ইপেপার । আজ শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪

অস্বিত্ব সংকটে চুয়াডাঙ্গার একমাত্র ঐতিহ্যবাহী নদী মাথাভাঙ্গা : দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর অস্তিত্ব রক্ষায় নদীটি পূণর্খননের দাবী

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৫:৫১:৫০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ মার্চ ২০১৭
  • / ৮৭৪ বার পড়া হয়েছে

নূরুল আলম বাকু: প্রতিকুল পরিবেশ, নানা অনিয়ম ও সংশ্লিষ্টদের অবহেলায় অস্বিত্বসংকটে পড়ে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার একমাত্র স্রোতস্বীনি নদী মাথাভাঙ্গা। এ জেলার নদীর গতি যেমন বিচিত্র তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। পদ্মা নদীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা মাথাভাঙ্গা নদী চুয়াডাঙ্গা জেলার জেলার আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা সদর ও দামুড়হুদা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দামুড়হুদা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম সুলতানপুরের পাশ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। ভারতে প্রবেশ করে এ নদীর নাম হয়েছে চুর্ণী। এছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূল নদী ভৈরব-কপোতাক্ষের চাবিকাঠি হলো এই মাথাভাঙ্গা। এই মাথাভাঙ্গা নাব্যতা হারানোর সাথে সাথে ভৈরব-কপোতাক্ষের মৃত্যুও ত্বরান্বিত হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চল ক্রমান্বয়ে পরিনত হচ্ছে মরুভূমিতে। মাথাভাঙ্গা নদীটি ড্রেজিং করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে ভৈরবের উৎসমুখ খুলে দিলেই তার শাখা কপোতাক্ষসহ এ অঞ্চলের সব নদী তাদের হারানো গতি ফিরে পাবে। এ অঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিনত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে মৃতপ্রায় এ নদীটি পূণঃর্খননের দাবী ।
জানা গেছে, মাথাভাঙ্গা পদ্মা নদীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। অবিভক্ত ভারতের পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার প্রধান তিনটি নদীর মধ্যে মাথাভাঙ্গা ছিল মুখ্য। মাথাভাঙ্গা নদীয়ার নদী হিসেবেই পরিচিত। এ নদী একসময় খুব স্রোতস্বিনী ছিল। জনশ্রুতি আছে, বহু বছর আগে উৎস্যমুখে মুল নদী পদ্মার সাথে সংযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়া অর্থাৎ মাথা বা মুখ ভেঙ্গে যাওয়ায় নদীটির এরূপ নামকরণ হয়েছে। তবে কোন এক সময় এ নদীটি হাওলিয়া বা হাওলী নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬২ সালে তৎকালীন পূর্ববাংলার সাথে কলকাতার রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মাথাভাঙ্গা নদীপথেই কলকাতার সাথে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল। বড় বড় নৌকায় করে নানরকম পণ্য অনা নেওয়া করা হতো। পদ্মা নদী থেকে জলঙ্গী নদীর উৎপত্তি স্থানের প্রায় ১৭ কিলোমিটার ভাটিতে মাথাভাঙ্গা নদীর উৎপত্তি। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটবোয়ালিয়া ও হাটুভাঙ্গা গ্রামের মাঝ দিয়ে মাথাভাঙ্গা নদী এ জেলায় প্রবেশ করেছে। প্রবেশ করে কিছুদুর আসার পর এ নদীর একটি শাখা বের হয়ে কুমার নদী নামে পুর্বদিকে বয়ে গেছে। মাথাভাঙ্গা নদী চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ২৬টি এবং দামুড়হুদা উপজেলার ১৫টি গ্রাম পেরিয়ে দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম সুলতানপুরের পাশ দিয়ে ভারতের নদীয়া জেলায় প্রবেশ করেছে। ভারতে মাথাভাঙ্গা নদী চুর্ণী নদী নামে পরিচিত। এরপর এ জেলার ১০-১২ টি গ্রাম পেরিয়ে ভাগিরথীর সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মুলতঃ গঙ্গা ও পদ্মার প্রবাহের উপর এতদাঞ্চলের নদীর নাব্যতা নির্ভরশীল।
