ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

মাদকবিরোধী শপথে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ০৯:২৯:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০
  • / ২০৩ বার পড়া হয়েছে

চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের সংবর্ধনায় ভূষিত ৫৭৪ জন কৃতী শিক্ষার্থী
সোহেল রানা ডালিম/মেহেরাব্বিন সানভী:
আয়োজনের কমতি নেই, বিশাল বড় প্যান্ডেল। ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে মঞ্চ। নির্ধারিত স্থান ঠিক করা হয়েছে কে কোথায় বসবেন। সুসজ্জিত পোশাকে সকাল সাড়ে আটটা থেকেই স্বাগত জানাচ্ছেন জেলা পুলিশের চৌকস সদস্যরা। বসার পর দিচ্ছেন জেলা পুলিশের প্যাকেটে বই, পেনসিল, ইরেজার, ফাইল, খাতা, বৃক্ষসহ ২১ প্রকারের শুভেচ্ছা সামগ্রী। নাম ধরে ধরে আসনের কাছে যেয়ে দেখা হচ্ছে কেউ অনুপস্থিত আছেন কিনা, থাকলে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ভালোবাসার কমতি নেই, এ যেন এক মহা আয়োজন। বলছিলাম চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশ কর্তৃক ব্যতিক্রমী আয়োজনের মধ্যে দিয়ে চুয়াডাঙ্গার ২০১৯ সালের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কথা।
সংবর্ধনা নিতে এসেছিল চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া রহমান। সংক্ষিপ্ত অনুভূতির কথা জিজ্ঞেস করতেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘খুব ভালো লাগছে! ভাবিনি কখনো এত সুন্দরভাবে পুলিশের কাছ থেকে সংবর্ধনা পাব।’
আরেকজন ছাত্র আবির। ভি. জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালের জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছিল সে। সংবর্ধনা পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে জানালেন, তাঁর ভালো লাগা সীমাহীন। পুলিশ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করেন। তাঁদের কাছ থেকে এমন বড় আয়োজনে সংবর্ধনা পাওয়ার মজাটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। তারপর আবার তাঁর মা-বাবা আছেন এ অনুষ্ঠানে।
এমনই সব অসাধারণ অনুভূতির কথা জানাচ্ছিলেন গতকাল শুক্রবার চুয়াডাঙ্গা পুলিশ লাইনস মাঠে সংবর্ধনা নিতে আসা জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা। চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলামের ব্যতিক্রমী উদ্যোগে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জেলার ৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫৭৪ জন কৃতী শিক্ষার্থীদের এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
জেলার যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৯ সালের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনা দেওয়ার এ ব্যতিক্রমী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’ স্লোগানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জেলা পুলিশ চুয়াডাঙ্গা।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রথমেই এ উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা জেলা ও দায়রা জজ মোহা. রবিউল ইসলাম। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমি এ জেলায় যোগদানের পর এভাবে কখনো কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করিনি। বিচারক হিসেবে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তবে মেধাবী এ শিক্ষার্থীদের জন্য আমি এ অনুষ্ঠানে এসেছি। আমি মেহেরপুরের সন্তান হয়ে যদি চুয়াডাঙ্গার জেলা জজ হতে পারি, তাহলে চুয়াডাঙ্গার সন্তানেরাও অন্য জেলার জজ হতে পারবে না কেন। গোটা পৃথিবীকে শান্তির বলয়ে আটকাতে হলে আইনের দরকার। আইন পড়তে হবে, আইন জানতে হবে। আইন মানুষের অধিকারকে সুরক্ষা দেয়। পুলিশ প্রশাসন এ অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে তোমাদের মেধাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তোমাদের মধ্যে মেধা আছে। কখনো হতাশ হবে না। জীবনে যত কঠিন সময়ই আসুক না কেন, নিজের মেধা দিয়ে সফলতা অর্জন করতে হবে। মনের মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় না থাকলে জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে হবে। বর্তমানে আমরা উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এ দেশটাকে একদিন তোমরা নেতৃত্ব দিবে। আমাদের এদেশটাকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে হবে। গোটা দেশের মধ্যে বিশেষভাবে চুয়াডাঙ্গাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মনে রাখবা, মাদক সব শেষ করে দেয়। কেউ যদি শখ করে দুবার মাদক নেয়, তাঁর শরীরের মধ্যে মাদকের নির্ভরশীলতা চলে আসে। মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার সামনে তোমরা যারা বসে আছ, তারা একেকজন আইনস্টাইন। কারণ, আইনস্টাইন তাঁর নিউরন সেলের আড়াই পারসেন্ট ব্যবহার করেছেন। তোমরাও তাঁর কাছাকাছি ব্যবহার করবে। আমার থেকে বয়স যাদের কম, তারা আমার থেকে স্মার্ট। আমি স্কুলে যেতাম পন্সের স্যান্ডেল পরে, তোমরা যাও কেডস পরে। পন্সের স্যান্ডেল পরে আমি এসপি। আর কেডস পরে তোমাদের হতে হবে আইনস্টাইন। চুয়াডাঙ্গার অনেক মানুষ দুধ বিক্রি করে মদ কিনে খায়, আবার অনেক মানুষ মদ বিক্রি করে দুধ কিনে খায়। চয়েজ ইজ ইউরস। সমাজের প্রতি আমাদের অনেক ঋণ আছে। সমাজের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা ঘরের সামনে অ্যাম্বুলেন্স আসবে, স্কুলের গাড়ি আসবে। এই দেশ উন্নত হবেই। তোমাদেরকে রিলে রেসের মতো করে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কাতারে দাঁড়াতে হবে। ভেতরে সংগ্রাম থাকতে হবে, অধ্যবসায় থাকতে হবে। তাহলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের চাকরি করি, সরকারি একটা কথা বলি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানেই যান, চারটা কথা বলেন। মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গি, দুর্নীতি। এই চারটার বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। তোমদেরও এ কাজে সাথে পেতে চাই। ফেব্রুয়ারির শেষের দিক থেকে আমি নিজে রেড করব। মাদক ব্যবসায়ীদের ঘরবাড়ি-ভিটে ছাড়া করা হবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি ভালো মানুষ হতে পেরেছি কি না, সেটা হলো অনেক বড় বিষয়। ভালো মানুষ তখনই হওয়া যায়, যখন ভালো লেখাপড়ার পাশাপাশি মানবীয় গুণাবলি অর্জন করা যায়। নান্দনিকতায় বেড়ে উঠলে নিজে আলোকিত হওয়া যায়, চারপাশে আলো ছাড়ানোও যায়। নান্দনিকতায় বড় হতে হলে মনের জগৎটাকে অনেক বড় করতে হবে। মনের জগৎকে বড় করতে হলে বেশি বেশি বই পড়তে হবে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-শিল্প সবকিছু পড়তে হবে। সবকিছু পড়ে যখন তুমি বড় হবে, তখনি তুমি নান্দনিকতায় বিকশিত হবে। তখনি তুমি দেশ, জাতি তথা মানুষকে আলোকিত করতে পারবে। কোনো কিছু পেতে হলে আগে কল্পনা করতে হবে। আমরা যখন ঢাকা যাই, তখন মনে মনে ভাবি ট্রেনে কিংবা বাসে যাব। তারপর সেখানে যে কাজ আছে, সেটা কীভাবে করব, তা-ও ভাবি। যদি আরও ছোট উদাহরণ দিই, তবে বলতে পারি, স্কুলে যাওয়ার কথা ভেবেই বাসা থেকে তোমরা বের হও। কোন রাস্তা দিয়ে হেঁটে বা কীভাবে যাবে, সেটাও ভেবে ফেলো বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই। ঠিক একইভাবে ভবিষ্যতের জন্য বড় বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঢাকা কিংবা স্কুলে যাওয়ার মতো করে, সেই স্বপ্ন দেখে মনে মনে সেখানে যেতে হবে, সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে, পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে হবে।’
এ সময় তিনি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমার আমি কত যে অসিম, সে আমিই কি জানি! না জানি কি আছে আমার এ মনে! , তোমাদের মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে, সেটাকে চর্চা করে বের করে আনতে হবে। মনে রাখবা, মানুষ স্বপ্নের সমান বড়। কখনো কখনো স্বপ্নের চেয়েও বড়।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুুমার আগারওয়ালা বলেন, ‘তোমরা যারা এখানে আসতে পেরেছ, তারা প্রত্যেকেই মেধাবী। তোমাদের এখানে আসার পেছনে কিন্তু তোমাদের মায়ের অবদান অনেক বড়। আমিও আমার মায়ের কথা মনে করি। এখন ভাবি, মায়ের কথা মতো যদি আর একটু পড়তাম, তাহলে আরও বড় হতে পারতাম। তাই তোমরা তোমাদের মায়ের কথা শুনবে, মাকে ভালো বাসবে। তোমাদের সফলতার ওপর নির্ভর করছে একটি গোটা জাতির সাফল্য। ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করবে, সে প্রত্যাশা করি। আমি আমার মায়ের নামে যে তারা দেবী ফাউন্ডেশন করেছি, সেটার মাধ্যমে যতটা সম্ভব চেষ্টা করব তোমাদের পাশে থাকার। চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশকে ধন্যবাদ, শুধুমাত্র পুলিশের কার্যক্রমের সঙ্গেই না থেকে এমন মহতী কাজও তারা করেছেন। এ ব্যতিক্রমী উদ্যোগের জন্য পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলামকে ধন্যবাদ।’
এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুল হক বিশ্বাস, আলমডাঙ্গা পৌর মেয়র হাসান কাদির গনু এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিখিল রঞ্জন চক্রবর্তী।
এ সময় আরও বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা ভি. জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল হোসেন উজ্জ্বল, ভাংবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা ইউপি চেয়ারম্যান পরিষদের সভাপতি কাওসার আহমেদ, অভিভাবকদের মধ্যে রেজাউল করিম প্রমুখ।
আনুষ্ঠানের শুরুতে কৃর্তী শিক্ষার্থীদের পক্ষে বক্তব্য দেয় চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়না রাব্বি ও ভি. জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইফতেজা কাছিদ খান।
এ সময় চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কনক কুমার দাস, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবু রাসেলসহ জেলা পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, অভিভাবক ও সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন শিক্ষানবীশ সহকারী পুলিশ সুপার উর্মি দেব। অনুষ্ঠানের শেষে পর্যায়ে উপস্থিত সবাইকে মাদকবিরোধী শপথ বাক্য পাঠ করান পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

মাদকবিরোধী শপথে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক

আপলোড টাইম : ০৯:২৯:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী ২০২০

চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের সংবর্ধনায় ভূষিত ৫৭৪ জন কৃতী শিক্ষার্থী
সোহেল রানা ডালিম/মেহেরাব্বিন সানভী:
আয়োজনের কমতি নেই, বিশাল বড় প্যান্ডেল। ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে মঞ্চ। নির্ধারিত স্থান ঠিক করা হয়েছে কে কোথায় বসবেন। সুসজ্জিত পোশাকে সকাল সাড়ে আটটা থেকেই স্বাগত জানাচ্ছেন জেলা পুলিশের চৌকস সদস্যরা। বসার পর দিচ্ছেন জেলা পুলিশের প্যাকেটে বই, পেনসিল, ইরেজার, ফাইল, খাতা, বৃক্ষসহ ২১ প্রকারের শুভেচ্ছা সামগ্রী। নাম ধরে ধরে আসনের কাছে যেয়ে দেখা হচ্ছে কেউ অনুপস্থিত আছেন কিনা, থাকলে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হচ্ছে। ভালোবাসার কমতি নেই, এ যেন এক মহা আয়োজন। বলছিলাম চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশ কর্তৃক ব্যতিক্রমী আয়োজনের মধ্যে দিয়ে চুয়াডাঙ্গার ২০১৯ সালের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কথা।
সংবর্ধনা নিতে এসেছিল চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী তাসফিয়া রহমান। সংক্ষিপ্ত অনুভূতির কথা জিজ্ঞেস করতেই মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন, ‘খুব ভালো লাগছে! ভাবিনি কখনো এত সুন্দরভাবে পুলিশের কাছ থেকে সংবর্ধনা পাব।’
আরেকজন ছাত্র আবির। ভি. জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালের জেএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছিল সে। সংবর্ধনা পেয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে জানালেন, তাঁর ভালো লাগা সীমাহীন। পুলিশ দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করেন। তাঁদের কাছ থেকে এমন বড় আয়োজনে সংবর্ধনা পাওয়ার মজাটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। তারপর আবার তাঁর মা-বাবা আছেন এ অনুষ্ঠানে।
