ইপেপার । আজ শুক্রবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৫

৬ মাসে ১১৩ জন নিহত অরক্ষিত রেললাইনে

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:১৬:০৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ জানুয়ারী ২০২১
  • / ১৪১ বার পড়া হয়েছে

আর কত মৃত্যু দেখতে হবে?
বাংলাদেশে রেললাইনে দুর্ঘটনা এবং এতে অপমৃত্যুর মিছিল দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরপরই এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও লোকদেখানো কিছু তদন্তের পরে এর প্রতিবেদন সাধারণত প্রকাশ পায় না। প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও কার্যক্রম বাস্তবায়িত হওয়া দূরের কথা। এ দিকে অরক্ষিত রেলপথে ও খোলা গেটে ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সর্বাধিক প্রয়োজন এ ধরনের দুর্ঘটনার হ্রাস করার জন্য কার্যকর ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ অবিলম্বে গ্রহণ করা। তা নিতে দেখা যায় না সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের।
গত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি জয়পুরহাট সদরের একটি লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেন-বাস ভয়াবহ সংঘর্ষে ১২ জন নিহত হন। দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পাওয়ায় সেখানে গেটম্যান বরখাস্ত হয়েছেন। জানা যায়, ক্রসিংটির গেট ছিল খোলা এবং গেটম্যান তখন ছিলেন ঘুমিয়ে। এ দুর্ঘটনার পরপর যথারীতি কমিটি গঠিত হয়েছে তদন্তের নামে। একই দিন নরসিংদী স্টেশনে এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে এক কিশোর নিহত হয়েছে। পুলিশের বক্তব্য, সে রেললাইনে বসে গান শুনছিল ইয়ারফোনে। এর সপ্তাহখানেক আগে, ৮ ডিসেম্বর বগুড়ার সান্তাহার জংশনে বড় দুর্ঘটনার কবল থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেল দিনাজপুরগামী একটি আন্তঃনগর ট্রেন। এটি রেলগেটের কাছাকাছি আসার পর গেট খোলা পেয়ে অর্ধশত যান রেলগেট অঙ্গনে ঢুকে পড়ে। রেললাইনে এ সময়ে উঠে যায় একটি ট্রাক। তখন সামান্যের জন্য ট্রেনটি বেঁচে যায়। এ সময়ে গেটের দু’দিকের দুই গেটম্যানের একজনও হাজির ছিলেন না। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ লালমনিরহাটে একই ট্রেনে কাটা পড়েছিলেন জনৈক মোটরবাইক আরোহীসহ দু’জন। সে দিনেই নরসিংদীতে ক্রসিং পার হতে গিয়ে একজন প্রাণ হারান।
রেলসূত্রে জানা যায়, এ-জাতীয় দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে। দেশের রেলপথে লেভেলক্রসিং রয়েছে দুই হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে বৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা এক হাজার ৪০০ এবং অনুমোদনবিহীন ক্রসিং আছে এক হাজার ১৪১টি। তবে এগুলোর মাত্র ৪৬৬টি গেটে আছেন গেটম্যান। বাকি সব লেভেলক্রসিং মৃত্যুফাঁদে পর্যবসিত হয়েছে। অবশ্য অনেক জায়গায় গেটম্যান থাকলেও দায়িত্বে অবহেলাসহ কিছু কারণে মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন কিংবা চিরতরে হয়ে যাচ্ছেন পঙ্গু। কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রেলপথ দিয়ে যাতায়াত, রেললাইনে বাজার বা দোকান বসানো, পাশের অবৈধ স্থাপনার দরুন ট্রেন চোখে না পড়া, রেলট্র্যাকে প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পাদন, কানে হেডফোন বা মোবাইল লাগিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটা প্রভৃতি।
২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র তিন বছরে কানে হেডফোন লাগানো ৪৩০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে রেললাইন থেকে। রেলওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকার রেললাইনে মোট প্রাণহানির ৫ শতাংশ আত্মহত্যা, ১০ শতাংশ অসুস্থতাজনিত, ৫ শতাংশ হত্যাসহ নানা কারণে এবং ৮০ শতাংশই অসতর্কতাবশত। আইন মোতাবেক, রেললাইন এবং এ লাইনের দু’পাশের ২০ ফুট জায়গায় নির্ধারিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো, এমনকি কোনো পশুরও প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই স্থানে সর্বদাই ১৪৪ ধারা জারি করা থাকে। এখানে কেউ বিধি লঙ্ঘন করলে তাকে গ্রেফতার করা যায়। তবে খোদ রাজধানীতেই রেলপথে সবসময় কয়েক শত মানুষকে হাঁটতে দেখা যায়। প্রতিদিনের বাজার, খেলাধুলা, আড্ডা দেয়া, মেয়েদের মাথার উকুন বাছা প্রভৃতি অবাধে করা হয় রেলট্র্যাকের উপরেই। লাইনের পাশেই আছে দোকান ও বস্তিসহ অসংখ্য স্থাপনা। বিগত এক দশকে অন্তত অর্ধশত প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও রেলপথ নিরাপদ হয়নি। এর সেবার মানও বাড়েনি। জানা গেছে, সব দেশেই কঠোরভাবে মেনে চলা হয় রেললাইনের বিধিনিষেধ।
আমরা মনে করি, বিশেষত ঢাকা অঞ্চলের লেভেলক্রসিংগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, গেটম্যান বাড়িয়ে তাদের শিফট ডিউটির পদক্ষেপ, গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলোতে আন্ডারপাস নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু ও নিরাপদ করা, অন্তত নারায়ণগঞ্জ-টঙ্গী রুটকে আন্ডারগ্রাউন্ড করা প্রভৃতি উদ্যোগ নেয়া হলে রেললাইনে প্রাণহানি অনেক কমে যাবে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

