ইপেপার । আজশুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ

ভয়াল আমফানের গর্জন

সমীকরণ প্রতিবেদন
  • আপলোড টাইম : ১০:১২:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ মে ২০২০
  • / ২৫২ বার পড়া হয়েছে

সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার : আজ খুলনা-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত
সমীকরণ প্রতিবেদন:
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের দিকে ভয়াল তর্জন-গর্জনে ছুটছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’। ঘনিয়ে আসছে ছোবল হানার সময়। গতকাল সন্ধ্যায় সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত, আবহাওয়া বিভাগের বিশেষ বুলেটিনে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে ‘সুপার সাইক্লোন’টির গতিবেগ কমে গেছে। এটি এখন ‘অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়’। আঘাতের সময় থাকছে না সিডরের সমান গতি বা শক্তি। ‘আমফান’র সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২শ’ থেকে ২২০ কিলোমিটার। বিকেল নাগাদও ছিল সর্বোচ্চ ২৪৫ কি.মি.। আঘাতকালে গতিবেগ আরও কমতে পারে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়টির সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’র সর্বোচ্চ গতি ২২৩ কি.মি.। ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২০ কি.মি.র বেশি হলে ‘সুপার সাইক্লোন’ ঘোষণা দেয়া হয়। ‘আমফান’র গতকাল রাতে সর্বশেষ অবস্থান অনুযায়ী বাংলাদেশের উপকূলরেখার প্রায় ৬শ’ কিলোমিটার ব্যবধানে এগিয়ে আসে। এদিকে আজ (বুধবার) ভোর থেকে খুলনা-চট্টগ্রামসহ সমুদ্র বন্দরসমূহ এবং এর সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলে ‘মহাবিপদ’ সঙ্কেত ঘোষণার চিন্তা-ভাবনা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্যানিক এড়াতে রাতে এ ধরনের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে না। জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ চর-উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলের প্রত্যন্ত জনপদে বসবাসরত মানুষের জীবনের নিরাপত্তার দিক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এরজন্য তারা যাতে আশ্রয়কেন্দ্রে বা নিরাপদ স্থানে সরে যেতে উদ্বুদ্ধ হন এবং দুর্যোগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এ লক্ষ্যে ‘মহাবিপদ সঙ্কেত’ ঘোষণা করা হতে পারে। গতকাল সারারাত ঘূর্ণিঝড় মতিগতি বিশ্লেষণ করেই কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন বলে জানা গেছে।
করোনা মহামারীকাল এবং মাহে রমজানে এ মুহূর্তে ভয়ার্ত অসহায় লাখ লাখ উপকূলবাসী। গতকাল মঙ্গলবার সর্বত্র থমকে গেছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিপদাপদে আকুল ফরিয়াদে মানুষ পানাহ্ চান আল্লাহর কাছে। দেশের উপকূলব্যাপী বিরাজমান থমথমে গুমোট আবহাওয়া। সাইক্লোনের অশনি সঙ্কেত জানান দিচ্ছে। কোথাও কোথাও হিমেল দমকা হাওয়ার সঙ্গে থেমে থেমে হালকা ও গুঁড়িবৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে শুরু হয় বৃষ্টি-বজ্রবৃষ্টি। গতকাল প্রায় সারাদেশে তাপদাহ দিয়েছে বিরতি। দিন ও রাতের তাপমাত্রা কমেছে ২ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বঙ্গোপসাগরে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ আজ (বুধবার) সন্ধ্যা অথবা রাত নাগাদ খুলনা-চট্টগ্রাম উপকূলে মূল আঘাতটি হানতে পারে। তখন ঘূর্ণিঝড়ের গতি-শক্তি কমে আসতে পারে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ওই সময় গতিবেগ সর্বোচ্চ ১৪০ থেকে ১৬০ থেকো ১৮০ কি.মি. থাকতে পারে। বৃষ্টি-বাদলও ঝড়ের শক্তি হ্রাসে ফ্যাক্টর হতে পারে। তাছাড়া বিশেষজ্ঞগণ জানান, ফানেল (চোঙা) আকৃতির বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের উপকূলভাগ (কন্টিনেন্টাল শেলফ) অগভীর ঢালে ঢালে গড়ন-গঠন। প্রাকৃতিক এ কারণ ও বৈশিষ্ট্যের ফলেও অতীত থেকে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাতকালে মূল শক্তি ধরে রাখতে পারেনি। সমুদ্রভাগে ঘুর্ণনের সময় যে শক্তি ছিল সেই তুলনায় তা আছড়ে পড়লে কমে যায়। তাছাড়া ঝড়ের আগে-পরে অতিবৃষ্টি হলেও ঝড়ের শক্তি হ্রাস পায়। যা পৃথিবীর অনেক দেশে উল্টোটা ঘটে। আঘাতের সময় সেখানে শক্তি ও গতিবেগ আরো বৃদ্ধি পায়।