১৯৬৮-১৯৬৯ সালে ভারত গঙ্গার উপর ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মান করে এবং ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত ফারাক্কা চালু করে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহারের ফলে অব্যাহতভাবে পদ্মার পানি প্রবাহ কমতে থাকে। ফলে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে মাথাভাঙ্গার উপরও। সেই থেকে মাথাভাঙ্গায় ক্রমান্বয়ে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় পলি পড়ে ভরাট হতে থাকে নদীটির তলদেশ। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলার কারনে মাথাভাঙ্গা এখন মৃতপ্রায় হয়ে খালের আকার ধারন করেছে। ফাল্গুন চৈত্র মাসে নদীর পানি এত কমে যায় যে, কোন কোন জায়গায় পানি প্রবাহের উচ্চতা থাকে মাত্র হাটু সমান। তারপরও এক শ্রেনির বিবেকহীন মানুষ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে, কোমর ঘিরে ও জোংড়া পেতে মাছ শিকার করছে। তাতে নদীর স্বাভাবিক স্রোতধারা বাধাগ্রস্থ হওয়ার ফলে নদী তলদেশ ভরাট হয়ে ত্বরান্বিত হচ্ছে নদীর অকাল মৃত্যু।
নদীতে কোমর ঘিরে ও জোংড়া পেতে মাছ শিকারের ব্যাপারে দামুড়হুদা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, মাছের প্রজনন ঋতু চলছে। বর্তমানে নদীর বিভিন্ন পযেন্টে কোমর ঘেরার ফলে মাছের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে। মাছের বংশ বৃদ্ধিতে এ পদ্ধতি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু সরেজমিনে নদীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, মাছ শিকারীরা ঘুণি জাল দিয়ে কোমর ঘিরে এমনভাবে মাছ শিকার করছে তাতে মাছের ছোটছোট পোনা থেকে ডিম পর্যন্ত উঠে আসছে। তাতে মাছের মাছের বংশবৃদ্ধি তো দুরের কথা প্রকৃতপক্ষে মাছের বংশ ধ্বংশ হচ্ছে। এছাড়াও নদীর দু’ধারে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় তার সাথে অনেক জায়গায় এক শ্রেনির মানুষ দুই পাড়ের মাটি কেটে সমান করে সেখানে নানারকম ফসলের আবাদ করছে। ফলে তাতে হাতে গোনা কিছু মানুষ উপকৃত হলেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠি। বছরের পর বছর এ অবস্থা চলতে থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। বিগত মেয়াদের সরকারের আমলে বেশ কয়েকবার এ নদীটি পূনঃর্খননের কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত তার কোন আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
সুত্রে জানা গেছে, বহু বছর আগে এ নদীর তীর ঘেঁসে গড়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার একটি বিশাল জনপদ। এই নদীকে ঘিরেই এক সময় এ বিশাল জনপদের একটি উল্লে¬খযোগ্য অংশ নির্বাহ করতো তাদের জীবন-জীবিকা। এ নদীতে মাছ শিকার করে দুই পাড়ের হাজার হাজার মানুষ নিজেদের মাছের চাহিদা মেটাতো। অপরদিকে যে জেলে সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ এ নদীতে মাছ শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। বর্তমানে নদীতে পানি না থাকায় মাছ ধরতে না পেরে তাদের অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। আবার অনেকে কর্মহীন হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করছেন।
একসময় এ নদীর পানিই ছিল এ অঞ্চলের নদীতীরের কৃষকদের সেচের একমাত্র অবলম্বন। এ নদীর পানি ব্যাবহার করে কৃষকরা শুস্ক মৌসুমে নদীর দুই পাড়ের শত শত বিঘা জমিতে নানারকম ফসল ফলাতো। পানি প্রবাহের অভাবে বছরের পর বছর পলি পড়ে বর্তমানে নদীটি তার ঐতিহ্য হারিয়ে পরিনত হয়েছে মরা খালে। বর্তমানে ফসলের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য শত শত গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও সেইসাথে ফসলে সেচ দেওয়ার জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে অনবরত পানি তোলার ফলে প্রতি বছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকহারে নিচে নেমে যাচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর। ফলে এলাকা ক্রমান্বয়ে পরিনত হচ্ছে মরুভূমিতে। যার কারনে চুয়াডাঙ্গা জেলায় বেশিরভাগ সময় শীতকালে সর্বনি¤œ ও গ্রীষ্মকালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করে।
