ষায় মাতৃভাষার চর্চা বাড়বে, যার ধারাবাহিকতায় অর্জন করা সম্ভব হবে কাক্সিক্ষত বৈষয়িক উন্নতি।