ইপেপার । আজবৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

সংশয়ের ভোট আজ

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:২৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুলাই ২০১৮
  • / ৫৩৭ বার পড়া হয়েছে

ডেস্ক রিপোর্ট: বরিশাল-রাজশাহী-সিলেটে ভোটের আয়োজন সম্পন্ন। সব ঠিকঠাক থাকলে আজ সকালেই শুরু হবে তিন সিটিতে ভোট। কেমন হবে এই স্থানীয় নির্বাচন। ভোটাররা কী নির্বিঘে ভোট দিতে পারবে? ভোট কি আদৌ হবে? নাকি নিয়ন্ত্রিত ভোট করে দেশবাসীকে দেখানো হবে নির্বাচনী বায়স্কোপ? গতকালও বিএনপির নেতারা ইসির সঙ্গে দেখা করে ‘অনিয়মের’ এন্তাজ অভিযোগ তুলেছেন। এর কদিন আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করে দেশবাসীকে বার্তা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম। তিনি বলেছেন, ‘গাজীপুর ও খুলনাতে নির্বাচন হয়েছে গুড; তিন সিটিতে আরো বেটার নির্বাচন হবে’।
রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ভোটকে কেন্দ্র করে ধানের শীষ মার্কার মেয়র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার, ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বাচনী এলাকাগুলোয় ক্ষমতাসীনদের দাপট ও দৌরাত্ম্যের যে বীভৎস রূপ ফুটে উঠেছে তাতে ভোটাররা কী ভোট দিতে যাওয়ার আগ্রহী হবে? নাকি বাড়তি ঝামেলা এড়াতে সচেতনভাবে ঘরে বসে থাকবে? এই ভোটের আয়োজন যারা করছেন সেই নির্বাচন কমিশন কী সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন করার চেস্টা করবে? নাকি হৈমন্তি শুক্লার ‘চেয়ে দেয়ে দেখলাম তুমি চলে চলে/ তুমি চলে গেলে চেয়ে চেয়ে দেখলাম/ আমার বলার কিছু ছিল না’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে?
নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক বিতর্ক উঠলেই এক সময় ‘মাগুরা মার্কা নির্বাচন’ শব্দটি মানুষ উচ্চারণ করতেন। খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের নামে ‘বায়স্কোপ’ দেখানোয় মাগুরার দুর্নাম ধুঁইয়ে-মুছে গেছে। খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে মানুষ এখন ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার ‘ডিজিটাল সংস্করণ’ মনে করে। দুই সিটিতে ভৌতিক ভোট গ্রহণ এবং প্রকাশ্যে নির্বাচনের নামে জাল-জালিয়াতি অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে। এখন তিন সিটি তথা বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীর নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের মধ্যে প্রচারণা, উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার, ভয়ভীতি দেখানো, ধানের শীষের প্রার্থীদের ভোটারদের ভোট দেয়া নিয়ে সংশয়; নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের কত হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবেন আগেই সে ঘোষণা ভোটারদের মধ্যে ভীতি-আতঙ্ক-উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তরুণ ভোটারদের করছে নিরুস্বাহিত।
সরেজমিন খবর হলো গ্রেফতার আতঙ্কে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর বেশির ভাগ নির্বাচনী অফিস কয়েকদিন আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারলেও তার কর্মী সমর্থকরা সেটা পারেননি। পথে বের হলেই তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রেফতার করা হয়। গতকাল মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন বিএনপির ২৪ জন পোলিং এজেন্টকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ভোটারদের বাড়িবাড়ি গিয়ে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, হুমকি দিয়ে আসছে। এই হুমকিতেও কাজ না হওয়ায় পুলিশ দিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করানো হচ্ছে। এই নির্বাচনকে বিএনপি আন্দোলন হিসেবে নেয়ায় নেতাকর্মীদের কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বুলবুল বলেছেন, যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য বিএনপি প্রস্তুত।