এমনই সব অসাধারণ অনুভূতির কথা জানাচ্ছিলেন গতকাল শুক্রবার চুয়াডাঙ্গা পুলিশ লাইনস মাঠে সংবর্ধনা নিতে আসা জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা। চুয়াডাঙ্গার পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলামের ব্যতিক্রমী উদ্যোগে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জেলার ৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ৫৭৪ জন কৃতী শিক্ষার্থীদের এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
জেলার যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৯ সালের জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাদের জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানিয়ে সংবর্ধনা দেওয়ার এ ব্যতিক্রমী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম। ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’ স্লোগানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জেলা পুলিশ চুয়াডাঙ্গা।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রথমেই এ উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা জেলা ও দায়রা জজ মোহা. রবিউল ইসলাম। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমি এ জেলায় যোগদানের পর এভাবে কখনো কোনো অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করিনি। বিচারক হিসেবে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। তবে মেধাবী এ শিক্ষার্থীদের জন্য আমি এ অনুষ্ঠানে এসেছি। আমি মেহেরপুরের সন্তান হয়ে যদি চুয়াডাঙ্গার জেলা জজ হতে পারি, তাহলে চুয়াডাঙ্গার সন্তানেরাও অন্য জেলার জজ হতে পারবে না কেন। গোটা পৃথিবীকে শান্তির বলয়ে আটকাতে হলে আইনের দরকার। আইন পড়তে হবে, আইন জানতে হবে। আইন মানুষের অধিকারকে সুরক্ষা দেয়। পুলিশ প্রশাসন এ অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে তোমাদের মেধাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তোমাদের মধ্যে মেধা আছে। কখনো হতাশ হবে না। জীবনে যত কঠিন সময়ই আসুক না কেন, নিজের মেধা দিয়ে সফলতা অর্জন করতে হবে। মনের মধ্যে দৃঢ় প্রত্যয় না থাকলে জীবনযুদ্ধে হেরে যেতে হবে। বর্তমানে আমরা উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। এ দেশটাকে একদিন তোমরা নেতৃত্ব দিবে। আমাদের এদেশটাকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দিতে হবে। গোটা দেশের মধ্যে বিশেষভাবে চুয়াডাঙ্গাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মনে রাখবা, মাদক সব শেষ করে দেয়। কেউ যদি শখ করে দুবার মাদক নেয়, তাঁর শরীরের মধ্যে মাদকের নির্ভরশীলতা চলে আসে। মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার সামনে তোমরা যারা বসে আছ, তারা একেকজন আইনস্টাইন। কারণ, আইনস্টাইন তাঁর নিউরন সেলের আড়াই পারসেন্ট ব্যবহার করেছেন। তোমরাও তাঁর কাছাকাছি ব্যবহার করবে। আমার থেকে বয়স যাদের কম, তারা আমার থেকে স্মার্ট। আমি স্কুলে যেতাম পন্সের স্যান্ডেল পরে, তোমরা যাও কেডস পরে। পন্সের স্যান্ডেল পরে আমি এসপি। আর কেডস পরে তোমাদের হতে হবে আইনস্টাইন। চুয়াডাঙ্গার অনেক মানুষ দুধ বিক্রি করে মদ কিনে খায়, আবার অনেক মানুষ মদ বিক্রি করে দুধ কিনে খায়। চয়েজ ইজ ইউরস। সমাজের প্রতি আমাদের অনেক ঋণ আছে। সমাজের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। ২০৪১ সালে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা ঘরের সামনে অ্যাম্বুলেন্স আসবে, স্কুলের গাড়ি আসবে। এই দেশ উন্নত হবেই। তোমাদেরকে রিলে রেসের মতো করে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সমৃদ্ধ বাংলাদেশের কাতারে দাঁড়াতে হবে। ভেতরে সংগ্রাম থাকতে হবে, অধ্যবসায় থাকতে হবে। তাহলে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যাবে।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের চাকরি করি, সরকারি একটা কথা বলি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেখানেই যান, চারটা কথা বলেন। মাদক, সন্ত্রাস, জঙ্গি, দুর্নীতি। এই চারটার বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। তোমদেরও এ কাজে সাথে পেতে চাই। ফেব্রুয়ারির শেষের দিক থেকে আমি নিজে রেড করব। মাদক ব্যবসায়ীদের ঘরবাড়ি-ভিটে ছাড়া করা হবে।