শুষ্ক মৌসুমে যন্ত্রচালিত সেচযন্ত্রেও পানি ঠিকমতো ওঠে না। ফলে ফসল উৎপাদনে সেচের জন্য তুলনামুলকভাবে বেশি খরচ গুনতে হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শুস্ক মৌসুমের আগেই বিল-বাওড়, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা শুকিয়ে যাওয়ায় টিউবয়েলেও পানি উঠছে না। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। সেইসাথে ধ্বংস হচ্ছে এলাকার জীববৈচিত্র। প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যে হারে নিচে নামছে তাতে হয়তো সেদিন আর বেশি দুরে নয় যেদিন ফসলে সেচের পানির জন্য কৃষককে চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে হবে।
এছাড়াও ভৈরব-কপোতাক্ষ হলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূল নদী কাঠামো এবং মাথাভাঙ্গা তার উৎসমুখ। এ নদীটি ড্রেজিং করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে ভৈরবের উৎসমুখ খুলে দিলেই তার শাখা কুমার, কপোতাক্ষ, ভৈরবসহ এ অঞ্চলের সব নদ-নদী তাদের হারানো গতি ফিরে পাবে। তাই নদীটি বাঁচাতে বর্তমানের সমস্ত অনিয়ম দুর করে এবং অবিলম্বে পূণর্খননে এর নাব্যতা ফেরানোর কোন বিকল্প নেই। এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হলে কয়েক দশকে এতদাঞ্চলের মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে মাথাভাঙ্গা, কুমার, ভৈরব, কপোতাক্ষ নামের এ ঐতিহ্যবাহী নদ-নদীগুলো এমন অভিমত অনেকের।
সচেতনমহল মনে করেন, মৃতপ্রায় এ নদীটির পূণর্খনন এখন সময়ের দাবী। এক সময়ের খরস্রোতা ও যৌবনবতী বর্তমানে মৃতপ্রায় এ নদীটি পূণর্খনন করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চালের ঐতিহ্যবাহী নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক স্রোতধারা চালু করে এতদাঞ্চলের আর্থসামজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা হোক এমনটাই দাবী এ অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

অস্বিত্ব সংকটে চুয়াডাঙ্গার একমাত্র ঐতিহ্যবাহী নদী মাথাভাঙ্গা : দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর অস্তিত্ব রক্ষায় নদীটি পূণর্খননের দাবী

আপলোড টাইম : ০৫:৫১:৫০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৮ মার্চ ২০১৭

নূরুল আলম বাকু: প্রতিকুল পরিবেশ, নানা অনিয়ম ও সংশ্লিষ্টদের অবহেলায় অস্বিত্বসংকটে পড়ে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার একমাত্র স্রোতস্বীনি নদী মাথাভাঙ্গা। এ জেলার নদীর গতি যেমন বিচিত্র তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ। পদ্মা নদীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা মাথাভাঙ্গা নদী চুয়াডাঙ্গা জেলার জেলার আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা সদর ও দামুড়হুদা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দামুড়হুদা উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী গ্রাম সুলতানপুরের পাশ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। ভারতে প্রবেশ করে এ নদীর নাম হয়েছে চুর্ণী। এছাড়াও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূল নদী ভৈরব-কপোতাক্ষের চাবিকাঠি হলো এই মাথাভাঙ্গা। এই মাথাভাঙ্গা নাব্যতা হারানোর সাথে সাথে ভৈরব-কপোতাক্ষের মৃত্যুও ত্বরান্বিত হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চল ক্রমান্বয়ে পরিনত হচ্ছে মরুভূমিতে। মাথাভাঙ্গা নদীটি ড্রেজিং করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে ভৈরবের উৎসমুখ খুলে দিলেই তার শাখা কপোতাক্ষসহ এ অঞ্চলের সব নদী তাদের হারানো গতি ফিরে পাবে। এ অঞ্চলকে মরুভূমিতে পরিনত হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে মৃতপ্রায় এ নদীটি পূণঃর্খননের দাবী ।
জানা গেছে, মাথাভাঙ্গা পদ্মা নদীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শাখা। অবিভক্ত ভারতের পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার প্রধান তিনটি নদীর মধ্যে মাথাভাঙ্গা ছিল মুখ্য। মাথাভাঙ্গা নদীয়ার নদী হিসেবেই পরিচিত। এ নদী একসময় খুব স্রোতস্বিনী ছিল। জনশ্রুতি আছে, বহু বছর আগে উৎস্যমুখে মুল নদী পদ্মার সাথে সংযোগ নষ্ট হয়ে যাওয়া অর্থাৎ মাথা বা মুখ ভেঙ্গে যাওয়ায় নদীটির এরূপ নামকরণ হয়েছে। তবে কোন এক সময় এ নদীটি হাওলিয়া বা হাওলী নামে পরিচিত ছিল। ১৮৬২ সালে তৎকালীন পূর্ববাংলার সাথে কলকাতার রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মাথাভাঙ্গা নদীপথেই কলকাতার সাথে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল। বড় বড় নৌকায় করে নানরকম পণ্য অনা নেওয়া করা হতো। পদ্মা নদী থেকে জলঙ্গী নদীর উৎপত্তি স্থানের প্রায় ১৭ কিলোমিটার ভাটিতে মাথাভাঙ্গা নদীর উৎপত্তি। চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটবোয়ালিয়া ও হাটুভাঙ্গা গ্রামের মাঝ দিয়ে মাথাভাঙ্গা নদী এ জেলায় প্রবেশ করেছে। প্রবেশ করে কিছুদুর আসার পর এ নদীর একটি শাখা বের হয়ে কুমার নদী নামে পুর্বদিকে বয়ে গেছে। মাথাভাঙ্গা নদী চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ২৬টি এবং দামুড়হুদা উপজেলার ১৫টি গ্রাম পেরিয়ে দামুড়হুদা উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম সুলতানপুরের পাশ দিয়ে ভারতের নদীয়া জেলায় প্রবেশ করেছে। ভারতে মাথাভাঙ্গা নদী চুর্ণী নদী নামে পরিচিত। এরপর এ জেলার ১০-১২ টি গ্রাম পেরিয়ে ভাগিরথীর সাথে মিশে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মুলতঃ গঙ্গা ও পদ্মার প্রবাহের উপর এতদাঞ্চলের নদীর নাব্যতা নির্ভরশীল।
১৯৬৮-১৯৬৯ সালে ভারত গঙ্গার উপর ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মান করে এবং ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত ফারাক্কা চালু করে শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহারের ফলে অব্যাহতভাবে পদ্মার পানি প্রবাহ কমতে থাকে। ফলে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে মাথাভাঙ্গার উপরও। সেই থেকে মাথাভাঙ্গায় ক্রমান্বয়ে পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় পলি পড়ে ভরাট হতে থাকে নদীটির তলদেশ। দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলার কারনে মাথাভাঙ্গা এখন মৃতপ্রায় হয়ে খালের আকার ধারন করেছে। ফাল্গুন চৈত্র মাসে নদীর পানি এত কমে যায় যে, কোন কোন জায়গায় পানি প্রবাহের উচ্চতা থাকে মাত্র হাটু সমান। তারপরও এক শ্রেনির বিবেকহীন মানুষ নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে, কোমর ঘিরে ও জোংড়া পেতে মাছ শিকার করছে। তাতে নদীর স্বাভাবিক স্রোতধারা বাধাগ্রস্থ হওয়ার ফলে নদী তলদেশ ভরাট হয়ে ত্বরান্বিত হচ্ছে নদীর অকাল মৃত্যু।
নদীতে কোমর ঘিরে ও জোংড়া পেতে মাছ শিকারের ব্যাপারে দামুড়হুদা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, মাছের প্রজনন ঋতু চলছে। বর্তমানে নদীর বিভিন্ন পযেন্টে কোমর ঘেরার ফলে মাছের অভয়ারণ্যে পরিনত হয়েছে। মাছের বংশ বৃদ্ধিতে এ পদ্ধতি সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু সরেজমিনে নদীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, মাছ শিকারীরা ঘুণি জাল দিয়ে কোমর ঘিরে এমনভাবে মাছ শিকার করছে তাতে মাছের ছোটছোট পোনা থেকে ডিম পর্যন্ত উঠে আসছে। তাতে মাছের মাছের বংশবৃদ্ধি তো দুরের কথা প্রকৃতপক্ষে মাছের বংশ ধ্বংশ হচ্ছে। এছাড়াও নদীর দু’ধারে পলি পড়ে ভরাট হয়ে যাওয়ায় তার সাথে অনেক জায়গায় এক শ্রেনির মানুষ দুই পাড়ের মাটি কেটে সমান করে সেখানে নানারকম ফসলের আবাদ করছে। ফলে তাতে হাতে গোনা কিছু মানুষ উপকৃত হলেও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠি। বছরের পর বছর এ অবস্থা চলতে থাকলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেমন কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেই। বিগত মেয়াদের সরকারের আমলে বেশ কয়েকবার এ নদীটি পূনঃর্খননের কথা শোনা গেলেও আজ পর্যন্ত তার কোন আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