You cannot copy content of this page

৬ মাসে ১১৩ জন নিহত অরক্ষিত রেললাইনে

আপলোড টাইম : ০৯:১৬:০৩ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ জানুয়ারী ২০২১

আর কত মৃত্যু দেখতে হবে?
বাংলাদেশে রেললাইনে দুর্ঘটনা এবং এতে অপমৃত্যুর মিছিল দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরপরই এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও লোকদেখানো কিছু তদন্তের পরে এর প্রতিবেদন সাধারণত প্রকাশ পায় না। প্রয়োজনীয় সুপারিশ ও কার্যক্রম বাস্তবায়িত হওয়া দূরের কথা। এ দিকে অরক্ষিত রেলপথে ও খোলা গেটে ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ সর্বাধিক প্রয়োজন এ ধরনের দুর্ঘটনার হ্রাস করার জন্য কার্যকর ও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ অবিলম্বে গ্রহণ করা। তা নিতে দেখা যায় না সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের।
গত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি জয়পুরহাট সদরের একটি লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেন-বাস ভয়াবহ সংঘর্ষে ১২ জন নিহত হন। দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পাওয়ায় সেখানে গেটম্যান বরখাস্ত হয়েছেন। জানা যায়, ক্রসিংটির গেট ছিল খোলা এবং গেটম্যান তখন ছিলেন ঘুমিয়ে। এ দুর্ঘটনার পরপর যথারীতি কমিটি গঠিত হয়েছে তদন্তের নামে। একই দিন নরসিংদী স্টেশনে এক্সপ্রেস ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে এক কিশোর নিহত হয়েছে। পুলিশের বক্তব্য, সে রেললাইনে বসে গান শুনছিল ইয়ারফোনে। এর সপ্তাহখানেক আগে, ৮ ডিসেম্বর বগুড়ার সান্তাহার জংশনে বড় দুর্ঘটনার কবল থেকে অল্পের জন্য রক্ষা পেল দিনাজপুরগামী একটি আন্তঃনগর ট্রেন। এটি রেলগেটের কাছাকাছি আসার পর গেট খোলা পেয়ে অর্ধশত যান রেলগেট অঙ্গনে ঢুকে পড়ে। রেললাইনে এ সময়ে উঠে যায় একটি ট্রাক। তখন সামান্যের জন্য ট্রেনটি বেঁচে যায়। এ সময়ে গেটের দু’দিকের দুই গেটম্যানের একজনও হাজির ছিলেন না। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ লালমনিরহাটে একই ট্রেনে কাটা পড়েছিলেন জনৈক মোটরবাইক আরোহীসহ দু’জন। সে দিনেই নরসিংদীতে ক্রসিং পার হতে গিয়ে একজন প্রাণ হারান।
