ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গা সমস্যা : বছর শেষেও সমাধান নেই

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:১৩:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ অগাস্ট ২০১৮
  • / ৩৭৬ বার পড়া হয়েছে

গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা নিধন যজ্ঞের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্লিয়ারেন্স জš§ দেয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এক মানবিক সংকটের। পাল্টে যায় বৈশ্বিক শরণার্থীর হিসাব। রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়ে কাটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে রোহিঙ্গারা। এক বছর হতে চলেছে মিয়ানমার তাদেরকে গ্রহণ করতে এখন পর্যন্ত আন্তরিকতা দেখায়নি। উল্টো রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিলম্ব হওয়ার জন্য সেদেশের নেত্রী অং সান সুচি দায় চাপায় বাংলাদেশের ওপর। সংকট সমাধানে এগিয়ে আসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বাংলাদেশের কক্সবাজারে ৩০টি ক্যাম্পে আশ্রয় হয় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার। জীবন বাঁচানোর মতো ত্রাণ এবং মানবিক সেবা দেয়া হলেও রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন রয়েই গেছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ চুক্তি স্বাক্ষরের পর গত ২৩ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো শুরু হয়নি। কবে থেকে শুরু হবে তাও অনিশ্চিত। ক্যাম্পে প্রতিদিন ভূমিষ্ঠ হচ্ছে প্রায় ১৩০ জন শিশু। ক্যাম্পের আকার এবং সংকট দুইই বাড়ছে। কক্সবাজারের পরিবেশ, পর্যটন ও স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর বেড়ে চলেছে রোহিঙ্গা শরণার্থী চাপ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যে প্রত্যাশা ছিল চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও এর তেমন অগ্রগতি হয়নি। রোহিঙ্গাদের জন্য এখনো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়নি মিয়ানমারে। যদিও রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে রাখাইনে নির্মাণ করা হয়েছে লোক দেখানো ট্রানজিট ক্যাম্প। বাস্তবে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে মিয়ানমার। ফলে ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা স্বদেশ ফেরা নিয়ে রয়েছেন অনিশ্চিয়তায়। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের এক বছর পূর্তিকে সামনে রেখে উত্তর রাখাইনে এখন সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের মংডু, বুথিডাউং শহরে সান্ধ্যকালীন কারফিউর মেয়াদ আরো ২ মাস বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে গত এক বছরে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হয়েছেন বলে দাবি করেছে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। রোহিঙ্গা সংকটের বর্ষপূর্তিতে ২৪ আগস্ট অ্যামনেস্টির এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সংকটের বর্ষপূর্তিকে লজ্জাজনক বলে উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে আসিয়ানের ১৩২ জন এমপি মিয়ানমারের বিচারও দাবি করেছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতাকে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র নিধনযজ্ঞ বলে অভিহিত করে। বিপুল সংখ্যা রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়ার এই সংকটকে দ্রুত বর্ধমান শরণার্থী সংকট বলে অভিহিত করে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাÑইউএনএইচসিআর। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কয়েকটি বৈঠক করেছে। কিন্তু নিন্দা জানানো ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি মিয়ানমারের পক্ষে থাকা চীনের জন্য। তবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও ইউনিটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সামরিক সহযোগিতা স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্য। এখনো মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার প্রবণতা রয়েছে। মিয়ানমার বার বার বলছে, তারা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু এখনো অনেক মানুষ পালিয়ে আসায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সমস্যা সমাধানে অগ্রগতিতে ঘাটতির বিষয়টিকেই ফুটিয়ে তোলে। চলতি বছরের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে। এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, এক বছর আগে যে সংকট শুরু হয়েছিল তা দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করেছে এবং এ সংকট সমাধান বহু দূরের বিষয়। কিন্তু মেঘে মেঘে যে অশনিসংকেত তা সামাল দিতে না পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি তো বটেই, রাজনীতিতেও রোহিঙ্গা সমস্যা কাটা ঘায়ের মতো হয়ে থাকবে। আর যার যখন যেভাবে খুশি তাতে নুন ছিটাবে। এর সমাধান খুঁজে বের এবং বিচক্ষণ ও দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশকে তৈরি থাকতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করতে চালানো হচ্ছে তৎপরতা। সহসা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একটি চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা বলে ভাবা হচ্ছে আনান কমিশনের রিপোর্টকে। রিপোর্টটি বাস্তবায়ন হোক; সমাধান হোক রোহিঙ্গা সমস্যার। এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

রোহিঙ্গা সমস্যা : বছর শেষেও সমাধান নেই

আপলোড টাইম : ০৯:১৩:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৭ অগাস্ট ২০১৮

গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা নিধন যজ্ঞের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অপারেশন ক্লিয়ারেন্স জš§ দেয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এক মানবিক সংকটের। পাল্টে যায় বৈশ্বিক শরণার্থীর হিসাব। রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়ে কাটাতারের বেড়া ডিঙিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে রোহিঙ্গারা। এক বছর হতে চলেছে মিয়ানমার তাদেরকে গ্রহণ করতে এখন পর্যন্ত আন্তরিকতা দেখায়নি। উল্টো রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন বিলম্ব হওয়ার জন্য সেদেশের নেত্রী অং সান সুচি দায় চাপায় বাংলাদেশের ওপর। সংকট সমাধানে এগিয়ে আসে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। বাংলাদেশের কক্সবাজারে ৩০টি ক্যাম্পে আশ্রয় হয় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার। জীবন বাঁচানোর মতো ত্রাণ এবং মানবিক সেবা দেয়া হলেও রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন রয়েই গেছে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার যৌথ চুক্তি স্বাক্ষরের পর গত ২৩ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো শুরু হয়নি। কবে থেকে শুরু হবে তাও অনিশ্চিত। ক্যাম্পে প্রতিদিন ভূমিষ্ঠ হচ্ছে প্রায় ১৩০ জন শিশু। ক্যাম্পের আকার এবং সংকট দুইই বাড়ছে। কক্সবাজারের পরিবেশ, পর্যটন ও স্থানীয় অধিবাসীদের ওপর বেড়ে চলেছে রোহিঙ্গা শরণার্থী চাপ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যে প্রত্যাশা ছিল চুক্তি স্বাক্ষরের পরেও এর তেমন অগ্রগতি হয়নি। রোহিঙ্গাদের জন্য এখনো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি হয়নি মিয়ানমারে। যদিও রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে রাখাইনে নির্মাণ করা হয়েছে লোক দেখানো ট্রানজিট ক্যাম্প। বাস্তবে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে মিয়ানমার। ফলে ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গারা স্বদেশ ফেরা নিয়ে রয়েছেন অনিশ্চিয়তায়। রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের এক বছর পূর্তিকে সামনে রেখে উত্তর রাখাইনে এখন সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। একই সঙ্গে রাখাইন রাজ্যের মংডু, বুথিডাউং শহরে সান্ধ্যকালীন কারফিউর মেয়াদ আরো ২ মাস বাড়ানো হয়েছে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে গত এক বছরে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হয়েছেন বলে দাবি করেছে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। রোহিঙ্গা সংকটের বর্ষপূর্তিতে ২৪ আগস্ট অ্যামনেস্টির এক বিবৃতিতে রোহিঙ্গা সংকটের বর্ষপূর্তিকে লজ্জাজনক বলে উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে আসিয়ানের ১৩২ জন এমপি মিয়ানমারের বিচারও দাবি করেছেন। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতাকে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র নিধনযজ্ঞ বলে অভিহিত করে। বিপুল সংখ্যা রোহিঙ্গাদের বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশ ছাড়ার এই সংকটকে দ্রুত বর্ধমান শরণার্থী সংকট বলে অভিহিত করে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থাÑইউএনএইচসিআর। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক সহায়তা প্রদানে এগিয়ে এসেছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে কয়েকটি বৈঠক করেছে। কিন্তু নিন্দা জানানো ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি মিয়ানমারের পক্ষে থাকা চীনের জন্য। তবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও ইউনিটের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সামরিক সহযোগিতা স্থগিত করেছে যুক্তরাজ্য। এখনো মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার প্রবণতা রয়েছে। মিয়ানমার বার বার বলছে, তারা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত। কিন্তু এখনো অনেক মানুষ পালিয়ে আসায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সমস্যা সমাধানে অগ্রগতিতে ঘাটতির বিষয়টিকেই ফুটিয়ে তোলে। চলতি বছরের শুরু থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে। এতে পরিষ্কার বোঝা যায়, এক বছর আগে যে সংকট শুরু হয়েছিল তা দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করেছে এবং এ সংকট সমাধান বহু দূরের বিষয়। কিন্তু মেঘে মেঘে যে অশনিসংকেত তা সামাল দিতে না পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি তো বটেই, রাজনীতিতেও রোহিঙ্গা সমস্যা কাটা ঘায়ের মতো হয়ে থাকবে। আর যার যখন যেভাবে খুশি তাতে নুন ছিটাবে। এর সমাধান খুঁজে বের এবং বিচক্ষণ ও দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশকে তৈরি থাকতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সাহায্যের আবেদন জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করতে চালানো হচ্ছে তৎপরতা। সহসা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় কিছু রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের একটি চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা বলে ভাবা হচ্ছে আনান কমিশনের রিপোর্টকে। রিপোর্টটি বাস্তবায়ন হোক; সমাধান হোক রোহিঙ্গা সমস্যার। এমনটাই প্রত্যাশা আমাদের।