মাদকাসক্ত মিলনের জীবন পরিবর্তনে প্রশংসার দাবিদার পুলিশ সুপার মাহবুব
- আপলোড টাইম : ০৫:৫৫:১২ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ মে ২০১৮
- / ৪৮৭ বার পড়া হয়েছে
‘শাস্তি শুধু সমাধান নয়, ভালোবাসা-সঠিক পরিচর্যায় সমাধান’
তরুণ দত্ত: এসএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস; পাশাপাশি খেলাধুলায়ও ছিল বাড়তি মনোনিবেশ। সদা হাস্যজ্বল, বেশ চঞ্চল এক টগবগে যুবকের নাম আনিছুর রহমান মিলন; বয়স ৩৭। চুয়াডাঙ্গা কেদারগঞ্জের মৃত বোরহান মুন্সীর ছোট ছেলে সে। ১৯৯৭ সালে ভি.জে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। ওই সময় থেকে খেলাধুলার মাঝে তার স্বাধীন জীবন ছিল। প্রিয় খেলা ক্রিকেট; তাই নিয়মিত অনুশীলনে হয়ে ওঠে ওপেন ব্যাটসম্যান। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ তিন বছর আন্ত:জেলা ক্রিকেট দলসহ ঢাকার স্বনামধন্য সব ক্লাবের হয়ে খেলেছে সে। বিকেএসপি পর্যায়েও তার খেলাধুলার জীবন গড়ায়। খেলাধুলার পাশাপাশি চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলেও এইচএসসি পরীক্ষা দেয়া হয়নি তার। অনাকাঙ্খিত কারণে ২০০১ সালের দিকে চুয়াডাঙ্গায় ফিরে শাপলা কাউন্টারে স্টার্টার হিসেবে আত্মনিয়োগ করে মিলন। এক পর্যায়ে বাস-ট্রাক শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে সে। আর সেখান থেকেই তার নেশার জগতে প্রবেশ। জীবনে প্রথম ফেনসিডিলের বোতল হাতে নেশায় জড়ায় সে। পর্যায়ক্রমে প্যাথেডিন, ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরণের নেশা তাকে গ্রাস করে। দিনের পরিক্রমায় তার মাদক সেবনের পরিমাণ বাড়তে থাকে। সেবনে অতিষ্ঠ হয়ে তার মায়ের সহযোগিতায় তাকে জেলেও পাঠানো হয় ভালো করার জন্য। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখে সে জেল থেকে ছাড়া পায়। আনিছুর রহমান মিলন ইতঃপূর্বে তার বাবা-মায়ের সাথে শহরের পোস্টঅফিসপাড়ায় ভাড়া বাড়িতে থাকতো। তার বাবা শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি করতেন। বছর পাঁচ আগে তিনি মরণব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মারা যাওয়ার ২ বছর পর বাবার রেখে যাওয়া কিছু টাকা ও আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় নিজজমিতে বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন কেদারগঞ্জ এলাকায়। তারা তিন ভাই বোন। মিলন ছাড়াও রয়েছে আরও দু’বোন। বড় বোন বিবাহিত, ছোট বোন প্রতিবন্ধী। সাংসারিক জীবনে তার রয়েছে এক পুত্র সন্তান; তবে পারিবারিক টানাপোড়েনে স্ত্রী অনেক দিন ধরে বাবার বাড়িতে আলাদা থাকেন। এরপরেও সে মাদক ছাড়তে পারেনি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (২৪ মে) একটি প্যাথেডিন গ্রহণ করে সে। সম্প্রতি বিষয়টি ডিজি-র্যাব’র গোচরীভূত হলে একটি ভাইবার গ্রুপের মাধ্যমে অবগত হন চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান পিপিএম। তাৎক্ষণিক বিষয়টি আমলে নিয়ে মিলনকে পুনর্বাসিত করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। তবে তাঁর এই উদ্যোগ ছিল একজন অভিভাবকের ন্যায়। প্রথমে মিলনকে পুলিশ সুপার তাঁর বাসভবনে ডাকেন। এ সময় মিলন তার বক্তব্যে বলেন, ‘স্যার আমি মাদক ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চাচ্ছি; কিন্তু পারছি না।’ পরে তার সাথে খোলামেলা আলাপ এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে দিকনির্দেশনা দেন পুলিশ সুপার। পুলিশ সুপারের পরামর্শে মাদক ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনের সুবাতাস পেতে শুরু করে মিলন। এরপর থেকে এখনও পর্যন্ত সে আর কোন মাদক গ্রহণ করেনি নিশ্চিত করে তার পরিবার।
শুধু দিকনির্দেশনায় নয়; মিলনের বাস্তব জীবন যাপন পরিদর্শনে তার বাড়িতে যান পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান পিপিএম। সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দেলোয়ার হুসাইনকে সাথে নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করেন তিনি। মাথাভাঙ্গা নদীর তীরবর্তী মিলনের ঘরে ফ্যান-লাইট না থাকায় বেশ দুর্বিসহ জীবন ছিল তাদের। এ অবস্থা দেখে পুলিশ সুপার স্বশরীরে উপস্থিত থেকে তাদের ঘরে একটি সিলিং ফ্যান ও দু’টি লাইট লাগানোর ব্যবস্থা করে দেন। এরপরেও তাকে পুনর্বাসন করতে পুলিশ সুপার তার নিজ বাসভবনে রেখে যথপোযুক্ত কর্মসংস্থানের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘একটি ছোট্ট আশায় যদি একজন মাদকাসক্ত মিলনের জীবনকেও আলোকিত করতে পারি আর তাতেই আলোকিত হবে বাংলাদেশ পুলিশের আঙ্গিনা। তবে আমি খুবই আশাবাদী। শাস্তি শুধু সমাধান নয়, ভালোবাসা এবং সঠিক পরিচর্যাও তার সমাধান হতে পারে।’
আলোকিত জীবনের পথযাত্রী মিলন বলেন, ‘মাদকমুক্ত জীবন কামনায় নিজের ইচ্ছা শক্তিই সবার আগে জরুরী। মাদক ছাড়তে পারলে জীবন আলোকিত হবে। সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচা যাবে। আমি অনেক দিন ধরেই মাদক ছাড়ার কথা ভাবছিলাম; এই অবস্থায় এসপি স্যার আর্শিবাদ হয়ে আমার জীবন বদলে দিলেন।’
পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান পিপিএম মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যেমন কঠোর অবস্থান তৈরী করেছেন। তেমনি বিপথগামী মাদকসেবীদের পুর্নবাসন অনন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। অপরদিকে মাদকের অন্ধকার জীবন থেকে মিলনের মূল ¯্রােতে ফিরে আসাটাও লক্ষ্যণীয় হবে বিপথগামী মাদকসেবীদের কাছে।