‘আমফান’ গত দু’দিনে গতিমুখ ও পথরেখা পরিবর্তন করেই বাংলাদেশের উপকূলমুখী এগোতে থাকে। উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে মোড় নিয়েছে। মতিগতির ব্যতিক্রম ঘটলে আঘাতের আগেও গতি বদল এবং শক্তি ক্ষয় হতে পারে। গতিপথ আর পরিবর্তন না করলে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-সুন্দরবনের কাছে বা ভেতর দিয়ে এসে খুলনা-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত করবে। এরপর যশোর, পাবনা, রংপুর অতিক্রম করে যেতে পারে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত। এ সময় মোহনার হাতিয়া ঝড়ের ছোবলে পড়তে পারে ব্যাপক। ‘আমফান’ ঝড়ের অগ্রবর্তী অংশটি পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে খুলনা-সাতক্ষীরা-সুন্দরবন অতিক্রম করে এসে দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়া শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আজ সকাল ও দুপুর নাগাদ। ‘আমফান’ ঘিরে বঙ্গোপসাগর উত্তাল বিক্ষুব্ধ রয়েছে। মংলা-পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৭ নম্বর, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ৬ নম্বর বিপদ সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের একই সময়ে অমাবস্যার সক্রিয় প্রভাবে দেশের সমুদ্র উপকূল, চর-দ্বীপাঞ্চলে ৫ থেকে ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের সতর্কতা দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। বঙ্গোপসাগর ফুঁসে থাকায় গতকাল প্রবল জোয়ারে ভাসতে দেখা গেছে চট্টগ্রাম নগরী সংলগ্ন পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলী, আনোয়ারা, জেলে পাড়াসহ অনেক উপকূলীয় এলাকা। ভাঙা বেড়িবাঁধের এপাশে-ওপাশে ব্যাপক প্লাবিত হয়েছে। এলাকাবাসীকে দেখা গেছে বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু এলাকার দিকে সরে যেতে। করোনা মহামারীকালে হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অরক্ষিত লাখো উপকূলবাসী ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। এতে ভিড়-জটলা, হুড়োহুড়িতে ভেঙে পড়েছে পুরোপুরি লকডাউন। বেড়েছে সংক্রমণের ঝুঁকি। এ অবস্থায় উপকূলবাসীর চরম দুর্ভোগ-বিড়ম্বনার করুণ দৃশ্য সর্বত্র।
‘আমফান’র ক্ষয়ক্ষতি কিংবা বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে উপকূলীয় অন্তত ২১টি জেলায়। সর্বত্র ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর, কন্ট্রোল রুম চালু, স্বেচ্ছাসেবীদের ব্যস্ততা, লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিংয়ের ব্যস্ততা ছিল উপকূল ব্যাপী। আর বৈরী আবহাওয়ায় অচল রয়েছে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের অপারেশানাল কার্যক্রম। তাছাড়া চরম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দেশের নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’র সর্বশেষ গতিপ্রকৃতি ও অবস্থান সম্পর্কে আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন জানান, বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে একই এলাকায় (১৭ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৭. ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থান করছে। এটি গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৭৫ কি.মি. দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৩০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৬০ কি.মি. দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৬৫০ কি.মি. দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ আরও উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে আজ (বুধবার) বিকাল অথবা সন্ধ্যারাতের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ২শ’ কি.মি., যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের এলাকায় বঙ্গোপসাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে। মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