বরিশালে ধানের শীষ প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার জানান, ভোটের আগের দিন গতকাল তিনি নিজে এবং কর্মীরা ভয়ে বের হননি। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে ইতোমধ্যে ৩৫ জন কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অসংখ্য কর্মী গ্রেফতার এড়াতে বরিশাল ত্যাগ করেছেন। তার অভিযোগ এসব শুধু প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহর কারণেই নয়, প্রশাসন নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করছে। প্রশাসন নৌকার প্রার্থীর কর্মীর ভূমিকায় নেমেছে। পুলিশের ভয়ে বিএনপির সক্রিয় কর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছে না। পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মধ্যরাতে হানা দিচ্ছে বাসায়। কাউকে উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে, কাউকে গালিগালাজ করা হচ্ছে কিংবা বাসায় না পেলে ভোট কেন্দ্রে না যাবার হুমকি দেয়া হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন নৌকার প্রার্থীর ব্যালটে সীল মারার জন্য বরিশাল নগরীর চারপাশে হাজার হাজার বহিরাগতদের জড়ো করা হয়েছে। ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আকস্মিক পৃথক সংবাদ সম্মেলন করেছেন আরো তিন মেয়র প্রার্থী।
ইসলামী ইন্দোলনের প্রাথী প্রিন্সিপ্যাল হাফেজ মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুব, বাসদের ডা. মনিষা চক্রবতী, ও ইকবাল হোসেন তাপস পৃথক পৃথকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে সিটি নির্বাচনের প্রশাসনের কার্যক্রমে সুষ্টু ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যদিও আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে ইসি থেকে শোকজ করা হয়েছে। সিলেটে প্রায় সব নির্বাচনে আছে স¤প্রীতির নজির। অতীতের নির্বাচনগুলোতে সংঘাত সহিংসতার ঘটনা তেমন ঘটেনি। কিন্তু এবার নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছেন। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে শুরু হয়েছে মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্ক। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী একাধিক দিন রাস্তায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। কর্মীদের ছাড়িয়ে নিতে থানায় ঘন্টার পর ঘন্টা অবস্থান নেন। তিনি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানির অভিযোগের পাশাপাশি পোলিং এজেন্টকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়রানি করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। ভোটের আগের দিন ধানের শীষ প্রতীকের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন সমন্বয়কারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নির্বাচন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন মিডিয়ার যে সব সংবাদকর্মী তিনি সিটিকে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন সিটিতেই নির্বাচনী এলাকায় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের জন্য ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। যার কারণে ‘ভোট উৎসব’ কার্যত রুপ লাভ করেছে ভোট আতঙ্কে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীলদের নীরবতা আর প্রশাসনযন্ত্র, আইন শৃংখলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মারমুখী তৎপরতায় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর কর্মীরা ঘর ছাড়া। ভোটারদের মধ্যে শুরু হয়েছে উদ্বেগ-উৎকষ্ঠা। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়া না দেয়া নিয়ে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে সংশয়। অবস্থা এমন যে কী দরকার ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার! ভোট দিতে গিয়ে অযথা বিপদ ডেকে এনে লাভ কী? পুলিশ আগে বিএনপির নেতাকর্মী খুঁজতো এখন তারা ধানের শীষের ভোটারদেরও খুঁজে বেড়ায়। মামলা, মোকদ্দমা, জেল এড়াতে ঘরে বসে থাকাই শ্রেয়।