রেলসূত্রে জানা যায়, এ-জাতীয় দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৮৯ শতাংশই অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ে। দেশের রেলপথে লেভেলক্রসিং রয়েছে দুই হাজার ৫৪১টি। এর মধ্যে বৈধ ক্রসিংয়ের সংখ্যা এক হাজার ৪০০ এবং অনুমোদনবিহীন ক্রসিং আছে এক হাজার ১৪১টি। তবে এগুলোর মাত্র ৪৬৬টি গেটে আছেন গেটম্যান। বাকি সব লেভেলক্রসিং মৃত্যুফাঁদে পর্যবসিত হয়েছে। অবশ্য অনেক জায়গায় গেটম্যান থাকলেও দায়িত্বে অবহেলাসহ কিছু কারণে মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছেন কিংবা চিরতরে হয়ে যাচ্ছেন পঙ্গু। কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রেলপথ দিয়ে যাতায়াত, রেললাইনে বাজার বা দোকান বসানো, পাশের অবৈধ স্থাপনার দরুন ট্রেন চোখে না পড়া, রেলট্র্যাকে প্রাকৃতিক ক্রিয়া সম্পাদন, কানে হেডফোন বা মোবাইল লাগিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটা প্রভৃতি।
২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র তিন বছরে কানে হেডফোন লাগানো ৪৩০টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে রেললাইন থেকে। রেলওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ঢাকার রেললাইনে মোট প্রাণহানির ৫ শতাংশ আত্মহত্যা, ১০ শতাংশ অসুস্থতাজনিত, ৫ শতাংশ হত্যাসহ নানা কারণে এবং ৮০ শতাংশই অসতর্কতাবশত। আইন মোতাবেক, রেললাইন এবং এ লাইনের দু’পাশের ২০ ফুট জায়গায় নির্ধারিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো, এমনকি কোনো পশুরও প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই স্থানে সর্বদাই ১৪৪ ধারা জারি করা থাকে। এখানে কেউ বিধি লঙ্ঘন করলে তাকে গ্রেফতার করা যায়। তবে খোদ রাজধানীতেই রেলপথে সবসময় কয়েক শত মানুষকে হাঁটতে দেখা যায়। প্রতিদিনের বাজার, খেলাধুলা, আড্ডা দেয়া, মেয়েদের মাথার উকুন বাছা প্রভৃতি অবাধে করা হয় রেলট্র্যাকের উপরেই। লাইনের পাশেই আছে দোকান ও বস্তিসহ অসংখ্য স্থাপনা। বিগত এক দশকে অন্তত অর্ধশত প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও রেলপথ নিরাপদ হয়নি। এর সেবার মানও বাড়েনি। জানা গেছে, সব দেশেই কঠোরভাবে মেনে চলা হয় রেললাইনের বিধিনিষেধ।
আমরা মনে করি, বিশেষত ঢাকা অঞ্চলের লেভেলক্রসিংগুলো ডিজিটাল পদ্ধতিতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা, গেটম্যান বাড়িয়ে তাদের শিফট ডিউটির পদক্ষেপ, গুরুত্বপূর্ণ ক্রসিংগুলোতে আন্ডারপাস নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু ও নিরাপদ করা, অন্তত নারায়ণগঞ্জ-টঙ্গী রুটকে আন্ডারগ্রাউন্ড করা প্রভৃতি উদ্যোগ নেয়া হলে রেললাইনে প্রাণহানি অনেক কমে যাবে।