হুজুগে প্রতিবাদ ধর্ষণ কমায়নি
- আপলোড টাইম : ০৮:২৩:৩০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২১
- / ১৬২ বার পড়া হয়েছে
বিচার নিশ্চিত করা দরকার
‘হুজুগে বাঙালি’ বলে প্রচলিত কথাটি আমাদের ক্ষেত্রে সত্য প্রমাণ হচ্ছে। আমরা কোনো একটি সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের জন্য ধারাবাহিক চেষ্টা চালাই না। আমরা যেকোনো বিষয়ে জোরালো প্রতিবাদ শুরু করি কেবল হুজুগের বশে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ধর্ষণের ব্যাপকতা সর্বোচ্চ পৌঁছেছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে রাষ্ট্র, সরকার বা অন্য কেউ কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। তবে মাঝে মাঝে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো মানুষের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে। কিছু কিছু বীভৎস ধর্ষণ ঘটনার পর এমন বিক্ষোভ প্রতিবাদ হয়েছে। ওই সব প্রতিবাদ এ পর্যন্ত ঘটনার শিকার নারী ও শিশুদের খুব একটা উপকারে আসেনি। সরকার উপস্থিত কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেছে। যেমন গত বছর ধর্ষণের শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে।
নোয়াখালীতে আবারো এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করার ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়ে সন্তানদের সামনে বিবস্ত্র করে তাকে নির্যাতন করা হয়। পুরনো ধারায় সেই নির্যাতনের চিত্র মোবাইলে ধারণ করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভুক্তভোগী নিজে এই অভিযোগে মামলা করেছেন। এর আগে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ঘটনায় চার সন্তানের জননীকে গণধর্ষণ করার ঘটনা ঘটে। গত বছর আমরা দেখেছি আরেক নারীকে একইভাবে বিবস্ত্র করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এরপর সারা দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। একই দিনের পত্রিকায় আমরা দেখতে পাচ্ছি গৃহবধূ ও ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় অন্ততপক্ষে চারটি মামলা হয়েছে। ধর্ষণের পাশবিকতা এবং সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, মানুষ এখন প্রতিবাদ বিক্ষোভ করার চেতনাও হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি একটি জাতির জন্য অশনিসঙ্কেত।
বিবস্ত্র করে নির্যাতন করার ঘটনাটি ঘটেছে নোয়াখালীর হাতিয়ায়। স্বামীর অনুপস্থিতির সুযোগে স্থানীয় সন্ত্রাসীরা দলবেঁধে তার ওপর নির্যাতন চালায়। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে এক নারীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে এক নারীকে একই ধরনের গণধর্ষণ করা হয়েছে। যশোরের ঝিকরগাছায় দশম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে এক দুর্বৃত্ত। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে নবম শ্রেণীর এক ছাত্রীকে ধর্ষণের মামলা করা হয়েছে। এমন গর্হিত কাজ যখন করা হয় তখন অপরাধীরা কোনো ধরনের ভীতি অনুভব করছে না। প্রত্যেক দিন পত্রিকার পাতায় একই ধরনের ধর্ষণের ঘটনা আমরা দেখতে পাই। গড়ে প্রতিদিন তিন-চারটি ঘটনায় মামলা হতে দেখা যায়। প্রকৃত ধর্ষণ ঘটনার তুলনায় মামলা করার হার নেহাতই কম।
বাংলাদেশের উচ্চহারে ধর্ষণের কারণ জানতে সহায়ক হতে পারে। বগুড়ার শ্রমিক লীগ নেতা তুফান সরকারের কথা সচেতন মানুষের মনে থাকার কথা। সরকারি দলের প্রভাবশালী তুফান এক ছাত্রীকে ধর্ষণ করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। তার জেরে তুফানের স্ত্রী ও বড় বোন ওই ‘ধর্ষিতা’ মেয়ে ও তার মাকে এনে নির্যাতন করে মাথা ন্যাড়া করে দেয়। ওই ঘটনাটি ২০১৭ সালে সারা দেশের মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে। ‘ধর্ষণের’ শিকার হওয়ার পর বিচার পাওয়ার পরিবর্তে উল্টো জুটেছে ভয়াবহ অপমান ও নির্যাতন। রোববার ওই মামলার শুনানিতে দেখা যায়, ‘ধর্ষিত’ মেয়েটি ও তার মা বলছেন, তুফানের বিরুদ্ধে তাদের কোনো অভিযোগ নেই। আদালতে তারা বলছেন, ঘটনার স্থান কাল কিছুই তারা জানে না। কোনো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। এমনকি মামলার এজাহারে বর্ণিত অভিযোগ সত্য নয়। আদালত এ মামলায় তুফানের জামিন মঞ্জুর করেছেন।
আদালত উপস্থিত সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বিচার করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, ২০১৭ সালে ওই মেয়েটির ‘ধর্ষণের’ ঘটনা, তার প্রতিক্রিয়ায় মাথা ন্যাড়া করে অপমান করার ঘটনা যা সারা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে সেটি কি পুরোটাই মিথ্যা? নাকি তুফান সরকারদের ক্ষমতার দাপটের কাছে সব হার মানছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও কঠিন কোনো আইন করা হলে সেটি কি কাজে আসবে যদি প্রকৃত অপরাধীদের বিচারে দোষি সাব্যস্ত না করা যায়। প্রতিদিনকার উচ্চহারে ঘটে চলা ধর্ষণ ঠেকাতে হলে ‘হুজুগে প্রতিবাদ বিক্ষোভ নয়’ বরং আমাদের বিচারের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর হতে হবে।