ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর চলছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ নিজ দেশে পরবাসী রোহিঙ্গাদের শরণার্থী জীবন বহুকালের

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৬:২২:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০১৬
  • / ৪৪৩ বার পড়া হয়েছে

DW

নিজস্ব প্রতিবেদক: এই মূহুর্তে পৃথিবীতে সবচেয়ে জঘণ্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা ঘটছে আমাদেরই পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে। সেখানে আবারও জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর চলছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গারা যেন মানুষই না। এদের সাথে সেদেশের সরকারের আচরণ পশুকেও হার মানায়। রাখাইনের রোহিঙ্গাদের সাথে এমন আচরণ নতুন নয়। বহুকাল থেকেই মিয়ানমারের রাখাইন বা আরকান রাজ্যের রোহিঙ্গারা আক্ষরিক অর্থেই দেশহীন মানুষ, কোনও দেশই তাদের দেশ নয়। মিয়ানমারে বংশ পরম্পরায় বাস করেও তারা সে দেশের নাগরিক নয়। তাড়া খেয়ে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সে দেশেরও নাগরিক নয়। সব দেশেই তারা শরনার্থী, সবখানেই তারা অনাকাঙ্খিত উদ্বাস্ত।
বাংলাদেশ থেকে নাফ নদী পেরুলেই মিয়ানমার। টেকনাফ থেকে নৌকা নিলে ওপাড়েই মংডো। আরাকান রাজ্যের উত্তরে এই মংডো অঞ্চলেই রোহিঙ্গাদের বাস। একসময় বঙ্গের পূর্বাঞ্চল থেকে আসা মানুষেরা মংডোতে গিয়ে বসত শুরু করেছিল। সেটাও সম্ভবত পনের শ’শতকে অথবা তারও আগে। ইংরেজ আমলেও সেখানে মানুষ গিয়েছে, গিয়েছে ইংরেজ বার্মা যুদ্ধের পরও, গিয়েছে একাত্তরেও। এ দুটো অঞ্চল একটি নদীর এপার ওপার। ঝঞ্চা, বিপদ, হানাহানীতে বহু বছর ধরে এপার ওপার করেছে সেখানকার মানুষ। এভাবে শুধু সেখানকার মানুষই বেঁচেছে তা নয়। পৃথিবীর বহু দেশে এমন সংকটে এপার ওপার করে বেঁচেছে বহু দেশের বহু মানুষ। এমন উদাহরণ পৃথিবীর সর্বত্র। আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবন বাঁচাতে জন্মভূমি ছেড়ে অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে দেশান্তর হয়েছেন। দল বেধে যেদিকে খাদ্য নিশ্চয়তা ও জীবনের নিরাপত্তা রয়েছে বেশী সেদিকে নতুন আবাস গড়েছেন। ইতিহাস বলে মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ছুটেছে জীবন জীবিকার প্রয়োজনে। রোহিঙ্গারাও এর ব্যতিক্রম নয়। অথচ আজ তাদের দেশ বলে কিছু নেই। রাষ্ট্রপুঞ্জ তো রোহিঙ্গাদের নাম দিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। দেশ থেকেও তাদের দেশ নেই। যে দেশে তারা জন্মেছে, তারা সে দেশেরও নাগরিক নয়। আর ভোটাধীকারের তো কোন প্রশ্নই আসে না। ফলে তারা শরনার্থী বা উদ্বাস্ত থেকেছে জীবনভর।
ভারত ভাগের সময়ই রোহিঙ্গাদের মধ্যে গড়ে ওঠে কঠর ইসলামপন্থী মোজাহিদ্বীন দল এবং তারা তখন থেকেই ইসলামী আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। যেটা অনেকের দৃষ্টিতেই কট্টুর ইসলামী আন্দোলন বলে মনে হয়েছে। সেই সময় তারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে দেখা করে পাকিস্তানের অংশ হতে চেয়েছিল। রাখাইনের পূর্বাঞ্চলকে পাকিস্তনের অংশের সাথে অন্তর্ভূক্তেরও দাবী জানায় তারা। কিন্তু জিন্নাহ রোহিঙ্গাদের সে দাবী রাখেননি। ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর থেকে রোহিঙ্গা মুজাহিদ্বীনরা রাখাইনের পূর্বাঞ্চলকে মিয়ানমার থেকে আলাদা করার সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে এবং একসময় তারা রাখাইনের পূর্বাঞ্চল শাসন করতেও শুরু করে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে এসময় রোহিঙ্গা মুজাহিদ্বীনদের আমন্ত্রনে বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর মুসলিম সেখানে গিয়ে মিয়ানমারের সরকারের বিনা অনুমতিতে বসবাস শুরু করে এবং মুজাহিদ্বীন দলে যোগ দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় রাখাইন অঞ্চলের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গা ও মুজাহিদ্বীনদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। ভিক্ষুদের বিক্ষোভের পরপরই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুজাহিদ্বীনদের শক্তি সক্ষমতা গুড়িয়ে দিতে উদ্যত হয় এবং ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালায়। এর একপর্যায়ে মুজাহিদ্বীনদের নিকট থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয় এবং বহু মুজাহিদ্বীন নেতাকে হত্যা করে মিয়ানমার সরকার। জীবিত অনেকে পালিয়েও যায়। এসব ঘটনা ঘটে এক দশকের মধ্যেই।
এখনও প্রতিদিন মিয়ানমার আর্মি রোহিঙ্গাদের বাড়ী ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, হত্যা করছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের। হাজার হাজার রোহিঙ্গা উদ্ধাস্ত হতে বাধ্য হচ্ছে প্রতিদিন।
২০১২ সালেও এমন হত্যা নিপীড়নে শত শত রোহিঙ্গা মিয়ানমার আর্মির হাতে নিহত হয়েছে। উদ্ধাস্ত হয়েছে দেড় লক্ষাধিক। স্মরণ থাকার কথা, জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছিল রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়ে যেদিকেই যাচ্ছিল, সেদিকের কোন পাড়েই অনুমতি ছিলনা নৌকা ভেড়াবার। প্রতিটি দেশের সীমানার সমুদ্র পাড়ে প্রস্তুত ছিল সেদেশের প্রহরী, যেন কোনভাবেই জীবন বিপন্ন রোহিঙ্গারা তাদের দেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে। মানবতার বিরুদ্ধে এ এক নির্লজ্জ অপমান।
মিয়ানমারের গোটা রাখাইন রাজ্যে যখন মানবতা বিরোধী এই বিভৎসরূপ, তখন কোথায় সেই শান্তির দূত আং সান সুচি।
শান্তিতে নোবেল জয়ী আং সান সুচি যেন চোখে কালো চশমা পরেছেন মুখে কুলুপ এটেছেন। মিয়ানমার আর্মির এহেন বর্বরতার বিরুদ্ধে টু শব্দটি পর্যন্ত করছেন না তিনি। এ কেমন শান্তির দূত তিনি। তবে কি ক্ষমতার গদিতে এতই আরাম যে এটি ধরে রাখতে শান্তির দূত হয়েও চূড়ান্ত অশান্তি করতেও দ্বিধা করছেন না। মানবিধকার লঙ্ঘনে এতটুকু লজ্জিত নন তিনি। তবে কি তার শান্তির জন্য লড়াই ছিল নিজের জন্য, অন্যের ক্ষেত্রে লোক দেখানো ! সুচির এই নির্লজ্জ ভূমিকার কারণে ইতোমধ্যেই তার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার দাবী উঠেছে বিশ্ব জুড়ে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা মুজাহিদ্বীন। কিন্তু সব রোহিঙ্গাই তো আর মুজাহিদ্বীন নয়, আবার সব রোহিঙ্গাও জিহাদী নয়। বেশির ভাগ রোহিঙ্গাই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই জীবনের নিরাপত্তা চাই, শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আবার আমাদের দেশের একদল মানুষ রোহিঙ্গাদের সমস্যাকে মুসলমানদের সাথে বৌদ্ধদের বিবাদ হিসাবে দেখে তৈরী করতে চাই ধর্মীয় উত্তেজনা। এই সমস্যাকে এত সরলিকরন করলে চলবেনা। আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা ঐ অঞ্চল একটি এথনিক গ্রুপ বা জাতিগোষ্ঠী। সংখ্যায় যত কমই হোক ওদেরও অধিকার আছে সেই দেশের নাগরিক মর্যাদা নিয়ে সেখানেই বসবাস এবং নিজ দেশের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করার। কেবল রোহিঙ্গা বলেই তাদের সাথে রাষ্ট্র বৈষম্য ও নির্বতনমূলক আচরণ করবে এটা তো অন্যায়, কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য হতে পারেনা। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে মিয়ানমার আর্মির আগুন দেওয়ার যে খবর পাই, হত্যার খবর পাই এর কোন ব্যাখ্যা না দিয়েই বলা যায় – এ অন্যায় ধিক্কারজনক। রোহিঙ্গাদের এই সমস্যার আন্তরিক সমাধান চাইলে মানবাধিকার বোধসম্পন্নদের সেদেশের সরকারের উপর চাপ তৈরী করতে হবে। সরকার যেন বার্মার সামরিক সরকারের উপর চাপ প্রয়োগে আন্তর্জাতিক কুটনীতি জোরে সোরে শুরু করতে বাধ্য হয়। সেজন্য প্রয়োজন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে এই মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনাকে তুলে ধরে জনমত তৈরী করা। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করা মিয়ানমারের কাছে নতুন কিছু নয়, মিয়ানমারের এ চর্চা অনেক পুরানো। মিয়ানমারওতো ধীরে হলেও পাল্টাচ্ছে। মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি ছাড়া আমরা আর কিইবা করতে পারি, সেটাও ভাবতে হবে। আর এহেন অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করতেই হবে আমাদের। মানুষ হিসাবে এটা আমাদের দায়িত্ব। প্রতিবাদ করতে হবে এজন্য যেন মিয়ানমারের শাসকেরা বুঝতে পারে পৃথিবীর মানুষ এই জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করবেনা। রুখে দাড়াবে, নির্যাতিতদের পাশে দাড়াবে। একই সাথে এও খেয়াল রাখতে হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের মানবিক বিপর্যয়ের এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে যেয়ে যেন সেখানকার মৌলবাদী জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসী কথিত জিহাদীকে যেন সমর্থন না করি। তাহলে এই নিরীহ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাবে। মিয়ানমারেরর রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই সমাধান করতে হবে। অনেকে মনে করছেন বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিয়ে বিপদগ্রস্থ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া উচিৎ। সাধারনভাবে মনে হতে পারে মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া এই মূহুর্তের কর্তব্য। মিয়ানমার সরকারও এটাই চাইছে। তারা চাইছে জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়–ক। আশ্রয় নিক পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহে, আপদ বিদায় হোক। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দফায় দফায় মিয়ানমার আর্মির নির্যাতনে রোহিঙ্গারা নানাভাবে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশ করে এখানের জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গিয়েও বসবাস করছে, আবার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরেও রয়েছে বহু বছর ধরে। সীমান্তের এপার ওপারে বসবাসরতদের চেহারা একই রকম ও পরস্পর আত্মীয় হওয়ায় সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে তাদের অনুপ্রবেশ ও বসবাস নতুন নয়। বাংলাদেশ সরকার বহু বছর থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে ও সরাসরি মিয়ানমার সরকারকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও আজ অবধি তাদের ফিরিয়ে নিতে কোন উদ্যোগই গ্রহন করেনি। আমাদের দেশও এমন সামর্থ্যবান নয় যে সীমান্ত খুলে দিয়ে মিয়ানমার আর্মির নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের আবারও শরণার্থী হিসেবে এদেশে গ্রহন করে নেবে। আর এটাও তো কোন স্থায়ী সমাধান নয়। বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর সেদেশের সরকারের নির্মম হত্যা ও মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগে এখনই কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহন করা।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর চলছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ নিজ দেশে পরবাসী রোহিঙ্গাদের শরণার্থী জীবন বহুকালের