জলোচ্ছ্বাসের সতর্কতা:
ঘূর্ণিঝড় ও অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলাসমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘন্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কি.মি. বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থারত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতিসত্ত্বর নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস- আজ বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের সবক’টি বিভাগের বেশিরভাগ স্থানে ঘূর্ণিঝড় আমফার প্রভাবে দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতিবৃষ্টিও হতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা স্থানভেদে ২ থেকে ৫ ডিগ্রি এবং রাতে ২ থেকে ৪ ডিগ্রি হ্রাস পেতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টি-বজ্রবৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় কুতুবদিয়ায় ৩৭ মিলিমিটার। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রাঙ্গামাটিতে ৩৭.৩ ডিগ্রি সে.। ঢাকার পরদ গতকাল নেমে যায় সর্বোচ্চ ৩৪.৫ ডিগ্রিতে।

ট্যাগ :

নিউজটি শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন

ভয়াল আমফানের গর্জন

আপলোড টাইম : ১০:১২:৩৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ মে ২০২০

সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ২২০ কিলোমিটার : আজ খুলনা-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত
সমীকরণ প্রতিবেদন:
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের দিকে ভয়াল তর্জন-গর্জনে ছুটছে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’। ঘনিয়ে আসছে ছোবল হানার সময়। গতকাল সন্ধ্যায় সর্বশেষ তথ্য-উপাত্ত, আবহাওয়া বিভাগের বিশেষ বুলেটিনে জানা যায়, বঙ্গোপসাগরে ‘সুপার সাইক্লোন’টির গতিবেগ কমে গেছে। এটি এখন ‘অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়’। আঘাতের সময় থাকছে না সিডরের সমান গতি বা শক্তি। ‘আমফান’র সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ২শ’ থেকে ২২০ কিলোমিটার। বিকেল নাগাদও ছিল সর্বোচ্চ ২৪৫ কি.মি.। আঘাতকালে গতিবেগ আরও কমতে পারে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়টির সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’র সর্বোচ্চ গতি ২২৩ কি.মি.। ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ২২০ কি.মি.র বেশি হলে ‘সুপার সাইক্লোন’ ঘোষণা দেয়া হয়। ‘আমফান’র গতকাল রাতে সর্বশেষ অবস্থান অনুযায়ী বাংলাদেশের উপকূলরেখার প্রায় ৬শ’ কিলোমিটার ব্যবধানে এগিয়ে আসে। এদিকে আজ (বুধবার) ভোর থেকে খুলনা-চট্টগ্রামসহ সমুদ্র বন্দরসমূহ এবং এর সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলে ‘মহাবিপদ’ সঙ্কেত ঘোষণার চিন্তা-ভাবনা করছে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। প্যানিক এড়াতে রাতে এ ধরনের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে না। জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ চর-উপকূল ও দ্বীপাঞ্চলের প্রত্যন্ত জনপদে বসবাসরত মানুষের জীবনের নিরাপত্তার দিক গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। এরজন্য তারা যাতে আশ্রয়কেন্দ্রে বা নিরাপদ স্থানে সরে যেতে উদ্বুদ্ধ হন এবং দুর্যোগের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন এ লক্ষ্যে ‘মহাবিপদ সঙ্কেত’ ঘোষণা করা হতে পারে। গতকাল সারারাত ঘূর্ণিঝড় মতিগতি বিশ্লেষণ করেই কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন বলে জানা গেছে।