এক সময় শ্লোগান ছিল ‘আমার ভোট আমি দেব/ যাকে খুশি তাকে দেব’। এখন চলছে ‘আমার ভোট আমি দেব/ তোমার ভোটও আমি দেব’। আর নির্বাচন পরিচালনাকারী রেফারির দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনের অবস্থা ‘আমার দায়িত্ব আমি পালন করবো/ ক্ষমতাসীনদের খুশি করবো’। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় নবাব সিরাজ উদ দৌল্লার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ যেমন ইংরেজ সৈন্যদের তান্ডব দেখেও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল; বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারও যেন ‘নিয়ন্ত্রিক নির্বাচন’ ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছে। কেউ অভিযোগ করলে বলা হয় ‘দেখছি’। বিদেশীরা নির্বাচন নিরপেক্ষ করার চাপ দিলে বলা হয় ‘চেষ্টা করছি’। কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদের সময়ে শুরু হওয়া ইসির তল্পিবাহকের ট্রেন্ড কে এম নুরুল হুদার আমলেও চলছে। আগে নির্বাচনী কেন্দ্রে বিশৃংখলা, হৈচৈ, ব্যালট ছিনতাই, সংঘাত-সংঘর্ষ হতো। আইন শৃংখলা বাহিনী সেগুলো প্রতিহত করতো। এখন আইন শৃংখলা বাহিনী ‘বিশেষ বিশেষ’ প্রার্থীর পক্ষে কর্মীর ভূমিকায় থাকেন। এজন্য গ্রেফতার ও জেল-জুলুমের ভয়ে প্রতিপক্ষের কর্মী সমর্থকরা থাকে অনুপস্থিত। নির্বাচনে রক্ত ঝড়ছে কম। কোনো কোনো কেন্দ্রে মধ্য দুপুরে দেখা যায় কবরের শান্তি। আগেই ব্যালটে সিল মারার কাজ শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়।
প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্টের দায়িত্ব! ধানের শীষের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট হলে জেলে যেতে হয়। লাঠিপেটা, কিল ঘুষি খেতে হয়। মামলার জালে পড়তে হয়। কাউকে ভোট শুরুর আগেই চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। গাজীপুর নির্বাচনের দিন ধানের শীষের অর্ধ শতাধিক এজেন্টকে সকালেই গাড়ীতে উঠিয়ে দূর-দূরান্তে ফেলে আসা হয়। এতে ভোট কেন্দ্রে হিংসা হানাহানির সম্ভাবনা কমে যায়। ক্ষমতাসীনরা এটাকেই বলছেন থাকেন ‘গুড নির্বাচন’। এ অবস্থা দেশের মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। বিদেশী দাতাদেশ-সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বাচনের নামে ডিজিটাল কেলেঙ্কারী তথা প্রহসনের নির্বাচন মেনে নিতে পারছেন না। দেশের কোটি কোটি তরুণ ভোটারও এখন হতাশ। ভোট কেন্দ্রে যেতে মোটেই আগ্রহী নয়।
একটি বিদেশী সংস্থা জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান তরুণদের যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ এর মধ্যে তারা আর ভোট কেন্দ্রে যেতে চায় না। প্রশ্ন হচ্ছে যাদের হাতে নির্বাচন করার সাংবিধানিক দায়িত্ব সেই নির্বাচন কমিশন কী আজ তিন সিটি নির্বাচনে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে? নাকি খুলনা-গাজীপুরের ভোটের দিনের মতো ক্ষমতাসীনদের তল্পিবাহক হয়েই থাকবে? ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার আগে এই তিন সিটির নির্বাচন কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের জন্য প্রি-টেষ্ট পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে ফাইনাল পরীক্ষা অংশ নেয়া (জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা) দূরহ। কাজেই খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যে ‘নিয়ন্ত্রিত ভোট’ হয়েছে; বরিশাল-সিলেট-রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনে তার পূনরাবৃত্তি মানুষ দেখতে চায় না। ইসিকে মানুষ নীরব দর্শকের ভূমিকায় দেখতে চায় না। তিনি সিটি নির্বাচনে ইসি কী ভূমিকা পালন করে সেটা দেখার জন্য চলছে অপেক্ষা।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