আপলোড টাইম : ০৬:২২:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ নভেম্বর ২০১৬

DW

নিজস্ব প্রতিবেদক: এই মূহুর্তে পৃথিবীতে সবচেয়ে জঘণ্যতম মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা ঘটছে আমাদেরই পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে। সেখানে আবারও জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর চলছে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গারা যেন মানুষই না। এদের সাথে সেদেশের সরকারের আচরণ পশুকেও হার মানায়। রাখাইনের রোহিঙ্গাদের সাথে এমন আচরণ নতুন নয়। বহুকাল থেকেই মিয়ানমারের রাখাইন বা আরকান রাজ্যের রোহিঙ্গারা আক্ষরিক অর্থেই দেশহীন মানুষ, কোনও দেশই তাদের দেশ নয়। মিয়ানমারে বংশ পরম্পরায় বাস করেও তারা সে দেশের নাগরিক নয়। তাড়া খেয়ে বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সে দেশেরও নাগরিক নয়। সব দেশেই তারা শরনার্থী, সবখানেই তারা অনাকাঙ্খিত উদ্বাস্ত।
বাংলাদেশ থেকে নাফ নদী পেরুলেই মিয়ানমার। টেকনাফ থেকে নৌকা নিলে ওপাড়েই মংডো। আরাকান রাজ্যের উত্তরে এই মংডো অঞ্চলেই রোহিঙ্গাদের বাস। একসময় বঙ্গের পূর্বাঞ্চল থেকে আসা মানুষেরা মংডোতে গিয়ে বসত শুরু করেছিল। সেটাও সম্ভবত পনের শ’শতকে অথবা তারও আগে। ইংরেজ আমলেও সেখানে মানুষ গিয়েছে, গিয়েছে ইংরেজ বার্মা যুদ্ধের পরও, গিয়েছে একাত্তরেও। এ দুটো অঞ্চল একটি নদীর এপার ওপার। ঝঞ্চা, বিপদ, হানাহানীতে বহু বছর ধরে এপার ওপার করেছে সেখানকার মানুষ। এভাবে শুধু সেখানকার মানুষই বেঁচেছে তা নয়। পৃথিবীর বহু দেশে এমন সংকটে এপার ওপার করে বেঁচেছে বহু দেশের বহু মানুষ। এমন উদাহরণ পৃথিবীর সর্বত্র। আমাদের পূর্বপুরুষেরা জীবন বাঁচাতে জন্মভূমি ছেড়ে অনুকূল আবহাওয়া ও পরিবেশের কারণে দেশান্তর হয়েছেন। দল বেধে যেদিকে খাদ্য নিশ্চয়তা ও জীবনের নিরাপত্তা রয়েছে বেশী সেদিকে নতুন আবাস গড়েছেন। ইতিহাস বলে মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ছুটেছে জীবন জীবিকার প্রয়োজনে। রোহিঙ্গারাও এর ব্যতিক্রম নয়। অথচ আজ তাদের দেশ বলে কিছু নেই। রাষ্ট্রপুঞ্জ তো রোহিঙ্গাদের নাম দিয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী। দেশ থেকেও তাদের দেশ নেই। যে দেশে তারা জন্মেছে, তারা সে দেশেরও নাগরিক নয়। আর ভোটাধীকারের তো কোন প্রশ্নই আসে না। ফলে তারা শরনার্থী বা উদ্বাস্ত থেকেছে জীবনভর।
ভারত ভাগের সময়ই রোহিঙ্গাদের মধ্যে গড়ে ওঠে কঠর ইসলামপন্থী মোজাহিদ্বীন দল এবং তারা তখন থেকেই ইসলামী আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়। যেটা অনেকের দৃষ্টিতেই কট্টুর ইসলামী আন্দোলন বলে মনে হয়েছে। সেই সময় তারা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে দেখা করে পাকিস্তানের অংশ হতে চেয়েছিল। রাখাইনের পূর্বাঞ্চলকে পাকিস্তনের অংশের সাথে অন্তর্ভূক্তেরও দাবী জানায় তারা। কিন্তু জিন্নাহ রোহিঙ্গাদের সে দাবী রাখেননি। ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর থেকে রোহিঙ্গা মুজাহিদ্বীনরা রাখাইনের পূর্বাঞ্চলকে মিয়ানমার থেকে আলাদা করার সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে এবং একসময় তারা রাখাইনের পূর্বাঞ্চল শাসন করতেও শুরু করে। অনেক ইতিহাসবিদের মতে এসময় রোহিঙ্গা মুজাহিদ্বীনদের আমন্ত্রনে বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর মুসলিম সেখানে গিয়ে মিয়ানমারের সরকারের বিনা অনুমতিতে বসবাস শুরু করে এবং মুজাহিদ্বীন দলে যোগ দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় রাখাইন অঞ্চলের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গা ও মুজাহিদ্বীনদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। ভিক্ষুদের বিক্ষোভের পরপরই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুজাহিদ্বীনদের শক্তি সক্ষমতা গুড়িয়ে দিতে উদ্যত হয় এবং ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালায়। এর একপর্যায়ে মুজাহিদ্বীনদের নিকট থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয় এবং বহু মুজাহিদ্বীন নেতাকে হত্যা করে মিয়ানমার সরকার। জীবিত অনেকে পালিয়েও যায়। এসব ঘটনা ঘটে এক দশকের মধ্যেই।
এখনও প্রতিদিন মিয়ানমার আর্মি রোহিঙ্গাদের বাড়ী ঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, হত্যা করছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের। হাজার হাজার রোহিঙ্গা উদ্ধাস্ত হতে বাধ্য হচ্ছে প্রতিদিন।
২০১২ সালেও এমন হত্যা নিপীড়নে শত শত রোহিঙ্গা মিয়ানমার আর্মির হাতে নিহত হয়েছে। উদ্ধাস্ত হয়েছে দেড় লক্ষাধিক। স্মরণ থাকার কথা, জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছিল রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সমুদ্রে নৌকা ভাসিয়ে যেদিকেই যাচ্ছিল, সেদিকের কোন পাড়েই অনুমতি ছিলনা নৌকা ভেড়াবার। প্রতিটি দেশের সীমানার সমুদ্র পাড়ে প্রস্তুত ছিল সেদেশের প্রহরী, যেন কোনভাবেই জীবন বিপন্ন রোহিঙ্গারা তাদের দেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে। মানবতার বিরুদ্ধে এ এক নির্লজ্জ অপমান।
মিয়ানমারের গোটা রাখাইন রাজ্যে যখন মানবতা বিরোধী এই বিভৎসরূপ, তখন কোথায় সেই শান্তির দূত আং সান সুচি।
শান্তিতে নোবেল জয়ী আং সান সুচি যেন চোখে কালো চশমা পরেছেন মুখে কুলুপ এটেছেন। মিয়ানমার আর্মির এহেন বর্বরতার বিরুদ্ধে টু শব্দটি পর্যন্ত করছেন না তিনি। এ কেমন শান্তির দূত তিনি। তবে কি ক্ষমতার গদিতে এতই আরাম যে এটি ধরে রাখতে শান্তির দূত হয়েও চূড়ান্ত অশান্তি করতেও দ্বিধা করছেন না। মানবিধকার লঙ্ঘনে এতটুকু লজ্জিত নন তিনি। তবে কি তার শান্তির জন্য লড়াই ছিল নিজের জন্য, অন্যের ক্ষেত্রে লোক দেখানো ! সুচির এই নির্লজ্জ ভূমিকার কারণে ইতোমধ্যেই তার শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়ার দাবী উঠেছে বিশ্ব জুড়ে।
রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা মুজাহিদ্বীন। কিন্তু সব রোহিঙ্গাই তো আর মুজাহিদ্বীন নয়, আবার সব রোহিঙ্গাও জিহাদী নয়। বেশির ভাগ রোহিঙ্গাই সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। বেশিরভাগ রোহিঙ্গাই জীবনের নিরাপত্তা চাই, শান্তিতে বসবাস করতে চাই। আবার আমাদের দেশের একদল মানুষ রোহিঙ্গাদের সমস্যাকে মুসলমানদের সাথে বৌদ্ধদের বিবাদ হিসাবে দেখে তৈরী করতে চাই ধর্মীয় উত্তেজনা। এই সমস্যাকে এত সরলিকরন করলে চলবেনা। আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা ঐ অঞ্চল একটি এথনিক গ্রুপ বা জাতিগোষ্ঠী। সংখ্যায় যত কমই হোক ওদেরও অধিকার আছে সেই দেশের নাগরিক মর্যাদা নিয়ে সেখানেই বসবাস এবং নিজ দেশের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহন করার। কেবল রোহিঙ্গা বলেই তাদের সাথে রাষ্ট্র বৈষম্য ও নির্বতনমূলক আচরণ করবে এটা তো অন্যায়, কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য হতে পারেনা। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে মিয়ানমার আর্মির আগুন দেওয়ার যে খবর পাই, হত্যার খবর পাই এর কোন ব্যাখ্যা না দিয়েই বলা যায় – এ অন্যায় ধিক্কারজনক। রোহিঙ্গাদের এই সমস্যার আন্তরিক সমাধান চাইলে মানবাধিকার বোধসম্পন্নদের সেদেশের সরকারের উপর চাপ তৈরী করতে হবে। সরকার যেন বার্মার সামরিক সরকারের উপর চাপ প্রয়োগে আন্তর্জাতিক কুটনীতি জোরে সোরে শুরু করতে বাধ্য হয়। সেজন্য প্রয়োজন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে এই মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনাকে তুলে ধরে জনমত তৈরী করা। আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করা মিয়ানমারের কাছে নতুন কিছু নয়, মিয়ানমারের এ চর্চা অনেক পুরানো। মিয়ানমারওতো ধীরে হলেও পাল্টাচ্ছে। মিয়ানমারের উপর চাপ সৃষ্টি ছাড়া আমরা আর কিইবা করতে পারি, সেটাও ভাবতে হবে। আর এহেন অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করতেই হবে আমাদের। মানুষ হিসাবে এটা আমাদের দায়িত্ব। প্রতিবাদ করতে হবে এজন্য যেন মিয়ানমারের শাসকেরা বুঝতে পারে পৃথিবীর মানুষ এই জঘন্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সহ্য করবেনা। রুখে দাড়াবে, নির্যাতিতদের পাশে দাড়াবে। একই সাথে এও খেয়াল রাখতে হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের মানবিক বিপর্যয়ের এই ঘটনার প্রতিবাদ করতে যেয়ে যেন সেখানকার মৌলবাদী জঙ্গীবাদ সন্ত্রাসী কথিত জিহাদীকে যেন সমর্থন না করি। তাহলে এই নিরীহ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক সমর্থন হারাবে। মিয়ানমারেরর রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই সমাধান করতে হবে। অনেকে মনে করছেন বাংলাদেশের সীমান্ত খুলে দিয়ে বিপদগ্রস্থ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া উচিৎ। সাধারনভাবে মনে হতে পারে মানবিক কারণে রোহিঙ্গা শরনার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া এই মূহুর্তের কর্তব্য। মিয়ানমার সরকারও এটাই চাইছে। তারা চাইছে জুলুম নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়–ক। আশ্রয় নিক পার্শ্ববর্তী দেশ সমূহে, আপদ বিদায় হোক। মিয়ানমারের অভ্যন্তরে দফায় দফায় মিয়ানমার আর্মির নির্যাতনে রোহিঙ্গারা নানাভাবে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশ করে এখানের জনগোষ্ঠীর সাথে মিশে গিয়েও বসবাস করছে, আবার রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরেও রয়েছে বহু বছর ধরে। সীমান্তের এপার ওপারে বসবাসরতদের চেহারা একই রকম ও পরস্পর আত্মীয় হওয়ায় সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে তাদের অনুপ্রবেশ ও বসবাস নতুন নয়। বাংলাদেশ সরকার বহু বছর থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে ও সরাসরি মিয়ানমার সরকারকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও আজ অবধি তাদের ফিরিয়ে নিতে কোন উদ্যোগই গ্রহন করেনি। আমাদের দেশও এমন সামর্থ্যবান নয় যে সীমান্ত খুলে দিয়ে মিয়ানমার আর্মির নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের আবারও শরণার্থী হিসেবে এদেশে গ্রহন করে নেবে। আর এটাও তো কোন স্থায়ী সমাধান নয়। বাংলাদেশ সরকারের উচিৎ হবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের উপর সেদেশের সরকারের নির্মম হত্যা ও মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগে এখনই কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহন করা।