করোনা মহামারীকাল এবং মাহে রমজানে এ মুহূর্তে ভয়ার্ত অসহায় লাখ লাখ উপকূলবাসী। গতকাল মঙ্গলবার সর্বত্র থমকে গেছে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বিপদাপদে আকুল ফরিয়াদে মানুষ পানাহ্ চান আল্লাহর কাছে। দেশের উপকূলব্যাপী বিরাজমান থমথমে গুমোট আবহাওয়া। সাইক্লোনের অশনি সঙ্কেত জানান দিচ্ছে। কোথাও কোথাও হিমেল দমকা হাওয়ার সঙ্গে থেমে থেমে হালকা ও গুঁড়িবৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে শুরু হয় বৃষ্টি-বজ্রবৃষ্টি। গতকাল প্রায় সারাদেশে তাপদাহ দিয়েছে বিরতি। দিন ও রাতের তাপমাত্রা কমেছে ২ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বঙ্গোপসাগরে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ আজ (বুধবার) সন্ধ্যা অথবা রাত নাগাদ খুলনা-চট্টগ্রাম উপকূলে মূল আঘাতটি হানতে পারে। তখন ঘূর্ণিঝড়ের গতি-শক্তি কমে আসতে পারে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ওই সময় গতিবেগ সর্বোচ্চ ১৪০ থেকে ১৬০ থেকো ১৮০ কি.মি. থাকতে পারে। বৃষ্টি-বাদলও ঝড়ের শক্তি হ্রাসে ফ্যাক্টর হতে পারে। তাছাড়া বিশেষজ্ঞগণ জানান, ফানেল (চোঙা) আকৃতির বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের উপকূলভাগ (কন্টিনেন্টাল শেলফ) অগভীর ঢালে ঢালে গড়ন-গঠন। প্রাকৃতিক এ কারণ ও বৈশিষ্ট্যের ফলেও অতীত থেকে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাতকালে মূল শক্তি ধরে রাখতে পারেনি। সমুদ্রভাগে ঘুর্ণনের সময় যে শক্তি ছিল সেই তুলনায় তা আছড়ে পড়লে কমে যায়। তাছাড়া ঝড়ের আগে-পরে অতিবৃষ্টি হলেও ঝড়ের শক্তি হ্রাস পায়। যা পৃথিবীর অনেক দেশে উল্টোটা ঘটে। আঘাতের সময় সেখানে শক্তি ও গতিবেগ আরো বৃদ্ধি পায়।
‘আমফান’ গত দু’দিনে গতিমুখ ও পথরেখা পরিবর্তন করেই বাংলাদেশের উপকূলমুখী এগোতে থাকে। উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে মোড় নিয়েছে। মতিগতির ব্যতিক্রম ঘটলে আঘাতের আগেও গতি বদল এবং শক্তি ক্ষয় হতে পারে। গতিপথ আর পরিবর্তন না করলে ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ-সুন্দরবনের কাছে বা ভেতর দিয়ে এসে খুলনা-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত করবে। এরপর যশোর, পাবনা, রংপুর অতিক্রম করে যেতে পারে আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত। এ সময় মোহনার হাতিয়া ঝড়ের ছোবলে পড়তে পারে ব্যাপক। ‘আমফান’ ঝড়ের অগ্রবর্তী অংশটি পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে খুলনা-সাতক্ষীরা-সুন্দরবন অতিক্রম করে এসে দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়া শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আজ সকাল ও দুপুর নাগাদ। ‘আমফান’ ঘিরে বঙ্গোপসাগর উত্তাল বিক্ষুব্ধ রয়েছে। মংলা-পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৭ নম্বর, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ৬ নম্বর বিপদ সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের একই সময়ে অমাবস্যার সক্রিয় প্রভাবে দেশের সমুদ্র উপকূল, চর-দ্বীপাঞ্চলে ৫ থেকে ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসের সতর্কতা দিয়েছে আবহাওয়া বিভাগ। বঙ্গোপসাগর ফুঁসে থাকায় গতকাল প্রবল জোয়ারে ভাসতে দেখা গেছে চট্টগ্রাম নগরী সংলগ্ন পতেঙ্গা, হালিশহর, কাট্টলী, আনোয়ারা, জেলে পাড়াসহ অনেক উপকূলীয় এলাকা। ভাঙা বেড়িবাঁধের এপাশে-ওপাশে ব্যাপক প্লাবিত হয়েছে। এলাকাবাসীকে দেখা গেছে বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু এলাকার দিকে সরে যেতে। করোনা মহামারীকালে হঠাৎ ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, অরক্ষিত লাখো উপকূলবাসী ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। এতে ভিড়-জটলা, হুড়োহুড়িতে ভেঙে পড়েছে পুরোপুরি লকডাউন। বেড়েছে সংক্রমণের ঝুঁকি। এ অবস্থায় উপকূলবাসীর চরম দুর্ভোগ-বিড়ম্বনার করুণ দৃশ্য সর্বত্র।