সংশয়ের ভোট আজ

আপলোড টাইম : ০৯:২৫:৩৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ জুলাই ২০১৮

ডেস্ক রিপোর্ট: বরিশাল-রাজশাহী-সিলেটে ভোটের আয়োজন সম্পন্ন। সব ঠিকঠাক থাকলে আজ সকালেই শুরু হবে তিন সিটিতে ভোট। কেমন হবে এই স্থানীয় নির্বাচন। ভোটাররা কী নির্বিঘে ভোট দিতে পারবে? ভোট কি আদৌ হবে? নাকি নিয়ন্ত্রিত ভোট করে দেশবাসীকে দেখানো হবে নির্বাচনী বায়স্কোপ? গতকালও বিএনপির নেতারা ইসির সঙ্গে দেখা করে ‘অনিয়মের’ এন্তাজ অভিযোগ তুলেছেন। এর কদিন আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করে দেশবাসীকে বার্তা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম। তিনি বলেছেন, ‘গাজীপুর ও খুলনাতে নির্বাচন হয়েছে গুড; তিন সিটিতে আরো বেটার নির্বাচন হবে’।
রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ভোটকে কেন্দ্র করে ধানের শীষ মার্কার মেয়র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার, ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বাচনী এলাকাগুলোয় ক্ষমতাসীনদের দাপট ও দৌরাত্ম্যের যে বীভৎস রূপ ফুটে উঠেছে তাতে ভোটাররা কী ভোট দিতে যাওয়ার আগ্রহী হবে? নাকি বাড়তি ঝামেলা এড়াতে সচেতনভাবে ঘরে বসে থাকবে? এই ভোটের আয়োজন যারা করছেন সেই নির্বাচন কমিশন কী সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন করার চেস্টা করবে? নাকি হৈমন্তি শুক্লার ‘চেয়ে দেয়ে দেখলাম তুমি চলে চলে/ তুমি চলে গেলে চেয়ে চেয়ে দেখলাম/ আমার বলার কিছু ছিল না’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে?
নির্বাচন নিয়ে নেতিবাচক বিতর্ক উঠলেই এক সময় ‘মাগুরা মার্কা নির্বাচন’ শব্দটি মানুষ উচ্চারণ করতেন। খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের নামে ‘বায়স্কোপ’ দেখানোয় মাগুরার দুর্নাম ধুঁইয়ে-মুছে গেছে। খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে মানুষ এখন ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়ার ‘ডিজিটাল সংস্করণ’ মনে করে। দুই সিটিতে ভৌতিক ভোট গ্রহণ এবং প্রকাশ্যে নির্বাচনের নামে জাল-জালিয়াতি অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ফেলেছে। এখন তিন সিটি তথা বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহীর নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীদের মধ্যে প্রচারণা, উচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের গ্রেফতার, ভয়ভীতি দেখানো, ধানের শীষের প্রার্থীদের ভোটারদের ভোট দেয়া নিয়ে সংশয়; নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের কত হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবেন আগেই সে ঘোষণা ভোটারদের মধ্যে ভীতি-আতঙ্ক-উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তরুণ ভোটারদের করছে নিরুস্বাহিত।
সরেজমিন খবর হলো গ্রেফতার আতঙ্কে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর বেশির ভাগ নির্বাচনী অফিস কয়েকদিন আগেই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারলেও তার কর্মী সমর্থকরা সেটা পারেননি। পথে বের হলেই তাদের ভয়ভীতি দেখানো হয় এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে গ্রেফতার করা হয়। গতকাল মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন বিএনপির ২৪ জন পোলিং এজেন্টকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীরা ভোটারদের বাড়িবাড়ি গিয়ে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে, হুমকি দিয়ে আসছে। এই হুমকিতেও কাজ না হওয়ায় পুলিশ দিয়ে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করানো হচ্ছে। এই নির্বাচনকে বিএনপি আন্দোলন হিসেবে নেয়ায় নেতাকর্মীদের কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বুলবুল বলেছেন, যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য বিএনপি প্রস্তুত।