সুত্রে জানা গেছে, বহু বছর আগে এ নদীর তীর ঘেঁসে গড়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গা জেলার একটি বিশাল জনপদ। এই নদীকে ঘিরেই এক সময় এ বিশাল জনপদের একটি উল্লে¬খযোগ্য অংশ নির্বাহ করতো তাদের জীবন-জীবিকা। এ নদীতে মাছ শিকার করে দুই পাড়ের হাজার হাজার মানুষ নিজেদের মাছের চাহিদা মেটাতো। অপরদিকে যে জেলে সম্প্রদায়ের শত শত মানুষ এ নদীতে মাছ শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। বর্তমানে নদীতে পানি না থাকায় মাছ ধরতে না পেরে তাদের অনেকেই এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছে। আবার অনেকে কর্মহীন হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর অবস্থায় জীবনযাপন করছেন।
একসময় এ নদীর পানিই ছিল এ অঞ্চলের নদীতীরের কৃষকদের সেচের একমাত্র অবলম্বন। এ নদীর পানি ব্যাবহার করে কৃষকরা শুস্ক মৌসুমে নদীর দুই পাড়ের শত শত বিঘা জমিতে নানারকম ফসল ফলাতো। পানি প্রবাহের অভাবে বছরের পর বছর পলি পড়ে বর্তমানে নদীটি তার ঐতিহ্য হারিয়ে পরিনত হয়েছে মরা খালে। বর্তমানে ফসলের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য শত শত গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলা হচ্ছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ও সেইসাথে ফসলে সেচ দেওয়ার জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে অনবরত পানি তোলার ফলে প্রতি বছরই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকহারে নিচে নেমে যাচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর। ফলে এলাকা ক্রমান্বয়ে পরিনত হচ্ছে মরুভূমিতে। যার কারনে চুয়াডাঙ্গা জেলায় বেশিরভাগ সময় শীতকালে সর্বনি¤œ ও গ্রীষ্মকালে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করে।
শুষ্ক মৌসুমে যন্ত্রচালিত সেচযন্ত্রেও পানি ঠিকমতো ওঠে না। ফলে ফসল উৎপাদনে সেচের জন্য তুলনামুলকভাবে বেশি খরচ গুনতে হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শুস্ক মৌসুমের আগেই বিল-বাওড়, খাল-বিল, পুকুর-ডোবা শুকিয়ে যাওয়ায় টিউবয়েলেও পানি উঠছে না। ফলে শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় তীব্র পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। সেইসাথে ধ্বংস হচ্ছে এলাকার জীববৈচিত্র। প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর যে হারে নিচে নামছে তাতে হয়তো সেদিন আর বেশি দুরে নয় যেদিন ফসলে সেচের পানির জন্য কৃষককে চাতক পাখির মতো আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে হবে।
এছাড়াও ভৈরব-কপোতাক্ষ হলো দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মূল নদী কাঠামো এবং মাথাভাঙ্গা তার উৎসমুখ। এ নদীটি ড্রেজিং করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে ভৈরবের উৎসমুখ খুলে দিলেই তার শাখা কুমার, কপোতাক্ষ, ভৈরবসহ এ অঞ্চলের সব নদ-নদী তাদের হারানো গতি ফিরে পাবে। তাই নদীটি বাঁচাতে বর্তমানের সমস্ত অনিয়ম দুর করে এবং অবিলম্বে পূণর্খননে এর নাব্যতা ফেরানোর কোন বিকল্প নেই। এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হলে কয়েক দশকে এতদাঞ্চলের মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে মাথাভাঙ্গা, কুমার, ভৈরব, কপোতাক্ষ নামের এ ঐতিহ্যবাহী নদ-নদীগুলো এমন অভিমত অনেকের।
সচেতনমহল মনে করেন, মৃতপ্রায় এ নদীটির পূণর্খনন এখন সময়ের দাবী। এক সময়ের খরস্রোতা ও যৌবনবতী বর্তমানে মৃতপ্রায় এ নদীটি পূণর্খনন করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চালের ঐতিহ্যবাহী নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক স্রোতধারা চালু করে এতদাঞ্চলের আর্থসামজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা হোক এমনটাই দাবী এ অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের।