ইপেপার । আজ বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

পাল্টাপাল্টি অবস্থানে ইসি : উত্তাল রাজনীতির মাঠ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১১:১১:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ অগাস্ট ২০১৮
  • / ৬৩১ বার পড়া হয়েছে

ডেস্ক রিপোর্ট: আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে হঠাৎ করেই উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকে এই ব্যবস্থাটিতে আপত্তি জানিয়ে এক নির্বাচন কমিশনারের সভা বর্জনের পরই বিষয়টি ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’-তে পরিণত হয়। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি পাল্টাপাল্টি বিবৃতি ও বিরোধপূর্ণ অবস্থানে চলে যায় সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো। যদিও দিনব্যাপী চলা ওই বৈঠকে সিইসিসহ কমিশনের বেশিরভাগ সদস্য নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়ে মন্ত্রণালয়ে ভোটিংয়ের জন্য পাঠাতে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। এখন শুধু সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। ভোটিংয়ে এই প্রস্তাব চূড়ান্ত হলে এক তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএম ব্যবহারের ইচ্ছে রয়েছে কমিশনের।
এদিকে, সময় নেই বলে আরপিওতে নির্বাচনের আগে হাত না দেয়ার পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে হঠাৎ করেই সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ার বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেষকরাও। তাদের মতে, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের প্রধান এবং অন্যতম কাজ হলো দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু বর্তমান কমিশন এর উল্টোটাই করল। যেখানে বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল হুট করে ইভিএম ব্যবহার না করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে কমিশনের এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে বিষয়টি নিয়ে কমিশন বৈঠক বসে। আরপিও সংশোধন নিয়ে ২৬ আগস্ট কমিশনের প্রথম দফা বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। সেই মুলতবি বৈঠকই ছিল গতকাল। ওই সভায় কমিশনের পাঁচ সদস্যের পাশাপাশি কমিশন সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বৈঠক শুরুর আধা ঘণ্টা পরই ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সভা থেকে বেরিয়ে যান। পরে এক কর্মচারীর মাধ্যমে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পাঠিয়ে দেন কমিশনের কাছে।
সেখানে তিনি লিখেছেন, আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচনে ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ সমর্থন করি না। ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করছি। এই আপত্তির কারণ হিসেবে ইভিএম নিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং দক্ষ জনবলের অভাবের কথা বলেন মাহবুব তালুকদার। কমিশন সভার ২৬ আগস্টের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আরপিও সংশোধনে ইসি ওই বৈঠকে তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে বাংলা ভাষায় রূপান্তর, যা একজন পরামর্শক তৈরি করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইংরেজি আরপিওতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংশোধন, সংযোজন বা পরিমার্জন। আর সর্বশেষ প্রস্তাবটি ছিলÑ একাদশ সংসদ নির্বাচনে সময় স্বল্পতার কারণে ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন। কিন্তু কমিশন সভায় অন্য দুটি প্রস্তাব বাদ দিয়ে কেবল ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
মাহবুব তালুকদার বলেন, সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। এ অবস্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে ইভিএম ব্যবহারের কোনো সম্ভাবনা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে ইভিএম নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী। আর সিইসি প্রথম থেকেই বলে এসেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই কেবল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আরো আলোচনা করার কথা বলেন এই নির্বাচন কমিশনার।
নোট অব ডিসেন্টে তিনি লিখেছেন, শুরুতে স্থানীয়ভাবে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার হয়েছিল। এজন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার ইভিএম কেনায় আমি ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। সম্প্রতি ৩ হাজার ৮২১ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ইভিএম কেনা কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন মনে জাগে। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশন এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি। যে ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে বিনা টেন্ডারে কেনা হচ্ছে, তার কারিগরি বিষয় বুয়েট বা অনুরূপ কোনো সংস্থা থেকে যাচাই করা হয়নি। কারিগরি দিক থেকে এ যন্ত্র সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা তাও পরীক্ষা করা হয়নি।
আরপিওতে ইভিএম ব্যবহারের যে সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে তা ইতিমধ্যে নানা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে মন্তব্য করে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমি ধারণা করি, জনমত বা সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহƒত হলে তা নিয়ে আদালতে অসংখ্য মামলার সূত্রপাত হবে। অন্য কারণ ছাড়া কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বর্তমান ইসির পক্ষে এ ঝুঁকি নেয়া সঙ্গত হবে না নোট অব ডিসেন্টে সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনে কিছু বিশৃঙ্খলা এবং ইভিএম কেন্দ্র দখলের অভিযোগের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
কমিশন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার কমিশন বৈঠক বয়কট করলেও অপর কমিশনাররা বিকেল পর্যন্ত বৈঠক চালিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত ইভিএম ব্যবহারের লক্ষ্যে আরপিও সংশোধনের পক্ষে মত দিয়ে প্রস্তাব চূড়ান্ত করেন। পরে বিকেলে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা। তিনি আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলেন, আমরা স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছি। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরি করা যায় কিনা তা চেষ্টা করছি। ইভিএম ব্যবহারের পরিবেশ থাকলে তা আরপিওতে না থাকলে ব্যবহার করা যাবে না। এজন্য আমরা বিষয়টি আরপিওতে যুক্ত করেছি। এখন এটি সংসদে উত্থাপনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আইন হবে, স্টেকহোল্ডাররা দেখবেন। তারপর যদি পরিবেশ থাকে, তাহলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের দ্বিমতের বিষয়ে সিইসি বলেন, একজন নির্বাচন কমিশনার দ্বিমত করেছেন। কিন্তু, বাকি চার কমিশনার মত দিয়েছেন। তারা মনে করেন, ইভিএম ব্যবহার করলে ভালো হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ইভিএম ব্যবহার করা হয়। তবে এখনো আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান সিইসি।
এদিকে ইভিএম নিয়ে কমিশন বৈঠকের মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ অবস্থানে চলে যায়। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, বিবৃতি এমনকি নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সভা বর্জন নিয়েও সমালোচনায় মেতে ওঠেন অনেকে। মাহবুব তালুকদার বিএনপির লোক মন্তব্য করে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, সার্চ কমিটি গঠনের সময় বিএনপি মাহবুব তালুকদারের নাম দিয়েছিল। আমি মনে করি নির্বাচন কমিশনাররা সবাই দক্ষ ও নিরপেক্ষ। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠক করে। তাতে মতবিরোধ হতেই পারে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটিই চূড়ান্ত। সরকার সেটি মেনে নেবে। ইভিএম বিতর্ক নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ইভিএম ব্যবহার সরকারের নয়, ইসির সিদ্ধান্ত। পৃথিবীর এমন একটি দেশের নাম বলুন যেখানে নির্বাচন হওয়ার পর বিতর্ক ওঠেনি? বিএনপি এই নির্বাচন কমিশন গঠনের দিন থেকেই তার বিরোধিতা করছে। তারা যে কোনো ভালো কাজেরই বিরোধিতা করে, সমালোচনা করে।
বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপিও। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহারে কারচুপি করার সুযোগ থাকে। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যে কোনো সময় ফলাফল পাল্টে দেয়া যায়। তাই অনেক আগে থেকেই আমরা এর বিরোধিতা করে আসছি। দেশের সব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ বিশেষজ্ঞরা নির্বাচনে এটি ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছেন। কিন্তু হঠাৎ করে এমন কি ঘটল যে নির্বাচনের তিন মাস আগে ইভিএম কেনার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ যন্ত্রের ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসতে চায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, একটি পরিত্যক্ত পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার জন্য ৪ হাজার কোটি টাকার মেশিন কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। আমরা আহ্বান জানাব এই পথ থেকে ফিরে আসুন। তা না হলে এর প্রতিটি পয়সা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের দায় হিসেবে গণ্য হবে। এই ডিজিটাল কারচুপির পথ থেকে সরে আসুন। অন্যথায় প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে জবাবদিহিতা করতে হবে।
উল্লেখ্য, আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে বর্তমান কমিশনের আয়োজনেই একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। সেই সময় ঘনিয়ে আসায় আপাতত আর আরপিও সংস্কার করা হচ্ছে না বলেই জানিয়েছিলেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। কিন্তু কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধনের তোড়জোড় শুরু হয়। দেড় লাখ ইভিএম কিনতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবও তৈরি করেন ইসি কর্মকর্তারা।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

আজকের সমীকরণ ইপেপার

পাল্টাপাল্টি অবস্থানে ইসি : উত্তাল রাজনীতির মাঠ

আপলোড টাইম : ১১:১১:৫২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ অগাস্ট ২০১৮

ডেস্ক রিপোর্ট: আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে হঠাৎ করেই উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজনীতির মাঠ। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কমিশন বৈঠকে এই ব্যবস্থাটিতে আপত্তি জানিয়ে এক নির্বাচন কমিশনারের সভা বর্জনের পরই বিষয়টি ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’-তে পরিণত হয়। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি পাল্টাপাল্টি বিবৃতি ও বিরোধপূর্ণ অবস্থানে চলে যায় সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও সংসদের বাইরে থাকা বিএনপিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো। যদিও দিনব্যাপী চলা ওই বৈঠকে সিইসিসহ কমিশনের বেশিরভাগ সদস্য নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়ে মন্ত্রণালয়ে ভোটিংয়ের জন্য পাঠাতে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। এখন শুধু সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। ভোটিংয়ে এই প্রস্তাব চূড়ান্ত হলে এক তৃতীয়াংশ আসনে ইভিএম ব্যবহারের ইচ্ছে রয়েছে কমিশনের।
এদিকে, সময় নেই বলে আরপিওতে নির্বাচনের আগে হাত না দেয়ার পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে হঠাৎ করেই সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ার বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না রাজনৈতিক ও নির্বাচন বিশ্লেষকরাও। তাদের মতে, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনের প্রধান এবং অন্যতম কাজ হলো দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু বর্তমান কমিশন এর উল্টোটাই করল। যেখানে বিএনপিসহ বেশিরভাগ দল হুট করে ইভিএম ব্যবহার না করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, সেখানে কমিশনের এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
ইসি সূত্রে জানা গেছে, পূর্ব নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে বিষয়টি নিয়ে কমিশন বৈঠক বসে। আরপিও সংশোধন নিয়ে ২৬ আগস্ট কমিশনের প্রথম দফা বৈঠক কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়। সেই মুলতবি বৈঠকই ছিল গতকাল। ওই সভায় কমিশনের পাঁচ সদস্যের পাশাপাশি কমিশন সচিব, অতিরিক্ত সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বৈঠক শুরুর আধা ঘণ্টা পরই ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সভা থেকে বেরিয়ে যান। পরে এক কর্মচারীর মাধ্যমে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পাঠিয়ে দেন কমিশনের কাছে।
সেখানে তিনি লিখেছেন, আমি মনে করি, স্থানীয় নির্বাচনে ধীরে ধীরে ইভিএমের ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ সমর্থন করি না। ইভিএম ব্যবহারের বিষয়ে কমিশনের সিদ্ধান্তে ভিন্নমত পোষণ করে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ প্রদান করছি। এই আপত্তির কারণ হিসেবে ইভিএম নিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক বিরোধিতা এবং দক্ষ জনবলের অভাবের কথা বলেন মাহবুব তালুকদার। কমিশন সভার ২৬ আগস্টের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, আরপিও সংশোধনে ইসি ওই বৈঠকে তিন ধরনের প্রস্তাব উপস্থাপন করে। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে বাংলা ভাষায় রূপান্তর, যা একজন পরামর্শক তৈরি করে দিয়েছেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ইংরেজি আরপিওতে সুনির্দিষ্ট কিছু সংশোধন, সংযোজন বা পরিমার্জন। আর সর্বশেষ প্রস্তাবটি ছিলÑ একাদশ সংসদ নির্বাচনে সময় স্বল্পতার কারণে ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সংশোধন। কিন্তু কমিশন সভায় অন্য দুটি প্রস্তাব বাদ দিয়ে কেবল ইভিএম ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় সীমাবদ্ধ রাখা হয়।
মাহবুব তালুকদার বলেন, সরকারি দলের পক্ষ থেকে ইভিএম ব্যবহারকে স্বাগত জানানো হলেও প্রধান বিরোধী দলসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করে আসছে। এ অবস্থায় একাদশ সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার মাধ্যমে ইভিএম ব্যবহারের কোনো সম্ভাবনা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে ইভিএম নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের অবস্থান ছিল পরস্পরবিরোধী। আর সিইসি প্রথম থেকেই বলে এসেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সম্মত হলেই কেবল জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আরো আলোচনা করার কথা বলেন এই নির্বাচন কমিশনার।
নোট অব ডিসেন্টে তিনি লিখেছেন, শুরুতে স্থানীয়ভাবে পরীক্ষামূলকভাবে ইভিএম ব্যবহার হয়েছিল। এজন্য প্রায় ৫০ কোটি টাকার ইভিএম কেনায় আমি ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। সম্প্রতি ৩ হাজার ৮২১ কোটি টাকার প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার মুখে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার যেখানে অনিশ্চিত, সেখানে এ বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে ইভিএম কেনা কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্ন মনে জাগে। এছাড়া পরিকল্পনা কমিশন এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা যাচাই করেনি। যে ইভিএম বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি থেকে বিনা টেন্ডারে কেনা হচ্ছে, তার কারিগরি বিষয় বুয়েট বা অনুরূপ কোনো সংস্থা থেকে যাচাই করা হয়নি। কারিগরি দিক থেকে এ যন্ত্র সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত কিনা তাও পরীক্ষা করা হয়নি।
আরপিওতে ইভিএম ব্যবহারের যে সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে তা ইতিমধ্যে নানা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে মন্তব্য করে এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমি ধারণা করি, জনমত বা সর্বসম্মত রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে ইভিএম ব্যবহƒত হলে তা নিয়ে আদালতে অসংখ্য মামলার সূত্রপাত হবে। অন্য কারণ ছাড়া কেবল ইভিএম ব্যবহারের কারণেই সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। বর্তমান ইসির পক্ষে এ ঝুঁকি নেয়া সঙ্গত হবে না নোট অব ডিসেন্টে সাম্প্রতিক সিটি নির্বাচনে কিছু বিশৃঙ্খলা এবং ইভিএম কেন্দ্র দখলের অভিযোগের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
কমিশন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার কমিশন বৈঠক বয়কট করলেও অপর কমিশনাররা বিকেল পর্যন্ত বৈঠক চালিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত ইভিএম ব্যবহারের লক্ষ্যে আরপিও সংশোধনের পক্ষে মত দিয়ে প্রস্তাব চূড়ান্ত করেন। পরে বিকেলে বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নুরুল হুদা। তিনি আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলেন, আমরা স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছি। তাই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্র তৈরি করা যায় কিনা তা চেষ্টা করছি। ইভিএম ব্যবহারের পরিবেশ থাকলে তা আরপিওতে না থাকলে ব্যবহার করা যাবে না। এজন্য আমরা বিষয়টি আরপিওতে যুক্ত করেছি। এখন এটি সংসদে উত্থাপনের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। আইন হবে, স্টেকহোল্ডাররা দেখবেন। তারপর যদি পরিবেশ থাকে, তাহলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের দ্বিমতের বিষয়ে সিইসি বলেন, একজন নির্বাচন কমিশনার দ্বিমত করেছেন। কিন্তু, বাকি চার কমিশনার মত দিয়েছেন। তারা মনে করেন, ইভিএম ব্যবহার করলে ভালো হবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই ইভিএম ব্যবহার করা হয়। তবে এখনো আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে, এমন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান সিইসি।
এদিকে ইভিএম নিয়ে কমিশন বৈঠকের মধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলো পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ অবস্থানে চলে যায়। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, বিবৃতি এমনকি নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারের সভা বর্জন নিয়েও সমালোচনায় মেতে ওঠেন অনেকে। মাহবুব তালুকদার বিএনপির লোক মন্তব্য করে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, সার্চ কমিটি গঠনের সময় বিএনপি মাহবুব তালুকদারের নাম দিয়েছিল। আমি মনে করি নির্বাচন কমিশনাররা সবাই দক্ষ ও নিরপেক্ষ। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বৈঠক করে। তাতে মতবিরোধ হতেই পারে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তারা যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটিই চূড়ান্ত। সরকার সেটি মেনে নেবে। ইভিএম বিতর্ক নিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ইভিএম ব্যবহার সরকারের নয়, ইসির সিদ্ধান্ত। পৃথিবীর এমন একটি দেশের নাম বলুন যেখানে নির্বাচন হওয়ার পর বিতর্ক ওঠেনি? বিএনপি এই নির্বাচন কমিশন গঠনের দিন থেকেই তার বিরোধিতা করছে। তারা যে কোনো ভালো কাজেরই বিরোধিতা করে, সমালোচনা করে।
বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিএনপিও। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহারে কারচুপি করার সুযোগ থাকে। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে যে কোনো সময় ফলাফল পাল্টে দেয়া যায়। তাই অনেক আগে থেকেই আমরা এর বিরোধিতা করে আসছি। দেশের সব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ বিশেষজ্ঞরা নির্বাচনে এটি ব্যবহারের বিরোধিতা করে আসছেন। কিন্তু হঠাৎ করে এমন কি ঘটল যে নির্বাচনের তিন মাস আগে ইভিএম কেনার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ যন্ত্রের ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসতে চায় মন্তব্য করে তিনি বলেন, একটি পরিত্যক্ত পদ্ধতি ফিরিয়ে আনার জন্য ৪ হাজার কোটি টাকার মেশিন কেনার প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। আমরা আহ্বান জানাব এই পথ থেকে ফিরে আসুন। তা না হলে এর প্রতিটি পয়সা নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের দায় হিসেবে গণ্য হবে। এই ডিজিটাল কারচুপির পথ থেকে সরে আসুন। অন্যথায় প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে জবাবদিহিতা করতে হবে।
উল্লেখ্য, আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে বর্তমান কমিশনের আয়োজনেই একাদশ সংসদ নির্বাচন হবে। সেই সময় ঘনিয়ে আসায় আপাতত আর আরপিও সংস্কার করা হচ্ছে না বলেই জানিয়েছিলেন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। কিন্তু কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধনের তোড়জোড় শুরু হয়। দেড় লাখ ইভিএম কিনতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাবও তৈরি করেন ইসি কর্মকর্তারা।