বরিশালে ধানের শীষ প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার জানান, ভোটের আগের দিন গতকাল তিনি নিজে এবং কর্মীরা ভয়ে বের হননি। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে ইতোমধ্যে ৩৫ জন কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অসংখ্য কর্মী গ্রেফতার এড়াতে বরিশাল ত্যাগ করেছেন। তার অভিযোগ এসব শুধু প্রতিদ্বন্দ্বি আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহর কারণেই নয়, প্রশাসন নগ্নভাবে হস্তক্ষেপ করছে। প্রশাসন নৌকার প্রার্থীর কর্মীর ভূমিকায় নেমেছে। পুলিশের ভয়ে বিএনপির সক্রিয় কর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছে না। পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মধ্যরাতে হানা দিচ্ছে বাসায়। কাউকে উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে, কাউকে গালিগালাজ করা হচ্ছে কিংবা বাসায় না পেলে ভোট কেন্দ্রে না যাবার হুমকি দেয়া হচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন নৌকার প্রার্থীর ব্যালটে সীল মারার জন্য বরিশাল নগরীর চারপাশে হাজার হাজার বহিরাগতদের জড়ো করা হয়েছে। ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে আকস্মিক পৃথক সংবাদ সম্মেলন করেছেন আরো তিন মেয়র প্রার্থী।
ইসলামী ইন্দোলনের প্রাথী প্রিন্সিপ্যাল হাফেজ মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুব, বাসদের ডা. মনিষা চক্রবতী, ও ইকবাল হোসেন তাপস পৃথক পৃথকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে সিটি নির্বাচনের প্রশাসনের কার্যক্রমে সুষ্টু ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। যদিও আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহকে ইসি থেকে শোকজ করা হয়েছে। সিলেটে প্রায় সব নির্বাচনে আছে স¤প্রীতির নজির। অতীতের নির্বাচনগুলোতে সংঘাত সহিংসতার ঘটনা তেমন ঘটেনি। কিন্তু এবার নৌকা ও ধানের শীষের প্রার্থী একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছেন। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে শুরু হয়েছে মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্ক। কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী একাধিক দিন রাস্তায় অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। কর্মীদের ছাড়িয়ে নিতে থানায় ঘন্টার পর ঘন্টা অবস্থান নেন। তিনি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও হয়রানির অভিযোগের পাশাপাশি পোলিং এজেন্টকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়রানি করছে বলে অভিযোগ তুলেছেন। ভোটের আগের দিন ধানের শীষ প্রতীকের মেয়র প্রার্থীর নির্বাচন সমন্বয়কারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নির্বাচন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন মিডিয়ার যে সব সংবাদকর্মী তিনি সিটিকে ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তিন সিটিতেই নির্বাচনী এলাকায় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের জন্য ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। যার কারণে ‘ভোট উৎসব’ কার্যত রুপ লাভ করেছে ভোট আতঙ্কে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বশীলদের নীরবতা আর প্রশাসনযন্ত্র, আইন শৃংখলা বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের মারমুখী তৎপরতায় ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর কর্মীরা ঘর ছাড়া। ভোটারদের মধ্যে শুরু হয়েছে উদ্বেগ-উৎকষ্ঠা। ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়া না দেয়া নিয়ে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে সংশয়। অবস্থা এমন যে কী দরকার ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার! ভোট দিতে গিয়ে অযথা বিপদ ডেকে এনে লাভ কী? পুলিশ আগে বিএনপির নেতাকর্মী খুঁজতো এখন তারা ধানের শীষের ভোটারদেরও খুঁজে বেড়ায়। মামলা, মোকদ্দমা, জেল এড়াতে ঘরে বসে থাকাই শ্রেয়।
এক সময় শ্লোগান ছিল ‘আমার ভোট আমি দেব/ যাকে খুশি তাকে দেব’। এখন চলছে ‘আমার ভোট আমি দেব/ তোমার ভোটও আমি দেব’। আর নির্বাচন পরিচালনাকারী রেফারির দায়িত্বে থাকা নির্বাচন কমিশনের অবস্থা ‘আমার দায়িত্ব আমি পালন করবো/ ক্ষমতাসীনদের খুশি করবো’। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের সময় নবাব সিরাজ উদ দৌল্লার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ যেমন ইংরেজ সৈন্যদের তান্ডব দেখেও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল; বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনারও যেন ‘নিয়ন্ত্রিক নির্বাচন’ ঠায় দাঁড়িয়ে দেখছে। কেউ অভিযোগ করলে বলা হয় ‘দেখছি’। বিদেশীরা নির্বাচন নিরপেক্ষ করার চাপ দিলে বলা হয় ‘চেষ্টা করছি’। কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদের সময়ে শুরু হওয়া ইসির তল্পিবাহকের ট্রেন্ড কে এম নুরুল হুদার আমলেও চলছে। আগে নির্বাচনী কেন্দ্রে বিশৃংখলা, হৈচৈ, ব্যালট ছিনতাই, সংঘাত-সংঘর্ষ হতো। আইন শৃংখলা বাহিনী সেগুলো প্রতিহত করতো। এখন আইন শৃংখলা বাহিনী ‘বিশেষ বিশেষ’ প্রার্থীর পক্ষে কর্মীর ভূমিকায় থাকেন। এজন্য গ্রেফতার ও জেল-জুলুমের ভয়ে প্রতিপক্ষের কর্মী সমর্থকরা থাকে অনুপস্থিত। নির্বাচনে রক্ত ঝড়ছে কম। কোনো কোনো কেন্দ্রে মধ্য দুপুরে দেখা যায় কবরের শান্তি। আগেই ব্যালটে সিল মারার কাজ শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়।
প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্টের দায়িত্ব! ধানের শীষের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট হলে জেলে যেতে হয়। লাঠিপেটা, কিল ঘুষি খেতে হয়। মামলার জালে পড়তে হয়। কাউকে ভোট শুরুর আগেই চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটার নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। গাজীপুর নির্বাচনের দিন ধানের শীষের অর্ধ শতাধিক এজেন্টকে সকালেই গাড়ীতে উঠিয়ে দূর-দূরান্তে ফেলে আসা হয়। এতে ভোট কেন্দ্রে হিংসা হানাহানির সম্ভাবনা কমে যায়। ক্ষমতাসীনরা এটাকেই বলছেন থাকেন ‘গুড নির্বাচন’। এ অবস্থা দেশের মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। বিদেশী দাতাদেশ-সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বাচনের নামে ডিজিটাল কেলেঙ্কারী তথা প্রহসনের নির্বাচন মেনে নিতে পারছেন না। দেশের কোটি কোটি তরুণ ভোটারও এখন হতাশ। ভোট কেন্দ্রে যেতে মোটেই আগ্রহী নয়।
একটি বিদেশী সংস্থা জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান তরুণদের যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ এর মধ্যে তারা আর ভোট কেন্দ্রে যেতে চায় না। প্রশ্ন হচ্ছে যাদের হাতে নির্বাচন করার সাংবিধানিক দায়িত্ব সেই নির্বাচন কমিশন কী আজ তিন সিটি নির্বাচনে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে? নাকি খুলনা-গাজীপুরের ভোটের দিনের মতো ক্ষমতাসীনদের তল্পিবাহক হয়েই থাকবে? ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তার আগে এই তিন সিটির নির্বাচন কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের জন্য প্রি-টেষ্ট পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে ফাইনাল পরীক্ষা অংশ নেয়া (জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা) দূরহ। কাজেই খুলনা ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন যে ‘নিয়ন্ত্রিত ভোট’ হয়েছে; বরিশাল-সিলেট-রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনে তার পূনরাবৃত্তি মানুষ দেখতে চায় না। ইসিকে মানুষ নীরব দর্শকের ভূমিকায় দেখতে চায় না। তিনি সিটি নির্বাচনে ইসি কী ভূমিকা পালন করে সেটা দেখার জন্য চলছে অপেক্ষা।