‘আমফান’র ক্ষয়ক্ষতি কিংবা বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে উপকূলীয় অন্তত ২১টি জেলায়। সর্বত্র ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তর, কন্ট্রোল রুম চালু, স্বেচ্ছাসেবীদের ব্যস্ততা, লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিংয়ের ব্যস্ততা ছিল উপকূল ব্যাপী। আর বৈরী আবহাওয়ায় অচল রয়েছে দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের অপারেশানাল কার্যক্রম। তাছাড়া চরম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দেশের নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। গতকাল সন্ধ্যায় অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’র সর্বশেষ গতিপ্রকৃতি ও অবস্থান সম্পর্কে আবহাওয়ার বিশেষ বুলেটিনে আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন জানান, বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে বর্তমানে একই এলাকায় (১৭ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৭. ডিগ্রি পূর্ব দ্রাঘিমাংশ) অবস্থান করছে। এটি গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৭৫ কি.মি. দক্ষিণপশ্চিমে, কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৩০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে, মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৬০ কি.মি. দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং পায়রা সমুদ্র বন্দর থেকে ৬৫০ কি.মি. দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থান করছিল।
ঘূর্ণিঝড় ‘আমফান’ আরও উত্তর, উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী অঞ্চল দিয়ে আজ (বুধবার) বিকাল অথবা সন্ধ্যারাতের মধ্যে বাংলাদেশের উপকূল অতিক্রম করতে পারে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৮৫ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘন্টায় ২শ’ কি.মি., যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ২২০ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের এলাকায় বঙ্গোপসাগর খুবই বিক্ষুব্ধ রয়েছে। মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৭ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরকে ৬ নম্বর বিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৬ নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায় থাকবে।
জলোচ্ছ্বাসের সতর্কতা:
ঘূর্ণিঝড় ও অমাবস্যার প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ১০ ফুট অধিক উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। ঘূর্ণিঝড় অতিক্রমকালে সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলাসমূহ এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহে ভারী থেকে অতি ভারী বর্ষণসহ ঘন্টায় ১৪০ থেকে ১৬০ কি.মি. বেগে দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থারত সকল মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে অতিসত্ত্বর নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
ভারী বর্ষণের পূর্বাভাস- আজ বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টার পূর্বাভাসে জানা গেছে, ঢাকাসহ দেশের সবক’টি বিভাগের বেশিরভাগ স্থানে ঘূর্ণিঝড় আমফার প্রভাবে দমকা থেকে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতিবৃষ্টিও হতে পারে। সারাদেশে দিনের তাপমাত্রা স্থানভেদে ২ থেকে ৫ ডিগ্রি এবং রাতে ২ থেকে ৪ ডিগ্রি হ্রাস পেতে পারে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় বৃষ্টি-বজ্রবৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয় কুতুবদিয়ায় ৩৭ মিলিমিটার। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রাঙ্গামাটিতে ৩৭.৩ ডিগ্রি সে.। ঢাকার পরদ গতকাল নেমে যায় সর্বোচ্চ ৩৪.৫ ডিগ্রিতে।