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, ‘ভালো রেজাল্টের পাশাপাশি ভালো মানুষ হতে পেরেছি কি না, সেটা হলো অনেক বড় বিষয়। ভালো মানুষ তখনই হওয়া যায়, যখন ভালো লেখাপড়ার পাশাপাশি মানবীয় গুণাবলি অর্জন করা যায়। নান্দনিকতায় বেড়ে উঠলে নিজে আলোকিত হওয়া যায়, চারপাশে আলো ছাড়ানোও যায়। নান্দনিকতায় বড় হতে হলে মনের জগৎটাকে অনেক বড় করতে হবে। মনের জগৎকে বড় করতে হলে বেশি বেশি বই পড়তে হবে। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-শিল্প সবকিছু পড়তে হবে। সবকিছু পড়ে যখন তুমি বড় হবে, তখনি তুমি নান্দনিকতায় বিকশিত হবে। তখনি তুমি দেশ, জাতি তথা মানুষকে আলোকিত করতে পারবে। কোনো কিছু পেতে হলে আগে কল্পনা করতে হবে। আমরা যখন ঢাকা যাই, তখন মনে মনে ভাবি ট্রেনে কিংবা বাসে যাব। তারপর সেখানে যে কাজ আছে, সেটা কীভাবে করব, তা-ও ভাবি। যদি আরও ছোট উদাহরণ দিই, তবে বলতে পারি, স্কুলে যাওয়ার কথা ভেবেই বাসা থেকে তোমরা বের হও। কোন রাস্তা দিয়ে হেঁটে বা কীভাবে যাবে, সেটাও ভেবে ফেলো বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই। ঠিক একইভাবে ভবিষ্যতের জন্য বড় বড় স্বপ্ন দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, ঢাকা কিংবা স্কুলে যাওয়ার মতো করে, সেই স্বপ্ন দেখে মনে মনে সেখানে যেতে হবে, সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে হবে, পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে হবে।’
এ সময় তিনি কাজী নজরুল ইসলামের একটি কবিতার উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘আমার আমি কত যে অসিম, সে আমিই কি জানি! না জানি কি আছে আমার এ মনে! , তোমাদের মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে, সেটাকে চর্চা করে বের করে আনতে হবে। মনে রাখবা, মানুষ স্বপ্নের সমান বড়। কখনো কখনো স্বপ্নের চেয়েও বড়।’
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক চুয়াডাঙ্গার কৃতী সন্তান ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুুমার আগারওয়ালা বলেন, ‘তোমরা যারা এখানে আসতে পেরেছ, তারা প্রত্যেকেই মেধাবী। তোমাদের এখানে আসার পেছনে কিন্তু তোমাদের মায়ের অবদান অনেক বড়। আমিও আমার মায়ের কথা মনে করি। এখন ভাবি, মায়ের কথা মতো যদি আর একটু পড়তাম, তাহলে আরও বড় হতে পারতাম। তাই তোমরা তোমাদের মায়ের কথা শুনবে, মাকে ভালো বাসবে। তোমাদের সফলতার ওপর নির্ভর করছে একটি গোটা জাতির সাফল্য। ভবিষ্যতে আরও ভালো কিছু করবে, সে প্রত্যাশা করি। আমি আমার মায়ের নামে যে তারা দেবী ফাউন্ডেশন করেছি, সেটার মাধ্যমে যতটা সম্ভব চেষ্টা করব তোমাদের পাশে থাকার। চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশকে ধন্যবাদ, শুধুমাত্র পুলিশের কার্যক্রমের সঙ্গেই না থেকে এমন মহতী কাজও তারা করেছেন। এ ব্যতিক্রমী উদ্যোগের জন্য পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলামকে ধন্যবাদ।’
এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুল হক বিশ্বাস, আলমডাঙ্গা পৌর মেয়র হাসান কাদির গনু এবং জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নিখিল রঞ্জন চক্রবর্তী।
এ সময় আরও বক্তব্য দেন চুয়াডাঙ্গা ভি. জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহফুজুল হোসেন উজ্জ্বল, ভাংবাড়িয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও জেলা ইউপি চেয়ারম্যান পরিষদের সভাপতি কাওসার আহমেদ, অভিভাবকদের মধ্যে রেজাউল করিম প্রমুখ।
আনুষ্ঠানের শুরুতে কৃর্তী শিক্ষার্থীদের পক্ষে বক্তব্য দেয় চুয়াডাঙ্গা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রায়না রাব্বি ও ভি. জে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইফতেজা কাছিদ খান।
এ সময় চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কনক কুমার দাস, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আবু রাসেলসহ জেলা পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, অভিভাবক ও সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন শিক্ষানবীশ সহকারী পুলিশ সুপার উর্মি দেব। অনুষ্ঠানের শেষে পর্যায়ে উপস্থিত সবাইকে মাদকবিরোধী শপথ বাক্য পাঠ করান পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম।